লবণ ও স্বর্ণের সাম্রাজ্য: সর্বকালের সেরা এই ধনী ব্যক্তি কে?
ঔপনিবেশিক আমলের আগে আফ্রিকার দেশগুলোর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মূলত মধ্যযুগে আফ্রিকায় বড় বড় বাণিজ্য সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত সাহেল অঞ্চল আফ্রিকান সভ্যতায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল। এখানেই আফ্রিকার প্রথম দিকের কয়েকটি জাতির আবির্ভাব ঘটে।
একটি উল্লেখযোগ্য সাম্রাজ্য ছিল মালি সাম্রাজ্য, যা ১৩ থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এটি ছিল বর্তমান মালি, গিনি, সেনেগাল, নাইজার এবং মৌরিতানিয়া জুড়ে । নাইজার নদীর কাছে অবস্থিত মালি সাম্রাজ্যের বিখ্যাত শাসকদের মধ্যে একজন ছিলেন মানসা মুসা।
আফ্রিকায় এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন মানসা মুসা। আটলান্টিকের পশ্চিম উপকূল থেকে মরুর দেশ নাইজার পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তার এলাকায় অনেক স্বর্ণের বিশাল বিশাল ভাণ্ডার ছিল, আর তা দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন কমপক্ষে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক। কেউ বলে এ সংখ্যাটি ৭০০ বিলিয়নও অতিক্রম করতে পারে।
মানসা মুসা ১৩০৭/১৩১২ থেকে ১৩৩২/১৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন, তিনি ছিলেন নবম মানসা, মানিনকা ভাষায় যার অর্থ 'রাজা' বা 'শাসক'। তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত রাজত্বকাল সত্ত্বেও, মানসা মুসার নেতৃত্ব মালি সাম্রাজ্যের মধ্যে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক সম্প্রসারণ এবং বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছিল।
মুসা তার অঢেল সম্পদের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন—এমনকি একবিংশ শতাব্দীতে এসেও মানসা মুসাকে মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হিসাবে স্বীকৃত দেয়া হয়।
২০১৪ সালে, প্রকাশনা সংস্থা সেলিব্রিটি নেট ওয়ার্থ-এর অনুমান অনুযায়ী, এই সময়ে এসে মুসার সম্পদের অর্থমূল্য দাঁড়াবে ৪০০ বিলিয়ন ডলারে—যা রথসচাইল্ড পরিবার এবং আমেরিকান উদ্যোক্তা জন ডি রকফেলারের মতো ব্যক্তিদের সম্পদের থেকেও বেশি।
মুসার সম্পদের উৎস
মানসা মুসার ব্যক্তিগত সম্পদের সঠিক হিসেব করা কঠিন, কারণ মধ্যযুগে একজন শাসকের সম্পদ এবং রাষ্ট্রের সম্পদ প্রায়ই একে অপরের সাথে জড়িত ছিল। এখনকার মতো চতুর্দশ শতাব্দীতেও, মালি সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান মুসাকে অবর্ণনীয় সম্পদের মালিক বানিয়ে দেয়।
এই সাম্রাজ্য, নাইজার নদীর উপত্যকার বেশিরভাগ অংশ এবং সাহারা মরুভূমির কিছু অংশ জুড়ে, আরব ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর সাথে স্বর্ণ ও লবণের মূল বাণিজ্য রুটগুলো নিয়ন্ত্রণ করত।
সোনা প্রতিপত্তির প্রতীক ছিল এবং অর্থ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অন্যদিকে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য লবণ অপরিহার্য ছিল। ওই সময় স্বর্ণ ও লবণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান পণ্য হিসেবে পরিণত হয়।
মালির নিজেদের এই পণ্যগুলোর আমানত ছিল। মালির শাসকরা বাণিজ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে, কর এবং বাণিজ্য শুল্ক নির্ধারণ করতে পারতেন। এইভাবে মালি সাম্রাজ্য পশ্চিম আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগরীয় এবং আরব বিশ্বকে সংযুক্ত করে ট্রান্স-সাহারান বাণিজ্যে একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান দখল করেছিল।
বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ থাকায় পরিবহণ কর থেকে রাজ্যের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয় হতো এবং সেই রাজস্বেই ফুলে ফেঁপে ওঠে মাসান মুসার সম্পদ।
মক্কায় হজযাত্রা ও বিশ্বখ্যাতি
এক দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার পর ১৩২৪ সালে, মাসান মুসা হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওনা হন। ৬০ হাজারের বিশাল এক বাহিনী ছিল সঙ্গে। সোনা বোঝাই উট ছিল ৮০টি আর দাস ছিল ১২ হাজার। চলার পথে পড়েছিল কায়রো আর কায়রোতে তার বাহিনীর সকলে এমনকি দাসেরাও স্বর্ণ ছড়িয়ে দিয়েছিল মুড়ি-মুড়কির মতো।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পশ্চিম আফ্রিকার ইতিহাস বিশেষজ্ঞ মাইকেল এ গোমেজের মতে, হজে সঙ্গে নেওয়া সোনার পরিমাণ ১৮ টন পর্যন্ত হতে পারে।
মুসার তীর্থযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল সম্পদ এবং ক্ষমতা প্রদর্শন করা। এই যাত্রার মাধ্যমেই বিশ্ব মালি সাম্রাজ্য এবং শাসক উভয়ের সম্পদ সম্পর্কে জানতে পেরেছিল।
মক্কা যাওয়ার পথে মানসা মুসার দল আধুনিক মৌরিতানিয়া, আলজেরিয়া ও মিশর ভ্রমণ করে। পথিমধ্যে মানসা মুসা উদারভাবে গরিব-দুঃখীদের মাঝে স্বর্ণ বিতরণ করেন। যখন তিনি মামলুক সালতানাতের রাজধানী কায়রোতে পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি এত বেশি সোনা ব্যয় করেছিলেন যে এর দাম হ্রাস পেয়েছিল, যার ফলে স্থানীয় বাজারগুলো অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছিল।
মানসা মুসার হজযাত্রার ফলে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের শক্তি ও বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায়। ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোর বাড়ন্ত স্বর্ণের বাজার মালির অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করলেও এটি ট্রান্স-সাহারান বাণিজ্য রুট বিকাশে সহায়তা করেছিল এবং মালি সাম্রাজ্যকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছিল।
সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের বিকাশ
অর্থনৈতিক সাফল্য এবং বিদেশি ব্যবসায়ীদের আগমনের কারণে মালি সাম্রাজ্য প্রসারিত ও বিকশিত হতে থাকে। মুসার আমলে মালি আয়তনে, অর্থনীতিতে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানেও বিস্তৃত হয়।
মানসা মুসার হজযাত্রার পর বন্দর নগরী টিম্বাকটু ও গাও মালি সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। টিম্বাকটুসহ ২৪টি শহর ছিল তার সাম্রাজ্যে। তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের মুসলিম স্থপতিদের এসব শহর নির্মাণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। এই স্থপতিদের মধ্যে একজন ছিলেন আল-আন্দালুস (বর্তমানে স্পেনের আন্দালুসিয়া) থেকে আবু ইসহাক আল-সাহেলি।
আল-সাহেলির নেতৃত্বে পাঁচটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল, যার মধ্যে ১৩২৭ সালে নির্মিত টিম্বাকটুর জিঙ্গুয়েরেবার মসজিদ অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা আজও আংশিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
টিম্বাকটুতে তিনি ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, অংকশাস্ত্র, সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদির চর্চা হতো। টিম্বাকটু তাই সেসময়ে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। মুসার রাজপ্রাসাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তার সৃষ্ট মসজিদ ও বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বিরাজ করছে।
সাম্রাজ্যের পতন
মানসা মুসার শাসনামলকে মালি সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়। তিনি আধুনিক সেনেগাল, মালি, গিনি, গিনি বিসাউ, মৌরিতানিয়া, বুর্কিনা ফাসো, গাম্বিয়া এবং আইভরি কোস্ট অঞ্চল শাসন করেছিলেন।
ঐতিহাসিকেরা তাকে বিভিন্ন বিশেষণে চিত্রিত করেছেন। ইউরোপের ঐতিহাসিকদের কাছে তিনি 'মুসা দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট'।
তার রাজত্বকালে, মালি সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল এবং নতুন ভবন, উন্নত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতি সহ দুর্দান্ত সাংস্কৃতিক বৃদ্ধি দেখেছিল। এতে মানসা মুসার চমৎকার নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
মুসার মৃত্যুর পর তার সন্তানেরা সাম্রাজ্যের হাল ধরেন, তবে এতো বড় সাম্রাজ্য তারা ধরে রাখতে পারেননি। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং বহির্বিশ্বের চাপের কারণে সাম্রাজ্যের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
মালির বিভিন্ন অঞ্চল তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনুসরণ করতে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল, যার ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ শহর টিম্বাকটু এবং গাওসহ মালি সাম্রাজ্যের পূর্ব অঞ্চলগুলো সোনহাই জনগণেরা দখল করে নেয়, যারা ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, মালি সাম্রাজ্য তার উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ ভূমি হারিয়েছিল এবং বাণিজ্য পথেও ঘন ঘন আক্রমণের শিকার হয়েছিল।
ইউরোপের প্রধান সোনার সরবরাহকারী মালির পতনের পর বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন আসে। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চলে মূল্যবান ধাতুর নতুন উৎস অনুসন্ধান করতে বাধ্য হয়েছিল।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন