যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি ও সেমিকন্ডাক্টরে ব্যবহৃত টাংস্টেনের সরবরাহ চেইনের দখল চীনের হাতে
বিশ্বের অনেক বিরল ধাতুর সরবরাহ চেইনে চীনের আধিপত্য রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দেশটি অন্তত একটি বিরল ধাতুর ওপর বড় কোনো বিধিনিষেধ দেয়নি: টাংস্টেন।
প্রায় হীরার মতোই কঠিন এ ধাতু। এর শক্তি ঘনত্ব অত্যন্ত বেশি। এ গুণের কারণেই এটি অস্ত্র, অটোমোবাইল, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি, সেমিকন্ডাক্টর ও বিভিন্ন শিল্পের কাটিং মেশিনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাতু হয়ে উঠেছে। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ও এনভিডিয়ার মতো চিপ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো এ ধাতু ব্যবহার করে।
চলতি বছরের শেষদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি টাংস্টেন খনি ফের খোলার জন্য অন্তত ৭৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করছেন কানাডার অ্যালমন্টি ইন্ডাস্ট্রিজের সিইও লুইস ব্ল্যাক। তিনি বলেন, 'টাংস্টেন নিয়ে বড় কোনো সঙ্ঘাতের আশঙ্কা করছি না।'
তিনি বলেন, কোনো দেশ তার টাংস্টেন সরবরাহ খুব বেশি বহুমুখীকরণ করতে চাইলে প্রধান সরবরাহকারী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। টাংস্টেন বরাবরই 'কূটনৈতিক ধাতু' বলে উল্লেখ করেন তিনি।
মে মাসে টাংস্টেন আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তবে চীন সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের এ উদ্যোগকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কারণ বেইজিং নিজস্ব বিরল মৃত্তিকা ধাতুর উৎপাদনে নজর রাখার যে নতুন নিয়ম করেছে, তাতে টাংস্টেনের নাম রাখেনি।
লুইস ব্ল্যাক বলেন, শুল্ক বৃদ্ধি অনেকটা সতর্কবার্তার মতো ছিল। কেননা চীনের রপ্তানি করা ২৫টি কৌশলগত ধাতুর মধ্যে মাত্র তিনটির ওপর শুল্ক বসিয়েছেন বাইডেন।
তিনি বলেন, 'চীন সম্ভবত খুব একটা উদ্বিগ্ন হয়নি, কারণ তারা নতুন শুল্ক উপেক্ষা করে গেছে। অতীতে কিন্তু উল্টোটা করেছিল—সে সময় তারা কিছু বিরল মৃত্তিকা ধাতুর রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। চীন শুল্ক বাড়ানোর ব্যাপারটা পুরোপুরি উপেক্ষা করে গেছে, কারণ তারা উত্তেজনা বাড়াতে চায় না।'
গত মাসে চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল টাংস্টেনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক বসানোর বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেবেন কি না। জবাবে মুখপাত্র হে ইয়াদং কোনো পাল্টা পদক্ষেপের কথা বলেননি। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বাড়তি শুল্ক প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন।
এর আগে চলতি বছরের শুরুর দিকে অবশ্য একটি বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছিল, পরিবেশগত বিধিনিষেধের কারণে চীন তাদের টাংস্টেন উৎপাদনের জাতীয় কোটা কমিয়েছে।
ইউরোপ-আমেরিকায় চীনের বাইরে থেকে আসা টাংস্টেনের চাহিদা বাড়ছে। লুইস ব্ল্যাক আশা করছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার খনি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে টাংস্টেন আসবে।
কিছু মার্কিন কোম্পানি চীনা টাংস্টেন ব্যবহার বন্ধ করারও চেষ্টা করছে। গত বছর ইউরোপিয়ান কমিশন চীন থেকে আমদানি করা টাংস্টেনের ওপর আরও পাঁচ বছরের জন্য শুল্ক বসিয়েছে।
দাম বাড়ছে টাংস্টেনের
চড়া চাহিদার বিপরীতে সীমিত জোগান থাকায় অনেকদিন ধরেই টাংস্টেনের দাম বাড়ছে। যদিও গত কয়েক সপ্তাহে দাম সামান্য কমেছে।
সম্প্রতি চীনা ক্রেতারাও টাংস্টেন কেনা বাড়িয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর চেয়েও বেশি দামে এ ধাতু কিনছে।
জানুয়ারিতে মার্কিন গবেষণা সংস্থা ম্যাক্রো অপস বলেছে, টাংস্টেন সরবরাহের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এক স্পর্শকাতর বাঁকে পৌঁছেছে। অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রের টাংস্টেনের মজুত ফুরিয়ে যাবে। আগামী ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র ধাতুটির নিট বিক্রেতা থেকে ক্রেতায় পরিণত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ছয়টি কোম্পানির টাংস্টেন উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে দেশটি স্থানীয়ভাবে টাংস্টেন উৎপাদন করছে না। এর অর্থ, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের টাংস্টেন সরবরাহ বাইরের দেশ থেকে আসতে হবে।
দক্ষিণ কোরিয়ামুখী হচ্ছে অন্য টাংস্টেনে আগ্রহীরা
টাংস্টেনের সরবরাহ চেইনের ৮০ শতাংশের বেশি চীনের দখলে। তবে খনিগুলোর বয়স হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এছাড়া উত্তর কোরিয়া, মধ্য আফ্রিকা ও মিয়ানমার থেকেও টাংস্টেন আমদানি করছে চীন।
এর ফলে চীনের বাইরে থেকে টাংস্টেন সংগ্রহের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষক মার্ক সেডন।
টাংস্টেনের সরবরাহ চেইনের সঙ্গে যুক্ত চীনের বাইরের অন্যান্য কোম্পানিগুলো এখন দক্ষিণ কোরিয়ামুখী।
ফেব্রুয়ারিতে ওয়ারেন বাফেটের মালিকানাধীন আইএমসি গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আইএমসি এন্ডমিল দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েগু সিটি সরকারের সঙ্গে ৯৩.৬ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। কোম্পানিটি একটি টাংস্টেন পাউডার উৎপাদন কারখানায় বিনিয়োগ করবে।
কয়েক দশক ধরে বিরল ধাতুর সরবরাহ চেইনে চীনের আধিপত্য বিস্তৃত হয়েছে।
বহু বছর ধরেই চীনের বাইরে টাংস্টেন উৎপাদন করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যাতে টাংস্টেনের বৈশ্বিক সরবরাহ চেইন অনেকাংশে বাড়ানো যায়। এমন একটি উদ্যোগ ছিল কানাডার নিউ ব্রুনসউইকের একটি খনি।
কিন্তু এসব উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি। ২০ বছর ধরেই এসব প্রকল্প আলোচনার টেবিলে পড়ে রয়েছে। ভূগর্ভস্থ টাংস্টেন আর উত্তোলন করা হয়নি।
নিজেদেরকে চীনের বাইরে সবচেয়ে বড় টাংস্টেন উৎপাদনকারী বলে দাবি করে অ্যালমন্টি। কোম্পানিটি এখন মূলত পর্তুগাল ও স্পেনে কার্যক্রম চালাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাংদংয়ে তারা যে খনি চালু করতে যাচ্ছে সেটি ১৯৯০-এর দশক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে চলতি বছরের শেষদিকে খনিটি ফের খোলার পরও অ্যালমন্টি বৈশ্বিক টাংস্টেন সরবরাহের মাত্র ৭-৮ শতাংশ হিস্যা দখলে নিতে পারবে বলে আশা করছেন লুইস ব্ল্যাক।