কানাডা যেভাবে বিশ্বের গাড়ি চুরির রাজধানী
কানাডার অন্টারিও প্রদেশের মিল্টন শহরের বাসিন্দা লোগান লাফারনিয়া। ২০২২ সালের অক্টোবরের এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন ঘরের পাশে তার গাড়িটি নেই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিকিউরিটি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ফুটেজ বের করেন। এতে দেখা যায়, হুড পরিহিত দুই ব্যক্তি গভীর রাতে তার গাড়িটি চুরি করেছে। চুরি হওয়ার বছর দেড়েক আগে গাড়িটি কিনেছিলেন তিনি। খবর বিবিসির।
এর কয়েক মাস ঘানার একটি ওয়েবসাইটে হুবহু তার নিজের গাড়ির মতো একটি গাড়ি নজরে আসে লোগানের। বিক্রয়ের জন্য ওয়েবসাইটে গাড়িটির বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সন্দেহ তৈরি হওয়ায় লোগান ওয়েবসাইটে দেওয়া গাড়ির প্রতিটি ছবিই বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করেন। পরে তার সন্দেহই সত্যি হয়।
লোগান তার গাড়ির চালকের আসনের পেছনে তার ছেলের ল্যাপটপ ঝুলিয়ে রাখার জন্য একটি হোল্ডার লাগিয়েছিলেন। ওই গাড়িতেও তিনি সেটি দেখতে পান। এতে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন যে এটি তারই গাড়ি।
তবে কানাডা থেকে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কিলোমিটার দূরে আফ্রিকার ঘানায় তার গাড়িটি কি করে পৌঁছাল, তা নিয়ে বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন লোগান।
২০২২ সালে কানাডায় এক লাখ পাঁচ হাজারেরও বেশি গাড়ি চুরি হয়েছিল। এর মধ্যে দেশটির ফেডারেল জাস্টিস মিনিস্টারের গাড়িও ছিল।
সম্প্রতি ইন্টারপোল গাড়ি চুরি হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ ১০টি দেশের মধ্যে কানাডাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুরি হওয়া গাড়িগুলো হয়ত কোনো অপরাধকর্মের জন্য ব্যবহৃত হয়, নয়তো কানাডাতেই অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কখনো কখনো বিক্রির জন্য জাহাজে করে দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ইন্টারপোল বলেছে, এটি ফেব্রুয়ারির পর থেকে বিশ্বজুড়ে দেড় হাজারেরও বেশি গাড়ি শনাক্ত করেছে, যেগুলো কানাডা থেকে চুরি হয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের বন্দর থেকে প্রতি সপ্তাহেই গড়ে অন্তত ২০০টি চুরি হওয়া গাড়ি শনাক্ত করা হচ্ছে।
কানাডায় গাড়ি চুরির ঘটনা এতটাই বেড়ে গেছে যে ইন্স্যুরেন্স ব্যুরো অব কানাডা এটিকে 'জাতীয় সংকট' বলে ঘোষণা করেছে।
এটি বলেছে, গাড়ি চুরি হওয়ার কারণে গত বছর বীমাকারীদের ১.৫ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার (১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পরিশোধ করতে হয়েছে।
এ সমস্যার কারণে কানাডার পুলিশ বাধ্য হয়ে গাড়ি চুরি ঠেকাতে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। এছাড়াও কিছু কানাডিয়ান ব্যক্তিগতভাবেও কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। যেমন- গাড়িতে ট্র্যাকিং প্রযুক্তি বসানো, বাড়ির চারপাশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো ইত্যাদি।
অন্টারিওর মিসিসাউগা শহরে বাস করেন নওমান খান নামে এক ব্যক্তি ও তার ভাই। তাদের দুটি গাড়ি চুরি হয়।
নওমান খানের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, টরন্টো অঞ্চলজুড়ে তিনি বহু মানুষের গাড়ি চুরির ঘটনা শুনেছেন। তার এক গ্রাহক ছিলেন। তার বাড়িতে এতবার চোর এসেছিল যে তিনি বাধ্য হয়ে বাড়ির বাইরে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দিয়েছিলেন।
ইউএস ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিস্টিক্স এর পরিচালক অ্যালেক্সিস পিকেরো বলেছেন, কানাডায় গাড়ি চুরির ব্যাপকতা বিস্ময়কর, যেখানে জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের চেয়ে অনেক কম।
করোনা মহামারির পর থেকে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ও যুক্তরাজ্যে গাড়ি চুরির ঘটনা বেড়েছে। দেশগুলোর সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে কানাডায় গাড়ি চুরির হার ২৬২.৫ এবং ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ২২০। আর ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী- যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে গাড়ি চুরির হার ছিল প্রায় ৩০০।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চুরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে করোনা মহামারিকে দায়ী করা হচ্ছে। কেননা, মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী গাড়ির ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে ব্যবহৃত ও নতুন উভয় ধরনের গাড়ির চাহিদাই বেড়ে যায়।
কানাডিয়ান অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের গভর্নমেন্ট রিলেশনের পরিচালক এলিয়ট সিলভারস্টেইন বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নির্দিষ্ট কিছু গাড়ির মডেলের বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে, যা চুরির হার বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং এটিকে সংগঠিত অপরাধ চক্রের জন্য আয়ের একটি লাভজনক উৎস করে তুলেছে।
তিনি বলেন, 'কানাডার বন্দর কার্যক্রম ব্যবস্থা যেভাবে পরিচালনা হয়ে থাকে, তাতে চুরির ঝুঁকি আরও বাড়ছে। কারণ বন্দর থেকে অন্য দেশে কি পাঠানো হচ্ছে, তার চেয়ে বন্দরে কী এল, সেটির ওপরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।'
এদিকে পুলিশ চুরি হওয়া অনেক গাড়ি গাড়ি উদ্ধার করতে পেরেছে। গত অক্টোবরে টরন্টো পুলিশ সার্ভিস জানায়, ১১ মাসের অনুসন্ধান শেষে তারা এক হাজার ৮০টি গাড়ি উদ্ধার করেছে। যেগুলোর মূল্য প্রায় ৬০ মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার।
সেই সঙ্গে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মার্চ পর্যন্ত সীমান্তরক্ষী ও পুলিশ কর্মকর্তারা ৪০০ শিপিং কনটেইনার তল্লাশির পর মন্ট্রিল বন্দর থেকে প্রায় ৬০০ চুরি হওয়া গাড়ি উদ্ধার করেন।
কানাডায় বন্দর কর্মীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কনটেইনার পরিদর্শনের ক্ষমতা নেই। শুল্ক-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কেবল সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশির জন্য কনটেইনার খুলতে পারেন।
গত মে মাসে কানাডা সরকার জানায়, কানাডার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শিপিং কনটেইনার তল্লাশির সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ বিনিয়োগ করবে। পুলিশকেও গাড়ি চুরি ঠেকাতে অতিরিক্ত অর্থ দেওয়া হবে।
তবে সিলভারস্টেইন বলেন, সবাই চুরি হওয়া গাড়ি উদ্ধারের বিষয়ে কথা বলছেন। তবে আমার কথা হলো চোরের জন্য গাড়ি চুরি করাটা যাতে খুব সহজ না হয়, সেই ব্যবস্থার দিকে বেশি নজর দেওয়া।
লোগান তার গাড়িটি চুরি হওয়ার পর আরেকটি গাড়ি কেনেন। সেই গাড়ি যাতে চুরি না হয়, সেজন্য তিনি গাড়িতে ইঞ্জিন ইমোবিলাইজার লাগান। সেইসঙ্গে তিনি গাড়িতে ট্যাগ ট্র্যাকারও (ট্র্যাকিং প্রযুক্তি) স্থাপন করেন।
উল্লেখ্য, ইঞ্জিন ইমোবিলাইজার এমন এক ধরনের যন্ত্র যেটি গাড়ির ইঞ্জিনে লাগানো হয়। এটি লাগানোর ফলে আসল চাবি ছাড়া গাড়িটির ইঞ্জিন কোনোভাবেই চালু করা সম্ভব হয় না।
দুই চোর লোগানের এ গাড়িটিও চুরি করতে এসেছিল। তারা গাড়িটির চাবির জন্য বাড়ির পেছনের একটি জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এতে শব্দে লোগানের ঘুম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুলিশে ফোন করেন। অবশ্য পুলিশ আসার আগেই চোরেরা পালিয়ে যায়।
পরে গাড়িটি বিক্রি করে দেন লোগান।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক