মানব আয়ুর সর্বোচ্চ সীমায় কি পৌঁছে গিয়েছি আমরা?
বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ হিসেবে পরিচিত জিন কালমেন্টের বয়স ছিল ১২২ বছর। তবে অনেকের মনে এখন প্রশ্ন জাগতেই পারে, কালমেন্টের মতো আমাদেরও এতদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? নতুন একটি গবেষণা বলছে, এ সম্ভাবনা খুবই কম।
সোমবার (৭ অক্টোবর) 'নেচার অ্যাজিং' জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে জন্ম নেয়া মানুষের আয়ু সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে ।
গবেষকরা জানিয়েছেন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, সুইডেন এবং সুইজারল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে গড় আয়ু বৃদ্ধি পেলেও, সেই বৃদ্ধির হার ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। একমাত্র হংকং-ই এমন একটি দেশ, যেখানে গড় আয়ু বৃদ্ধির গতি অব্যাহত রয়েছে।
গবেষকরা বলছেন, কয়েক দশক ধরে চিকিৎসা ও প্রযুক্তির উন্নতিতে গড় আয়ু বাড়লেও, মানবজাতি সম্ভবত গড় আয়ুর সীমার কাছাকাছি পৌঁছাতে যাচ্ছে।
গবেষণার নেতৃত্ব দেয়া অধ্যাপক এস. জে. ওলশানস্কি বলেন, "আমরা মনে করছি বর্তমানের তুলনায় আমাদের গড় আয়ুষ্কাল হ্রাস পাবে"। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, গড় সর্বাধিক আয়ু ৮৭ বছরে সীমাবদ্ধ হবে—পুরুষদের জন্য ৮৪ এবং নারীদের জন্য ৯০ বছর।
এদিকে, প্রখ্যাত জনসংখ্যাবিদ জেমস ভাউপেল দাবি করছেন, একুশ শতকে জন্ম নেয়া অধিকাংশ শিশু ১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচবে।
তবে নতুন গবেষণার ফলাফল বলছে, এ ধারণা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম। গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন, তাদের বিশ্লেষণ করা স্থানগুলোতে ১০০ বছর পর্যন্ত জীবিত থাকা মানুষের সংখ্যা কমেছে; বরং, মানুষের মৃত্যুর বয়স সংকুচিত হয়ে এসেছে।
ড. ওলশানস্কি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করে এসেছেন যে, গড় আয়ু অবিরাম বৃদ্ধি পাবে না। ১৯৯০ সালে 'সায়েন্স' জার্নালে প্রকাশিত একটি পেপারে তিনি দাবি করেছিলেন, মানুষের গড় আয়ুর সীমা আসন্ন।
৩০ বছরেরও বেশি সময় পরে, তিনি বলেছেন যে তার নতুন গবেষণা তার পূর্ববর্তী তত্ত্বকেই সমর্থন করে। এমনকি যারা তার বিপক্ষে বাজি ধরেছিলেন, তারাও এই দাবিতে এখন সঙ্গতি খুঁজে পেয়েছেন।
ড. ওলশানস্কির সঙ্গে পূর্বে দ্বিমত পোষণ করা আলাবামা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক স্টিভেন অস্টাড, গবেষণাটিকে 'অত্যন্ত চমৎকার' উল্লেখ করে বলেন, 'এটি স্পষ্ট যে গড় আয়ু বৃদ্ধির হার কমে গেছে'।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মেডিসিন কলেজের জেনেটিক্সের অধ্যাপক জান ভিজিগও একমত, তিনি বলেন, "গবেষণাটি ভালোভাবে করা হয়েছে"। তিনি আরও বলেন, "ড. ওলশানস্কি সবসময় নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন, তবে এটি বাস্তবসম্মত।"
নতুন গবেষণাটি ইঙ্গিত দেয় যে, আধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি অনেকের জন্য ৭০, ৮০ এবং ৯০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে সহায়ক হলেও, গড় আয়ু এর থেকে আর বাড়ানো কঠিন হবে।
উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞানীরা হিসেব করেছেন যে, যদি ৫০ বছর বয়সের আগে সকল মৃত্যুর কারণও নির্মূল করা হয়, তবে গড় সর্বাধিক আয়ু মাত্র এক বছর বাড়বে নারীদের জন্য এবং পুরুষদের জন্য দেড় বছর।
ড. ওলশানস্কি বলেন, আমরা চিকিৎসা প্রযুক্তিতে উন্নতি, স্বাস্থ্যখাতের বৈষম্য হ্রাস এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রাকে উৎসাহিত করে হয়ত আয়ুষ্কাল কিছুটা বাড়াতে পারি।
তবে, তিনি যোগ করেন, সাধারণ রোগ বা দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুর ঘটনা নির্মূল হলেও, মানুষ বার্ধক্যের কারণেই মারা যাবে। "আমাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ও সিস্টেমের কার্যকারিতা হ্রাস পাচ্ছে, যা আমাদের শরীরগুলোর জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি দিন বাঁচা কার্যত অসম্ভব করে তোলে," ড. ওলশানস্কি বলেন।
কিছু বিশেষজ্ঞ এনিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। জাতীয় বার্ধক্য ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক পরিচালক ড. লুইজি ফেরুচ্চি মনে করেন, যদি পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে তবে আমরা গড় আয়ুর উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখতে পাব না। তিনি বলেন, "প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ করলে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে পারে।" তবে গড় আয়ুর সীমানা বাড়ানোর জন্য একটি মূল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি প্রয়োজন, যা বার্ধক্যকে ধীর করতে সক্ষম হবে।
মন্ট্রিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাদিন উলেট অন্য এক কারণে গবেষণাটির সঙ্গে একমত নন। তিনি বলেন, গড় আয়ু 'কখনও কখনও বিভ্রান্তিকর' হতে পারে, কারণ এটি প্রাথমিক জীবনের মৃত্যুর দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত হয়। তার পরিবর্তে, তিনি 'মোডাল এজ অফ ডেথ'—অর্থাৎ যেসময় অধিকাংশ মানুষ মারা যায়, সেই বয়সে নজর দেওয়ার সুপারিশ করেন।
ড. ওলশানস্কির মতে, মানুষের আয়ুষ্কাল উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর একমাত্র উপায় হলো বিজ্ঞানীরা যদি বার্ধক্য প্রক্রিয়াকে ধীর করার জন্য কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। এ বিষয়ে তিনি বেশ 'আশাবাদী' বলেও জানান।