বলিভিয়ার যে আদিবাসীদের হৃৎপিণ্ড বয়সের তুলনায় বেশি সতেজ থাকে
বলিভিয়ার গহীন জঙ্গল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মার্টিনা কাঞ্চি। তার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি। তার গতির সাথে তাল মেলাতে না পেরে আমাদের টিম তাকে পথিমধ্যে থামতে বললেন। খবর বিবিসির।
পরিচয়পত্র থেকে দেখা যাচ্ছে মার্টিনার বয়স ৮৪ বছর। কিন্তু মাত্র ১০ মিনিটের মাঝেই তিনি শিকড় থেকে কন্দ বের করার জন্য তিনটি ইউকা গাছ কেটে ফেলেছেন। একইসাথে তার ছুরির মাত্র দুই কোপে অন্য একটি গাছও কেটে ফেলেছেন।
এরপর মার্টিনা পিঠে ফলের একটি বিশাল থলে ঝুলিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করলেন। একইসাথে সে ভুট্টা, কলা ও ধানও চাষ করে থাকেন।
মার্টিনা ১৬ হাজার চিমেনে সেমি-নোমাডিক আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম। এটি বলিভিয়ার বৃহত্তম শহর লা পাজ থেকে ৬০০ কিলোমিটার উত্তরে আমাজন রেইনফরেস্টের গভীরে বসবাসকারী একটি সম্প্রদায়।
বয়সের তুলনায় মার্টিনার শক্তিমত্তা দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং চিমেনে অধিবাসীদের মধ্যে এমনটা বেশ স্বাভাবিক।
বিজ্ঞানীদের মতে, গবেষণা করা হৃৎপিণ্ডের মধ্যে চিমেনে সম্প্রদায়ের হৃৎপিণ্ড সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। একইসাথে তাদের মস্তিষ্কের বার্ধক্যের প্রবণতা অন্যদের তুলনায় বেশ ধীরে হয়।
চিমেনে পৃথিবীর অল্প সংখ্যক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি যারা কি-না শিকার কিংবা কৃষিকাজের মাঝে সম্পূর্ণভাবে জীবনযাপন করে।
গোষ্ঠীটি একটি বিশাল বৈজ্ঞানিক নমুনা সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট বড় স্যাম্পল। এক্ষেত্রে নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী হিলার্ড কাপলানের নেতৃত্বে গবেষকরা দুই দশক ধরে তাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। চিমেনে সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত কাজের মধ্যেই থাকে। যার মধ্যে রয়েছে পশু শিকার, চাষাবাদ ইত্যাদি।
চিমেনে সম্প্রদায় দিনের ১০ ভাগেরও কম সময় বসে থেকে কাটায়। যেখানে শিল্পায়নের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষেদের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ ৫৪ ভাগ। তারা গড়ে আট ঘন্টারও বেশি সময় ধরে শিকার করে এবং ১৮ কিমি জায়গা জুড়ে বিচরণ করে।
চিমেনে সম্প্রদায় ম্যানিকুই নদীর ধারে বসবাস করে। যা পার্শ্ববর্তী শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে। ফলে তাদের নিকট প্রক্রিয়াজাতকরণ খাবার, অ্যালকোহল কিংবা সিগারেটের প্রাপ্তি খুবই কম।
গবেষণায় দেখা যায়, চিমেনে সম্প্রদায়ের খাবার উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধ ও ফ্যাটের পরিমাণ মাত্র ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খাবারে গড়ে এই পরিমাণ ৩৪ শতাংশ। একইসাথে সম্প্রদায়টির ক্যালোরির ৭২ ভাগ আসে শর্করা থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যার পরিমাণ ৫২ ভাগ।
এদিকে চিমেনে সম্প্রদায়ের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয় শিকার করা প্রাণী (পাখি, বানর, মাছ) থেকে। রান্নায় ক্ষেত্রে তারা ফ্রাই না করে সাধারণভাবে সিদ্ধ করে থাকে।
অধ্যাপক কাপলান ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তার সহকর্মী মাইকেল গুরভেনের প্রাথমিক কাজটি ছিল নৃতাত্ত্বিক। সেক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য করেছেন যে, চিমেনে সম্প্রদায়ের বয়স্ক লোকদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো বার্ধক্যজনিত রোগের লক্ষণ দেখায়নি।
তারপর ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মার্কিন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রান্ডাল সি থম্পসনের নেতৃত্বে একটি দল প্রাচীন মিশরীয়, ইনকা ও উনানগান সভ্যতার ১৩৭টি মমি সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে পরীক্ষা করে।
মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেহে চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য পদার্থের জমায়েত ধমনীকে ঘন বা শক্ত করতে পারে; যা এথেরোস্ক্লেরোসিস সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে তারা প্রাচীন ৪৭টি মমিতে এমন লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন। ফলে আধুনিক জীবনধারার কারণেই এই রোগগুলো সৃষ্টি হয় বলে যে অনুমান রয়েছে সেটিকে তা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
এরপর দুটি গবেষণা দল একই কাজে যোগ দেয় এবং ৪০ বছর বয়সের বেশি ৭০৫ জন চিমেনে সম্প্রদায়ের মানুষের সিটি স্ক্যান করে। এক্ষেত্রে তারা মূলত করোনারি আর্টারি ক্যালসিয়াম (সিএসি) খুঁজছিল; যা কি-না রক্তনালী আটকে থাকা এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকির লক্ষণ।
২০১৭ সালে দ্য ল্যানসেটে তাদের প্রথম প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, ৭৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ৬৫ ভাগেরই সিএসি নেই। একই বয়সের প্রায় ৮০ ভাগ মার্কিনীদের এই লক্ষণ রয়েছে।
কাপলান খুব সহজ ভাষায় এটিকে বর্ণনা করেছেন। বোঝার সুবিধার্থে তিনি বলেন, "৭৫ বছর বয়সি একজন চিমেনে ব্যক্তির আর্টারি ৫০ বছর বয়সি একজন মার্কিনীর আর্টারির মতো।
গবেষণার দ্বিতীয় ধাপ ২০২৩ সালে প্রসিডিংস অফ ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়। সেখানে দেখা যায়, যুক্তরাজ্য, জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলিতে একই বয়সের মানুষের তুলনায় বয়স্ক চিমেনেদের মস্তিষ্কের ক্ষয় ৭০ শতাংশ কম দেখা গেছে।
গবেষকদের মধ্যে একজন মেডিকেল কো-অর্ডিনেটর ড্যানিয়েল ইদ রদ্রিগেজ বলেন, "আমরা (চিমেনে সম্প্রদায়ে) প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার মধ্যে আল্জ্হেইমারের কোনো কেইস খুঁজে পাইনি।"
চিমেনেদের বয়স খুঁজে বের করা খুব একটা সহজ নয়। অনেকের ক্ষেত্রে এই জটিলতা দেখা যায়। কেননা তারা এলাকার খ্রিস্টান মিশনের রেকর্ড বা কতদিন ধরে একে অপরকে চেনে তার মাধ্যমে বয়স বিবেচনা করে থাকে।
ঐ রেকর্ড অনুসারে ৭৮ বছর বয়সি জুয়ান শিকারে যায়। তার চুল কালো, চোখ সজীব এবং হাত পেশীবহুল ও দৃঢ়।
তবে বয়সের ভারের কথা স্বীকার করেন জুয়ান। তিনি বলেন, "এখন সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হচ্ছে আমাদের শরীর। আমি এখন আর বেশিদূর হাঁটতে পারছি না।"
মার্টিনাও একই কথা বলেছেন। চিনেমে নারীরা বুননের জন্য একটি উদ্ভিদ জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করেন। এটি গভীর অরণ্যে জন্মে ও তা খুঁজে পেতে প্রায় তিন ঘন্টা হাঁটতে হয়। আবার সেগুলো কাঁধে নিয়ে একই সময়ে ফিরে আসতে হয়।
মার্টিনা বলেন, "আমি এই কাজ মাসে দুই-একবার করে থাকি। যদিও বর্তমানে আমার জন্য তা কষ্টকর হয়।"
যদিও বেশিরভাগ চিমেনে ব্যক্তিরা বয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যায়। গবেষণার শুরুতে তাদের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল ছিল ৪৫ বছর। এখন সেটি বেড়ে ৫০ বছর হয়েছে।
যে ক্লিনিকে স্ক্যান করা হয়েছে, সে ক্লিনিকের বয়স্ক নারীদের নিজেদের পরিবার সম্পর্কে নানা কথা জিজ্ঞাসা করেছেন চিকিৎসক ইদ।
এক্ষেত্রে এক নারী জানান, তার ছয়জন সন্তান ছিল যারমধ্যে পাঁচজন মারা গিয়েছে। অন্য একজন বলেন, তার ১২ জন সন্তান ছিল যাদের মধ্যে চারজন মারা গিয়েছে।
চিকিৎসক ইদ বলেন, "৮০ বছর বয়সে পৌঁছানো ব্যক্তিরা শৈশবে রোগবালাই ও ইনফেকশন থেকে বেঁচে গেছে।"
গবেষকদের মতে, প্রায় সকল চিমেনে ব্যক্তিরাই তাদের জীবদ্দশায় পরজীবী বা কৃমির মতো কিছু দ্বারা সংক্রমণের স্বীকার হন। তাদের দেহে উচ্চ মাত্রার প্যাথোজেন ও প্রদাহ খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ, তাদের দেহ ক্রমাগত সংক্রমণের সাথে লড়াই করছে।
তবে চিমেনেদের জীবনযাপনের ধরণ এখন কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। জুয়ান বলেন, "তিনি কয়েক মাস ধরে যথেষ্ট বড় প্রাণী শিকার করতে পারেননি। কেননা ২০২৩ সালের শেষের দিকে একের পর এক দাবানল প্রায় দুই মিলিয়ন হেক্টর জঙ্গল ও বন ধ্বংস করেছে। আগুন জঙ্গল থেকে প্রাণীদের বিপন্ন করেছে।"
জুয়ান এখন গবাদি পশু পালন শুরু করেছেন। তিনি আশা করেন এগুলো তার পরিবারের জন্য আমিষের চাহিদা মেটাবে।
চিকিৎসক ইদ জানান, চিমেনেরা বর্তমানে মোটরযুক্ত নৌকা ব্যবহার করছেন। যেটির মাধ্যমে তারা বাজারে গিয়ে চিনি, ময়দা ও তেলের মতো খাবার কিনতে পারছে।
বিশ বছর আগেও চিমেনেদের মধ্যে ডায়াবেটিসের কোনো ঘটনাই ছিল না। তবে এখন তা দেখা যাচ্ছে, একইসাথে তরুণ জনগোষ্ঠীর মাঝেও কোলেস্টেরলের মাত্রাও বাড়তে শুরু করেছে।
এদিকে গবেষকরা ২০ বছর ধরে সেখানে সংশ্লিষ্ট থাকায় প্রভাব পরেছে। ফলে চোখের ছানি অপারেশন থেকে শুরু করে ভাঙ্গা হাড় ও সাপের কামড়ের চিকিৎসার মতো স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পাচ্ছে।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান