কেন কিছু মানুষ বিদঘুটে চেহারার প্রাণী পছন্দ করে?
প্রায়ই দেখা যায় কিছু কিম্ভূতকিমাকার জাতের কুকুর বা অন্যান্য অনাকর্ষণীয় পোষা প্রাণী খুব দ্রুত আমাদের মনে জায়গা করে নেয়। কিন্তু কখনো ভেবেছেন কী, নান্দনিকতার ছোয়াবিহীন এসব প্রাণী কীভাবে মানুষকে এত আকর্ষিত করে?
প্রতি বছর জুন মাসে ক্যালিফোর্নিয়ার পেটালুমায় বিচারকরা 'বিশ্ব কদাকার কুকুর' প্রতিযোগিতার বিজয়ী নির্বাচন করেন।
এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া কুকুরদের মধ্যে থেকে থ্যাবড়া নাক, উঁচু দাঁত, ঠিকরে বের হয়ে আসা চোখ এবং ঝাঁকড়া লোম প্রভৃতির বিচারে বিজয়ী নির্বাচন করা হয়। খবর বিবিসির
স্বাভাবিকভাবেই এই প্রতিযোগীরা বিশ্বজুড়ে পশুপ্রেমীদের হৃদয়ে বিশেষ জায়গা করে নেয়।
দেখা যায় পোষা প্রাণীর বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে সবসময়ই একটি ভাইরাল কনটেন্ট।
প্রশ্ন হলো কেন কদাকার প্রাণীদের আমাদের কাছে এত আকর্ষণীয় লাগে? এবং 'কী' মানুষের চোখে বিদঘুটে চেহারার এসব প্রাণীদের এত সুন্দর করে তোলে?
বিবর্তন এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।
অস্ট্রিয়ান প্রাণিবিদ কনরাড লরেঞ্জের মতে, বড় চোখ, বড় মাথা এবং নরম দেহের মতো শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি মানুষের আকর্ষণ একটি বিবর্তনীয় অভিযোজন। এগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের মনে নিজের বংশধরদের যত্ন নেওয়া এবং পৃথিবীতে নিজের প্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার নিশ্চয়তা বোধ সৃষ্টি করে।
১৯৪৩ সালে লরেঞ্জ এসব বৈশিষ্ট্যকে 'শিশুর স্কিমা' নামে অভিহিত করেছেন।
ব্লবফিশ, পাগ, আয়ে-আয়েস এবং বুলডগের মতো বিদঘুতে চেহারার কুকুরদের মধ্যে এই শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ফলে এসব বৈশিষ্ট্য মানুষের মধ্যে স্নেহময় প্রতিক্রিয়া এবং লালন ও সুরক্ষার সহজাত প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তোলে।
রোমের ইস্টিটুটো সুপিরিয়র ডি সানিটার গবেষক মার্তা বোর্গি বলেন, এই শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যগুলো একজন ব্যক্তির 'প্রতিরক্ষামূলক আচরণ, মনোযোগ এবং যত্ন নেওয়ার ইচ্ছা' বাড়ায় এবং 'শিশুর প্রতি আগ্রাসনের সম্ভাবনা' কমায়।
তিনি বলেন, যেসব মানুষের বাচ্চাদের 'লালন-পালনের ভার অন্য ওপর নির্ভরশীল, তাদের মধ্যে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আরও বেশি হয়।'
২০১৪ সালে বোর্গি এবং অন্যান্য গবেষকদের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, খুব অল্প বয়সেই শিশুদের মধ্যে 'সৌন্দর্যবোধ'-এর অনুভূতি জন্মায়। তিন বছরের কম বয়সী শিশুরা বড় চোখ, বোতাম (ক্ষুদ্র গোলাকার) নাক এবং গোল মুখের প্রাণী ও মানুষকে বেশি পছন্দ করে।
বোর্গি বলেছেন, 'আমরা আরও দেখিয়েছি যে মানুষের মনে খুব তাড়াতাড়ি শিশুসুলভ মুখের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কুকুর ও বিড়ালদের প্রতি স্নেহ জন্মায়।'
গবেষকরা তিন থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের বিভিন্ন প্রাণীর ছবি দেখিয়েছেন।
তারা শিশুদের চোখের নড়াচড়া বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, শিশুরা অন্য প্রাণীদের তুলনায় কুকুর, বিড়াল ও মানুষের ছবি বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখেছে। ঠিকঠাক শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্য আনার জন্য ছবিগুলো ডিজিটালভাবে পরিবর্তন করা হয়েছিল।
তারা বাচ্চাদের এক থেকে পাঁচ স্কেলে ছবিগুলো বাছাই করতে বলেছিল। বাচ্চারা একটি ছবিকে 'সুন্দর নয়' এবং পাঁচটি ছবিকে 'খুব সুন্দর' বলে জানিয়েছে।
দেখা গেছে, অধিকাংশ শিশু কম শিশুসুলভ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীর তুলনায়, উঁচু কপাল, বড় চোখ এবং ছোট নাকযুক্ত গোলাকার মুখের প্রাণীদের বেশি সুন্দর হিসেবে বাছাই করেছে।
বোর্গি বলেন, 'আমরা দেখিয়েছি যে কুকুর এবং বিড়ালদের মধ্যে মুখের শিশুর স্কিমার মাত্রা শিশুদের সৌন্দর্যবোধকে প্রভাবিত করে।'
অধিকাংশ কদাকার প্রাণীর কিছু না কিছু বিশেষ অভিযোজিত ক্ষমতা থাকে। যেমন ব্লবফিশ বা ন্যাকেড মোল র্যাট খুব চরমবাবপন্ন পরিবেশে বাস করে। তারা অসাধারণ উপায়ে এই পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা এসব প্রাণী নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী। কারণ তাদের ধারণা এসব প্রাণীর জীববিজ্ঞান মানুষকে এমন সব নতুন তথ্য জানাতে পারে; যা ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের মতো মানুষের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় কাজে লাগতে পারে।
তবে অনেক কদাকার প্রাণী পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং যে বাস্তুতন্ত্রে বাস করে তাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তবুও এসব প্রাণী তুলনামূলকভাবে সুন্দর এবং আদুরে প্রাণীদের মতো মানুষের এত বেশি মনোযোগ পায় না। এর ফলে এসব অসুন্দর প্রাণী পক্ষপাতমূলক আচরণের শিকার হয়।
এমনকি গবেষণার বেলাতেও প্রায়ই কম আকর্ষণীয় প্রজাতিকে উপেক্ষা করা হয়।
এছাড়া সংস্কৃতিগত কিছু কারণেও আমরা কুৎসিত-সুন্দর প্রাণীদের প্রতি আকর্ষিত হই।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের রয়্যাল ভেটেরিনারি কলেজের কম্প্যানিয়ন অ্যানিমেল বিহেভিয়ার অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সায়েন্সের প্রভাষক রোয়েনা প্যাকার বলেন, 'কুৎসিত-সুন্দর কথাটি খুবই ফ্যাশনেবল। এটি আংশিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত।'
তিনি বলেন, 'অনেক সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালী আজকাল ইনস্টাগ্রামে পোষা পাগ ও ফ্রেঞ্চ বুলডগের ছবি দেন।'তবে বর্তমানের এই ট্রেন্ড নিয়ে কিছু গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে।
পশুচিকিত্সকরা মানুষদের ব্র্যাকিসেফালিক বা ফ্ল্যাট-ফেসড কুকুর পালন না করার আহ্বান জানাচ্ছেন। কারণ এসব কুকুর গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। পাগ এবং ফ্রেঞ্চ বুলডগ শ্বাসকষ্ট, বারবার ত্বকের সংক্রমণ এবং চোখের রোগে আক্রান্ত হয়।
