‘আপাজান’: যেভাবে দিল্লির জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় এক জার্মান নারী নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন
দিল্লির একটি মুসলিম কবরস্থানের সমাধি যেন অন্য সবগুলোর থেকে আলাদা। সমাধিফলকে উর্দু ভাষায় খোদাই করা আছে 'গেরদা ফিলিপসবর্ন' নামের এক জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি নারীর নাম। এপিটাফে নামের নিচে দেয়া আরেকটি উপাধি— 'আপাজান'।
এই কবরস্থানে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের সমাধিও রয়েছে, যারা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সব সময়ই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছেন, ২০১৯ সালে মোদির বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল তারা।
শুরুতে একটু খটকা লাগতে পারে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িত জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের কবরস্থানে একজন জার্মান ইহুদি নারীর কবর কেন? কেনই বা নিজ দেশের মায়া ছেড়ে এক ভিনদেশে এসে থিতু হলেন তিনি?
'এর কারণ খুঁজে পাওয়া যায় বন্ধুত্ব এবং একজন নারীর জীবনের অর্থ খোঁজার মাঝে', বলছিলেন 'জামিয়া'স আপাজান: দ্য মেনি লাইফওয়ার্ল্ডস অফ গেরদা ফিলিপসবর্ন' বইয়ের লেখিকা মার্গ্রিট পেরনাও।
পেরনাও, যিনি এক দশক ধরে জামিয়া নিয়ে গবেষণা করেছেন, বলেন যে— গবেষণার সময় তিনি গেরদা ফিলিপসবর্নের নাম অনেকবার শুনেছেন, কিন্তু তার (ফিলিপসবর্ন) জীবন ছিল রহস্যে আবৃত। এখনও আজকের দিনে, অনেক শিক্ষার্থীই ফিলিপসবর্ন এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ে অবদানের বিষয়ে জানে না।
বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও ইতিহাসবিদ সৈয়দা হামিদ মনে করেন, ফিলিপবসবর্ন সম্পর্কে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা যাতে জানতে পারে সেজন্য তার লেখাগুলো অনুবাদ করে শিক্ষার্থীদের জন্য সহজলভ্য করা উচিত।
ফিলিপসবর্নের জার্মান মেমসাহেব থেকে জামিয়া'র আপাজান হয়ে ওঠার নৈপথ্যের কাহিনীর শুরু ১৯৩৩ সালে। বার্লিনে পড়াশুনা করতে গিয়েছিলেন— জাকির হুসেইন, মুহাম্মদ মুজীব এবং আবিদ হুসেইন। তাদের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে তার।
এই তিন ভারতীয় পুরুষই পরবর্তীতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হন এবং ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জাকির হুসেইন ১৯৬৭ সালে ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি হন।
১৯২০ ও ৩০-এর দশকের দিকে তিন পুরুষ এবং এক নারীর মধ্যকার প্লেটোনিক সম্পর্ক তো দূরের কথা, আন্তঃদেশীয় বন্ধুত্বের দেখা পাওয়াটাই বেশ দুষ্কর ছিল।
স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত এই তিন বন্ধু ফিলিপসবর্নের সঙ্গে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতেন, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা রাখবে এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা বলতেন তারা।
সেসময়ে ব্রিটিশ ভারতে খুব অল্প সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এবং সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল আরও কম।
তারা চেয়েছিলেন জামিয়া যেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান হয়, যেখানে মুসলিম ছেলে ও মেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে। পাশাপাশি, তারা চেয়েছিলেন এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে যাতে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে ঐক্য এবং মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা প্রচার করা যায়।
তাদের এসব পরিকল্পনা ফিলিপসবর্নের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ১৮৯৫ সালে একটি ধনী পরিবারে জন্ম নেওয়া ফিলিপসবর্ন যুদ্ধ, শিল্পবিপ্লব এবং বর্ণবিদ্বেষের এক ঢেউয়ের কারণে তার জীবন ও চারপাশের জগতকে বদলাতে দেখেছেন। তিনি বুঝতে পারতেন নিপীড়িত হওয়ার অনুভূতি, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং পরিবর্তনের অংশীদার হওয়ার ইচ্ছা কেমন হয়— লিখেছেন পেরনাও।
জামিয়া গড়ার জন্য তার বন্ধুরা বার্লিন ছেড়ে গেলে, ফিলিপসবর্নও তাদের অনুসরণ করে ভারতে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ব্যস্ত, আধুনিক বার্লিন ছেড়ে দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা এত সহজ ছিল না। পেরনাও জানান, জাকির হুসেইনও নাকি ফিলিপসবর্নকে ভারতে আসতে মানা করেছিলেন।
পেরনাও বলেন, 'তিনি ভারতে যোগ দেয়ার জন্য একাধিকবার জাকির হুসেইনকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রত্যেকবারই তাকে পরামর্শ ও সতর্কতা দিয়ে আসতে মানা করেন জাকির হুসেইন'।
'এদিকে, মুহাম্মদ মুজীব তখন চিন্তা করছিলেন কীভাবে তার মতো একজন অবিবাহিত তরুণী, এভাবে একা জামিয়ায় মানিয়ে নেবেন, যেখানে সেসময়ে বেশিরভাগ নারীরা তখন পর্দা পালন করতেন,' লিখেছেন পেরনাও।
কিন্তু তারপরেও ফিলিপসবর্ন ভারতে আসেন। কয়েক মাসের মধ্যেই, জামিয়ার মানুষদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্কুলে পড়াতেও শুরু করেন। সেখানকার অন্যান্য শিক্ষকদের মতো তিনিও ন্যূনতম বেতনে চাকরি করতেন এবং প্রতিষ্ঠানের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
শিশুদের একটি আবাসিক হোস্টেলের ওয়ার্ডেন নিযুক্ত হলে, তাদের সবার 'আপাজান' হয়ে ওঠেন তিনি। স্নেহ-মমতায় আগলে রাখতেন তাদের, যত্নের কোনো কমতি রাখতেন না।
পেরনাও বলেন, "যখন তার যত্নে থাকা ছোট শিশুরা অসুস্থ হতো, তিনি তাদের প্রতি এত মমতা দেখাতেন যে তারা মায়ের অভাব অনুভব করতো না"।
জামিয়ার মেয়ে এবং নারীদের সমাজে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে উৎসাহিত করতেন ফিলিপসবর্ন।
যখন তিনি জামিয়ার শিশুদের পত্রিকা 'পায়াম-এ-তালিম'-এর সম্পাদকীয় দলে যোগ দেন, তখন তিনি নারীদের শখ ও আগ্রহগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এমন নিবন্ধ লিখতেন যা মেয়েদেরও ওই পত্রিকার জন্য লেখার প্রতি উৎসাহিত করত।
শুধু জামিয়ার শিশুদের সঙ্গে কাজ করাই নয়, ফিলিপসবর্ন জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের তহবিল সংগ্রহে সাহায্য করতেন, বক্তৃতা প্রস্তুত করতে সহায়তা করতেন এবং প্রায়শই শিক্ষাদান ও রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তাদের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন। তার এই অবদানগুলো জামিয়ার নারীদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং প্রতিষ্ঠানটিকে আরও শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখে।
কিন্তু ভারতে আসার সাত বছর পর, তিনি একটি কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ভারতের জার্মান নাগরিক ব্রিটিশদের সন্দেহের চোখে থাকায়, ওই সময় অনেক জার্মানকেই ক্যাম্পে অমানবিক অবস্থায় বন্দী করে রাখা হয়।
১৯৪০ সালে ফিলিপসবর্নকেও এমন একটি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। বন্দী হওয়ার ফলে তিনি নিজের জীবনের জন্য ভীত হয়ে পড়েন, কারণ কর্তৃপক্ষ তাকে জার্মানিতে ফেরত পাঠাতে পারে, যেখানে হিটলার ইহুদিদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল। কিন্তু ক্যাম্পে থাকাকালীনও, তিনি সেখানকার মানুষদের সেবায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন, ছোট অনুষ্ঠান আয়োজন করে তাদের আনন্দ দেওয়ার এবং অসুস্থদের যত্ন নেয়ার চেষ্টা করতেন।
কিন্তু ক্যাম্পে নিয়ে আসার কয়েক মাস পর, ফিলিপসবর্নের পেটে আলসার হয়। তাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, পরে আবার ক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়, যেখানে তিনি এক বছর কাটান।
মুক্তির পর, তিনি জামিয়ায় ফিরে যান এবং তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু আলসারটি ক্যান্সারে পরিণত হওয়ায় আগের মতো আর পূর্ণ উদ্যোমে কাজ করতে পারছিলেন না, ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন।
তবে 'পায়াম-এ-তালিম' পত্রিকায় তখনও শিশুদের জন্য লেখা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি।
১৯৪৩ সালের এপ্রিলে ফিলিপসবর্ন মারা যান। জামিয়া পরিবারের কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে।
সৈয়দা হামিদ বলেন, "তিনি তার পরিবার থেকে অনেক দূরে মারা গেছেন, কিন্তু শেষ সময়ে তার ভালোবাসার মানুষজন তার পাশেই ছিলেন"।
জামিয়ার বারান্দায় 'আপা জান'-এর স্মৃতি এখনও বেঁচে আছে। সেখানে তার নামে একটি ছাত্রাবাস এবং শিশুদের জন্য একটি কেয়ার সেন্টার রয়েছে, যা তার স্নেহ ও ভালোবাসার স্মৃতিকে জীবন্ত রাখে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন