কোকা-কোলা যেভাবে গাজা ইস্যুতে বয়কট ঠেকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে
গাজায় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলের সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় কোকা-কোলা বয়কটের দাবি ওঠে। এতে করে নানা দেশে কোম্পানিটির পানীয়ের বিক্রি উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। বাংলাদেশেও যার ব্যতিক্রম ছিল না।
এমতাবস্থায় দেশের ছোট পর্দার অভিনেতাদের দিয়ে একটি ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন কন্টেন্ট তৈরি করা হয়। যেখানে অভিনেতা শরাফ আহমেদ জীবন একজন দোকানির চরিত্রে অভিনয় করেন।
বিজ্ঞাপনে বিক্রেতাকে বলতে শোনা যায়, কোকা-কোলা ইসরায়েলি পণ্য নয়। বরং সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে কোম্পানিটির সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এমনকি ফিলিস্তিনেও কোকের ফ্যাক্টরি রয়েছে বলে দাবি করা হয়। তবে বিজ্ঞাপনটি প্রচারের পর এমন সব দাবি বিপরীতে বেশ বিতর্কের তৈরি হয়।
প্রকৃতপক্ষে কোকা-কোলার ইসরায়েলি মালিকানাধীন বোতলজাত কোম্পানি পূর্ব জেরুজালেমে অবস্থিত। যে জায়গাটি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তেল আবিব দখল করে রেখেছে।
ফলে বিজ্ঞাপনে তথ্য বিকৃতভাবে তুলে ধরায় কোকা-কোলা ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। এক পর্যায়ে তীব্র চাপের মুখে টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় কোম্পানিটি।
বিতর্কের পর কোকা-কোলার প্রথম অফিসিয়াল বক্তব্যে ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে স্বীকার করা হয় যে, বিজ্ঞাপনটি করা কোম্পানিটির 'দুঃখজনক ভুল' ছিল।
কোকা-কোলার গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্কট লেইথ বলেন, "একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড হিসাবে আমরা অঞ্চলভিত্তিক ব্যবসা করার জন্য স্থানীয় ফ্র্যাঞ্চাইজির সাথে চুক্তি করি। আমরা স্বীকার করছি যে, সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনটি করা ঠিক হয়নি এবং আমরা এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।"
বিজ্ঞাপনটি এমন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে যখন কি-না গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে সমর্থন করছে। আর তাই বিশ্বব্যাপী ব্যাপক তোপের মুখে পরেছে মার্কিন কোম্পানিগুলো।
গত ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজা যুদ্ধে প্রায় ৩৯ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
একইসাথে চলমান সংকটময় পরিস্থিতিতে উপত্যকাটির কিছু অংশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের একচেটিয়া সমর্থনের জন্য বয়কট ইস্যুতে মার্কিন মেগাব্র্যান্ড কোকা-কোলা, ম্যাকডোনাল্ডস, স্টারবাকস ও কেএফসির বিক্রি কমে গিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে আয় কমে যাওয়ায় গত ফেব্রুয়ারি মাসে ম্যাকডোনাল্ডসের শেয়ারের মূল্য চার ভাগ কমে যায়। গত জানুয়ারি মাসে স্টারবাকসের ত্রৈমাসিক রিপোর্টে দেখা যায়, কোম্পানিটি আশানুরূপ আয় করতে পারেনি।
ইসরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন 'বয়কট, ডাইভেস্টমেন্ট এন্ড স্যাংশন'-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওমর বাঘউরি বলেন, "কোকা-কোলা বয়কটের অন্যতম কারন হচ্ছে ফ্রাঞ্চাইজিটির সেন্ট্রাল বোতলজাত কোম্পানিটি ইসরায়েল অধিকৃত গাজার আতারত ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে অবস্থিত।"
ফলে সহজভাবে ফিলিস্তিনি কারখানা বলে কোকের বিজ্ঞাপনে যেভাবে প্রচার করা হয়েছে সেটি বেশ সমস্যাযুক্ত। যাতে বাংলাদেশের মানুষ এবং সম্ভবত সব মুসলমানই খুব সহজেই সেটি মেনে নিতে পারেনি বলে মণে করেন ওমর। বরং এটিকে বেশ পুরনো উপায় ব্যবহার করে তৈরি প্রোপাগান্ডা হিসেবে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে কোকা-কোলার বেশ ভালো বাজার ছিল। সেক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে নির্মাণ করা বিজ্ঞাপনটিতে দাবি করা হয় যে, পানীয়টি ইসরায়েল থেকে আসে বলে যে দাবি করা হয় সেটি ভিত্তিহীন।
বিজ্ঞাপনে ইসরায়েলের নাম প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখ না করে বলা হয়, "শুনুন, কোক 'ওই জায়গা' থেকে একেবারেই আসে না। গত ১৩৮ বছর ধরে ১৯০টি দেশের মানুষ কোক পান করে আসছে। তুরস্ক, স্পেন ও দুবাইয়েও এটি পান করা হয়। এমনকি ফিলিস্তিনেও রয়েছে কোকের কারখানা।"
এরপরেই অনলাইন ও অফলাইনে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের লেখক ও সিনেমা নির্মাতা সাদিয়া ইসলাম বলেন, "বিজ্ঞাপনটি বয়কটকের প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনকি বিজ্ঞাপনের সাথে সংশ্লিষ্ট অভিনেতাদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়।"
যার মধ্যে একজন অভিনেয়া শিমুল প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। এদিকে বিজ্ঞাপনের আরেক অভিনেতা জীবন বিবৃতি প্রকাশ করে বলেন, "বিজ্ঞাপনটি ছিল তাদের 'পেশাদার কাজের' কেবল একটি অংশ। তিনি কোনোভাবেই ইসরায়েলকে সমর্থন করেননি এবং কখনও করবেনও না।"
বিজ্ঞাপনটি প্রচারের আগেই বাংলাদেশে কোকা-কোলা ফ্রাঞ্চাইজির বিক্রি ২৩ শতাংশ কমে যায়। সেক্ষেত্রে একটি ক্যাম্পেইন আকারে আরও বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন প্রচারের কথা থাকলেও সেটি আর কখনোই প্রচার করা হয়নি।
ডার্টমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্পোরেট কমিউনিকেশনের প্রফেসর পল আর্জেন্টি বলেন, "এই ধরনের সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে আপনার তথ্য সঠিক হতে হবে এবং আপনার যোগাযোগ নিরবিচ্ছিন্ন হতে হবে। ফলে বিজ্ঞাপনটি থেকে এমনটা প্রতীয়মান হয় যে, কোম্পানিটি ভেবেছিল তারা এই ধরণের কূটকৌশলের মাধ্যমে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারে।"
কোকা-কোলার বৈশ্বিক ব্যপকতা ও বিকেন্দ্রীকরণ ফ্রাঞ্চাইজির কথা মাথায় রেখেই পল আর্জেন্টি বলেন, "বিজ্ঞাপনটি দেখার সাথে সাথে কোকা-কোলা পানের জন্য মনস্থির করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। এমনকি ক্ষমা প্রার্থনার ক্ষেত্রেও তারা বেশ দেরি করেছে। এগুলি এমন ভুল যা কোকা-কোলার মতো বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।"
এদিকে কোকা-কোলার বিক্রি কমে যাওয়ায় কপাল খুলেছে স্থানীয় নানা বোতলজাত পানীয়ের। সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক উইল টোডম্যান বলেন, "মানুষ কোকা-কোলা পান থেকে সরে আসছে। জর্ডানে ম্যাট্রিকস কোলা ও সৌদি আরবে কিনজা পানীয়ের বিক্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। একমাত্র পর্যটকেরা কোকা-কোলা পান করছে।"
এমনকি কোকের থেকেও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করা পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো বয়কটের কবলে পরেছে। জর্ডানে সুপারমার্কেটগুলো স্থানীয় পণ্যগুলোকে আলাদা করে লেবেল করেছে; যাতে করে ইসরায়েলের সহযোগী বিকল্প বিদেশি পণ্যকে সহজে বয়কট করা যায়।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২ হাজার কর্মী ছাঁটাই করেছে স্টারবাকস। টডম্যান বলেন, "আমি মরক্কোতে স্টারবাকস ও ম্যাকডোনাল্ডসের ব্রাঞ্চগুলো অনেকটা ফাকা অবস্থায় দেখেছি।"
বয়কটের প্রতিক্রিয়ায় কোম্পানিগুলো গাজা যুদ্ধে কোনো পক্ষই অবলম্বন করেনি বলে নিজেরা দাবি করেছে। এমনকি বেশ কয়েকটি কোম্পানি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে।
যেমন, কাতার ও ওমানে ম্যাকডোনাল্ডস ফ্রাঞ্চাইজির পক্ষ থেকে গাজায় মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। যদিও বয়কট ইস্যু থেকে তারা খুব একটা রেহাই পায়নি।
টডম্যান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শক্তিশালী সম্পর্কযুক্ত যেকোনো কোম্পানিই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে ইসরায়েলকে রাজনৈতিক সমর্থন প্রদানের ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্ত এর মূল কারন।
টডম্যান বলেন, "আরব বিশ্বের বয়কট করা অনেক নাগরিকই কোম্পানিগুলোর সাথে ইসরায়েলের সঠিক সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নাও জানতে পারে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি, লোকেরা কোম্পানিগুলিকে বয়কট করছে কারন তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে। সেক্ষেত্রে তারা ইসরায়েলকে সমর্থনের জন্য মার্কিন বিরোধিতা করে।"