পাঁচ যুগান্তকারী আবিষ্কার যেগুলো নোবেল পুরস্কার পায়নি
আগামী সপ্তাহেই ঘোষণা করা হবে, এবার পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার কারা পাচ্ছেন। এর মাধ্যমে বিজ্ঞান জগতের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কের অধিকারীরা তাদের কাজের স্বীকৃতি পাবেন।
শতাব্দীর বেশ সময় আগে সুইডিশ শিল্পপতি আলফ্রেড নোবেল এ পুরস্কারের প্রচলন করেন। এর মাধ্যমে সেসব যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয় যেগুলো সম্পন্ন হতে কয়েক দশক সময় লাগতে পারে।
কে নোবেল জিতবেন, তা আগে থেকে ঠাহর করা কঠিন। শর্টলিস্ট ও মনোনয়নকারীদের নাম সবসময় গোপন রাখা হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নথিগুলো ৫০ বছর ধরে জনসাধারণের নজরের বাইরে রাখা হয়েছে।
তবে বিশ্বে এমন অনেক আবিষ্কার ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা আছে যেগুলো যুগান্তকারী হলেও নোবেল পুরস্কার পায়নি। চলুন জেনে আসা যাক সেরকম পাঁচটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা যেগুলো জীবন বদলে দেওয়ার মতো ভূমিকা রেখেছে কিংবা রাখতে পারতো।
মানুষের প্রথম জিনোম চিত্রায়ণ
নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল মানুষের জিনোমের চিত্রায়ণ। এ সাহসী প্রকল্পটি ১৯৯০ সালে শুরু হয়ে সম্পন্ন হয় ২০০৩ সালে।
মানুষের জীবনের জেনেটিক কোড উন্মোচন করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান এবং চীনের হাজারো গবেষকের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম কাজ করেছে।
এই উদ্যোগটি জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তবে ধারণা করা হয় এ প্রকল্পের সঙ্গে বিপুল সংখ্যক মানুষ জড়িত থাকায় এটি নোবেল পুরস্কার পায়নি।
১৮৯৫ সালের নোবেল উইল অনুসারে এ পুরস্কার সর্বোচ্চ তিনজন ব্যক্তিকে সম্মানিত করতে পারে।
স্থূলতার চিকিৎসায় বিপ্লব
গত কয়েক বছরে স্বাস্থ্যসেবার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে গ্লুকাগন লাইক পেপটাইড ১ (জিএলপি ১) নামে পরিচিত একটি হরমোনের অনুকরণকারী ওজন কমানোর ওষুধ।
বিশ্বের প্রতি আটজন মানুষের একজন স্থূলতায় ভুগছে। ১৯৯০ সালের পর থেকে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। এ ওষুধ রক্তে শর্করা কমিয়ে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্থূলতা চিকিৎসা ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মতো রোগের চিকিৎসায় এটি কার্যকর।
সভেতলানা ময়সোভ, ড. জোয়েল হ্যাবেনার এবং লোটে বিয়েরে নুডসেন নামে তিনি বিজ্ঞানী এ সেমাগ্লুটাইড নামে পরিচিত এই ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। তারা ২০২৪ সালে লাস্কার-ডিবাকি ক্লিনিক্যাল মেডিকেল রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। আর সাধারণত এ পুরস্কার যারা পান তারা নিশ্চিত ধরে নেন যে তারা নোবেলও পাবেন।
রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট এবং অ্যাসোসিয়েট রিসার্চ প্রফেসর ময়সোভ এবং হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের মেডিসিনের অধ্যাপক হ্যাবেনার জিএলপি ১ শনাক্ত ও এর সংশ্লেষণে সাহায্য করেন। নোভো নর্ডিস্কের গবেষণা ও প্রাথমিক উন্নয়নের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা নুডসেন এটিকে কার্যকর ওজন কমানোর ওষুধে পরিণত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
রূপান্তরে সক্ষম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নজিরবিহীন গতিতে মানুষের জীবন পরিবর্তন করছে।
এটি একটি ভীষণ প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র, তবে ক্লারিভেটের ইনস্টিটিউট ফর সায়েন্টিফিক ইনফরমেশনের গবেষণা বিশ্লেষণ বিভাগের প্রধান ডেভিড পেন্ডলবুরির মতে এ ক্ষেত্রে দুটি নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নোবেল-যোগ্য ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ সহকর্মীরা কতবার উদ্ধৃত করেছেন তা বিশ্লেষণ করে তাদের নির্বাচনে কাজ করেন পেন্ডলবুরি।
তার মতে সেই দুজন ব্যক্তি হলেন- ডেমিস হাসাবিস এবং জন জাম্পার। তারা দুজন গুগল ডিপমাইন্ডের আলফাফোল্ড প্রোটিন স্ট্রাকচার ডাটাবেসের উদ্ভাবক। এ ডাটাবেজ একটি এআই প্রোগ্রাম যা অ্যামিনো অ্যাসিড সিকোয়েন্স থেকে প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন উন্মোচন করে। বর্তমানে এ এআই বিশ্বের কমপক্ষে ২০ লাখ গবেষক ব্যবহার করছেন।
আলফাফোল্ড প্রোটিন গঠন নিয়ে 'গুগল সার্চের' মাধ্যমে কাজ করে। পরে প্রোটিনের আগের মডেলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রবেশ করে মৌলিক জীববিজ্ঞান এবং অন্যান্য সম্পর্কিত ক্ষেত্রে অগ্রগতি ত্বরান্বিত করে।
২০২১ সালে এই যুগান্তকারী প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এটি ১৩,০০০ বারেরও বেশি উদ্ধৃত হয়েছে।
জাম্পার এবং হাসাবিস ইতোমধ্যে ২০২৩ সালে লাস্কার এবং ব্রেকথ্রু পুরস্কার জিতেছেন। ভবিষ্যতে তারা রসায়নে নোবেল পেতে পারেন বলে জানান পেন্ডলবুরি। সেসময় তাদের সঙ্গে ডেভিড বেকার নামেও একজন গবেষক থাকতে পারেন। তিনি ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের প্রোটিন ডিজাইন ইনস্টিটিউটের পরিচালক এবং আলফাফোল্ডের ভিত্তি তৈরি করেছিলেন।
তবে নোবেল কমিটির মতো সাধারণত রক্ষণশীল সংস্থার জন্য এই ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদান করা কিছুটা অকাল হতে পারে বলে পেন্ডলবুরি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "কিছু লোক মনে করেন এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে খুব দ্রুত পুরস্কৃত করা জরুরি। কারণ এই কাজটি তুলনামূলকভাবে নতুন এবং এটি এআইয়ের বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রয়োগের সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্র।"
আন্ত্রিক মাইক্রোবায়োম সম্পর্কে বোঝাপড়া
আমাদের শরীরে আমরা একা নই। ট্রিলিয়ন সংখ্যক মাইক্রোব যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক মানবদেহের ভেতরে এবং উপরিভাগে বাস করে যা সম্মিলিতভাবে মানব মাইক্রোবায়োম নামে পরিচিত।
গত দুই দশকে জেনেটিক সিকোয়েন্সিংয়ে অগ্রগতির ফলে বিজ্ঞানীরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন যে এই মাইক্রোবগুলো কীভাবে কাজ করে, তারা কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বিশেষ করে অন্ত্রের মধ্যে মানব কোষের সাথে কীভাবে মিথস্ক্রিয়া করে।
পেন্ডলবুরি জানিয়েছেন, এই ক্ষেত্রটি দীর্ঘদিন ধরে নোবেল স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষমাণ।
সেন্ট লুইসে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রবার্ট জে. গ্লেজার ডিস্টিংগুইশড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. জেফ্রি গর্ডন এই ক্ষেত্রে একজন পথিকৃৎ।
গর্ডন মানুষের অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম এবং এটি কীভাবে মানব স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে তা বোঝার জন্য গবেষণায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ল্যাবে ইঁদুরের গবেষণা চালিয়ে এ যাত্রা শুরু করেন। তিনি এমন গবেষণায় নেতৃত্ব দেন যেখানে দেখায় যে অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম স্বাস্থ্যের অপুষ্টির জন্য ভূমিকা রাখে। এটি বিশ্বে ২০০ মিলিয়ন শিশুকে আক্রান্ত করেছে। তিনি অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য খাদ্যে বিষয়াবলিকে বিকশিত করেছেন।
ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী জিন
সত্তরের এর দশকে এসে বোঝা যায়, ক্যান্সারও কখনও কখনও পারিবারিকভাবে চলে আসে। তবে স্তন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এ প্রবণতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
মানুষ ও শিম্পাঞ্জির জেনেটিক পার্থক্য নিয়ে কাজ করা ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের মেডিসিন ও জেনোম বিষয়ের অধ্যাপক মেরি-ক্লেয়ার কিং এ বিষয়কে নতুন আঙ্গিকে দেখতে শুরু করেন।
১৭ বছরের চেষ্টায় মেরি-ক্লেয়ার কিং শনাক্ত করতে পারেন যে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারে বিআরসিএ ১ জিনের মিউটেশন দায়ী। তার এ আবিষ্কারের কারণে জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমে নারীদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে ঝুঁকি কমাতে বেশি বেশি স্ক্রিনিং এবং প্রতিরোধমূলক সার্জারির মতো পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হয়েছে।