২০২২ সালের এক সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, 'প্রতিবছর যুক্তরাজ্যের অন্যান্য কুকুরের জাতের তুলনায় পাগ কুকুরের রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় দ্বিগুণ।'
এমনকি গ্রীষ্মেও পাগ কুকুরেরা হিট-স্ট্রোকের ঝুঁকিতে থাকে।
প্যাকার বলেছেন, 'আপনারা দেখেছেন নেকড়েদের নাক খুব লম্বা। তারা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করা ও গ্রহণ করার তাপ বিনিময় করে, যার ফলে তাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে... তাই তারা আমাদের মতো ঘামে না। তবে পাগের নাক খুব ছোট এবং শ্বাসনালী সংকীর্ণ, যার ফলে বেশি গরমে তাদের শ্বাস নিতে এবং তাদের দেহকে শীতল করতে অসুবিধা হয়।'
প্যাকার আরও বলেন, ফলে অনেক পাগ নাক ডাকে বা নাক দিয়ে শব্দ করে। অথচ মানুষ এ ধরনের শব্দকে 'আদুরে' বা কুকুরের ডাক বলে মনে করে। কিন্তু এসব শব্দ আসলে তাদের শ্বাসনালীতে বাতাস চলাচলে বাধা পাওয়ার কারণে হয়।
নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা সত্ত্বেও পাগ মানুষের মাঝে খুব জনপ্রিয়।
রয়্যাল ভেটেরিনারি কলেজের তথ্যমতে, ২০০৫-২০১৭ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের জাতীয় কুকুর রেজিস্টার কেনেল ক্লাবে পাগ নিবন্ধনের সংখ্যা পাঁচগুণ বেড়েছে।
আমেরিকান কেনেল ক্লাব ২৮০টি নিবন্ধিত জাতের মধ্যে ৩৫তম জনপ্রিয় কুকুরের জাত হিসেবে পাগকে তালিকাভুক্ত করেছে।
অন্যদিকে, ফ্রেঞ্চ বুলডগ ও ব্র্যাকিসেফালিক ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো নিবন্ধনের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক জনপ্রিয় কুকুর হয়ে ওঠে।
প্যাকার বলেন, 'মানুষ পাগ পছন্দ করে কারণ এগুলো খুব বোকা ও অলস। মানুষ এসব কুকুরকে অন্য জাতের সঙ্গে প্রজনন করে পরিবর্তিত করতে চায়না। কারণ মানুষ ভাবে সংকর জাত এদের মতো এত 'অলস আদুরি' হবে না। মূলত এভাবেই আমরা তাদের রোগাগ্রস্ত করে রাখছি।
তিনি বলেন, অন্যান্য জাতের সঙ্গে ফ্ল্যাট-ফেসড কুকুরের ক্রসব্রিডিং করা 'সত্যিই প্রয়োজন'। কারণ 'শরীরের আকারের চরম ফেনোটাইপ থাকার পাশাপাশি এগুলোর জিনগত বৈচিত্র্যও খুব কম'।
জেনেটিক বৈচিত্র্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি ছাড়া ক্ষতিকারক বৈশিষ্ট্য এবং রোগ দ্রুত বংশবিস্তার করে এবং শেষ পর্যন্ত প্রাণীর ক্ষতি করতে পারে - বা এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে।
২০১৬ সালে ১০২ টি নিবন্ধিত ইংলিশ বুলডগের মধ্যকার একটিকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এর মা ও বাবা উভয় বংশানুক্রমিকেই তাদের জিনগত বৈচিত্র্য ছিল খুব কম।
প্যাকার বলেছেন, দিন দিন বুলডগগুলো 'তাদের মূল আকৃতির ব্যঙ্গচিত্র হয়ে উঠছে'।
তিনি বলেন, 'মানুষের কাছে এখন খুব বেশিরকম চামড়ায় ভাঁজওয়ালা কুকুরের খুব চাহিদা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এগুলো তাদের মেরুদণ্ডের হাড়ের বিকৃতির লক্ষণ। এতে বোঝা যায় তাদের কশেরুকা বিকৃত হয়ে গেছে, যার ফলে পুরো শরীর স্নায়বিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি