'আমাদের ছেলে মারা গেছে, এখন তার শুক্রাণু ব্যবহার করে নাতি-নাতনি পেতে চাই'
হাসপাতালে সংরক্ষণ করে রাখা মারা যাওয়া সন্তানের শুক্রাণু সংগ্রহের অনুমতি পেতে প্রায় চার বছর আদালতে লড়াই করেছেন ভারতীয় এক দম্পতি। অবশেষে ওই শুক্রাণু দিয়ে সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের অনুমতি পেয়েছেন তারা। খবর বিবিসির।
ছেলে মারা গেলেও এ দম্পতি অন্তত নিজেদের নাতি-নাতনি দেখতে পারবেন বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।
মৃত ছেলের মা হারবির কৌর বিবিসিকে বলেন, 'আমাদের ভাগ্য বেশ খারাপ। আমরা আমাদের সন্তানকে হারিয়েছি। কিন্তু আদালতের পক্ষ থেকে আমরা বেশ মূল্যবান উপহার পেয়েছি। আমরা এখন আমাদের সন্তানকে ফিরে পাবো।'
হারবির কৌর ও তার স্বামী গুরবিন্দর সিং ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দিল্লীর গঙ্গা রাম হাসপাতালে পিটিশন দায়ের করেন। কেননা হাসপাতালটি তার মৃত সন্তানের ল্যাবে সংরক্ষণকৃত শুক্রাণু হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
দম্পতির ৩০ বছর বয়সী সন্তানের নাম ছিল প্রীত ইন্দার সিং। ২০২০ সালের জুনে তার রক্তে ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
গুরবিন্দর সিং বলেন, "কেমোথেরাপি শুরুর আগে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে শুক্রাণু সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ, চিকিৎসার ফলে তার শুক্রাণুর গুণমান বেশ বাজেভাবে প্রভাবিত হতে পারে।"
অবিবাহিত প্রীত ইন্দর চিকিৎসকদের এ পরামর্শে রাজি হন। ২০২০ সালের ২৭ জুন তার শুক্রাণু সংরক্ষণ করে ল্যাবে রাখা হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরই তিনি মারা যান।
ছেলের মৃত্যুর কয়েক মাস পর দম্পতি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে শুক্রাণু চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু হাসপাতাল সেটি দিতে অস্বীকার করলে ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
ষাটোর্ধ্ব ওই দম্পতি আদালতে জানান, তাদের ছেলের শুক্রাণু থেকে জন্মগ্রহণ করা যেকোনো বাচ্চাকেই তারা লালন-পালন করতে চান। একইসাথে তাদের দুই মেয়েও ওই শিশুর দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
গত সপ্তাহে বিচারপতি প্রতিভা সিং বলেন, "শুক্রাণুর মালিক সম্মতি দিলে ভারতীয় আইনে মরণোত্তর প্রজননের বিরুদ্ধে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।"
প্রতিভা সিং আরও বলেন, "পিতামাতাই (শুক্রাণুর) স্যাম্পল পাওয়ার অধিকারী ছিলেন। কেননা স্ত্রী বা সন্তানের অনুপস্থিতিতে তারা হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের অধীনে আইনি উত্তরাধিকার লাভ করেছেন।"
দম্পতি জানান, আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পেছনে তাদের যুক্তি ছিল উত্তরাধিকার রক্ষা করা। সেক্ষেত্রে এই আদেশ সন্তানের সাথে তাদের একটি সংযোগ রক্ষা করবে এবং তাদের পরিবারের নাম ধরে রাখবে।"
হারবির কৌর বলেন, "তিনি তার বোনদের ভালোবাসতেন। তার বন্ধুরাও তাকে বেশ ভালোবাসতেন। আমার ফোনের স্ক্রিনে তার ছবি দেওয়া। আমি প্রতিদিন সকালে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার দিন শুরু করি।"
হারবির কৌর জানান, পরিবারটি তার ছেলের শুক্রাণু ব্যবহার করে সন্তান জন্ম দিতে চাইছে। এক্ষেত্রে তার এক কন্যা সারোগেসি করতে রাজি হয়েছেন। তিনি বলেন, "আমরা এটা আমাদের পরিবারের মধ্যেই রাখতে চাই।"
ঘটনাটি যদিও বিরল তবে এমন নজির রয়েছে। আইনজীবী সুরুচি আগরওয়াল বিবিসিকে ২০১৮ সালের এমন একটি ঘটনার কথা জানান।
ভারতের পুনেতে ৪৮ বছর বয়সী এক নারী সন্তানের শুক্রাণু ব্যবহার করে সারোগেসির মাধ্যমে তার দুই নাতি-নাতনির জন্ম দিয়েছিলেন। ২৭ বছর বয়সে তার ছেলে জার্মানিতে ব্রেইন ক্যান্সারে মারা যান।
সুরুচি আগারওয়াল ২০১৯ সালের নিউ ইয়র্কের আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। যেখানে ২১ বছর বয়সি এক মিলিটারি ক্যাডেট মারা যাওয়ার পর তার মা ছেলের শুক্রাণু ব্যবহার করে নাতি-নাতনির জন্ম দেন।
বিচারক প্রতিভা সিং তার রায়ে বলেন, "বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে কোনো ঐকমত্য নেই।"
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, চেক প্রজাতন্ত্র ও অন্যান্য কিছু দেশে লিখিত সম্মতিতে মরণোত্তর প্রজননের অনুমতি দেওয়া হয়। আর অস্ট্রেলিয়াতে মৃত্যুর পর এক বছরের অপেক্ষার অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করে থাকে। যাতে করে নিজের আবেগকে স্থির করে পরিবার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
অন্যদিকে ইতালি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি ও স্লোভেনিয়ার মতো বেশ কয়েকটি দেশে মরণোত্তর প্রজনন নিষিদ্ধ। আর দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে এই সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা নেই৷
এমনকি যে-সব দেশে মরণোত্তর প্রজনন সংক্রান্ত আইন রয়েছে, সেখানেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহু স্বামী/স্ত্রী গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সংরক্ষণকৃত শুক্রাণু বা ডিম্বাণু ব্যবহার করতে চান।
আদালতে গঙ্গা রাম হাসপাতাল বলেছে যে, আইনতভাবে তারা কেবল শুক্রাণুর স্যাম্পল মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তির স্ত্রীকে দিতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, অবিবাহিত মৃত পুরুষের শুক্রাণুর নমুনা তার পিতামাতা বা আইনি উত্তরাধিকারীদের কাছে হস্তান্তর করার বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট আইন বা নির্দেশিকা নেই।
ভারত সরকারের পক্ষ থেকেও দম্পতিদের পিটিশনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়েছিল। সেখানে বলা হয়, দেশের সারোগেসির অনুমতি দেওয়া হয়েছে সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতি বা নারীকে সহায়তা করার জন্য। তবে নাতি/নাতনী যারা চায়, তাদের জন্য এই আইন করা হয়নি।
কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রীত ইন্দর অবিবাহিত ছিলেন। সেক্ষেত্রে ভারতীয় আইন অনুযায়ী অবিবাহিতদের সারোগেসি করার অনুমতি নেই। একইসাথে তার শুক্রাণু ব্যবহার করে তার পরিবার সন্তান জন্ম দিতে পারবেন কি-না সেই সম্পর্কে কোনো লিখিত সম্মতিও তিনি দিয়ে যাননি।
তবে দম্পতির আইনজীবী আগারওয়াল পাল্টা যুক্তি দেন যে, শুক্রাণু সংরক্ষণের সময়ই প্রীত ইন্দর জানতেন এটি আইভিএফের উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, এতে করে তার সারোগেসিতে সম্মতি ছিল না এমনটা বলা যাবে না।
আইনজীবী জানান, ফর্মে মোবাইল নম্বরের জায়গায় বাবা ও সন্তান উভয়েরই নম্বর ছিল। এটা থেকেও পরিবারের প্রতি সম্মতি বোঝা যায়। একইসাথে তার বাবাই শুক্রাণু সংরক্ষণের জন্য ল্যাবের অর্থ পরিশোধ করে আসছিলেন।
আইনজীবী আগারওয়ালের যুক্তিতে বিচারক সিং সন্তুষ্ট হয়ে রায় প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, "প্রীত ইন্দর বিবাহিত ছিলেন না। তার কোন সঙ্গীও ছিল না। তিনি সন্তানের জন্মদানের জন্য স্যাম্পল ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি মারা যাওয়ার পর পিতা-মাতাই মৃতের উত্তরাধিকারী। এক্ষেত্রে শুক্রাণুর নমুনাগুলি জেনেটিক উপাদান হওয়ায় এবং সম্পত্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় পিতামাতারাই এর অধিকারী।"
এক্ষেত্রে আদালত দম্পতিকে ছেলের শুক্রাণু সংগ্রহের ক্ষেত্রে পিতামাতাকে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। আদালতের এই রায়টিকে মিসেস কৌর একটি 'আশার আলো' হিসেবে অভিহিত করেছে।
কৌর বলেন, "আমি প্রতিদিন আমার সন্তানের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণের জন্য প্রার্থনা করেছি। এক্ষেত্রে চার বছর সময় পরে হলেও আমাদের প্রার্থনা কাজে লেগেছে।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান