৫০ বছরে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে ৭৩ শতাংশ: বৈশ্বিক পরিসংখ্যান
মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণে ক্রমান্বয়ে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টিকে 'বিপর্যয়কর' আখ্যা দিয়েছে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ-বিষয়ক দাতব্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (ডব্লিউডব্লিউএফ)। খবর বিবিসির
বৈশ্বিক বন্যপ্রাণী পরিসংখ্যানের একটি পর্যবেক্ষণ অনুসারে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চলের হাতি থেকে শুরু করে গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের হকসবিল কচ্ছপ পর্যন্ত; সব প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যাই ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর 'দ্য লিভিং প্লানেট রিপোর্ট'- শীর্ষক বিস্তৃত পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ৫০ বছরে বিশ্বের বন্য প্রাণীর সংখ্যা গড়ে ৭৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
ডব্লিউডব্লিউেএফের যুক্তরাজ্য প্রধান তানিয়া স্টিল বলেন, বন্য আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে অনেক বাস্তুসংস্থান ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমাজন থেকে প্রবাল প্রাচীর পর্যন্ত অনেক আবাসস্থল 'খুব বিপজ্জনক টিপিং পয়েন্টের দোরগোড়ায়' রয়েছে। উল্লেখ্য, টিপিং পয়েন্ট হলো প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসলীলা পরিমাপের মানদণ্ড। এই মানদণ্ডের অর্থ হলো, ঘটে যাওয়া পরিবর্তনকে পূর্বাবস্থায় আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।'
গত পাঁচ দশকে ৫ হাজারের বেশি পাখি, স্তন্যপায়ী, উভচর, সরীসৃপ ও মাছের সংখ্যা পরিবর্তনের ওপর ভিত্তি করে লিভিং প্ল্যানেট ইনডেক্সের এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
জানা যায়, দূষণ, খনি ও নাগরিক অস্থিরতাসহ অন্যান্য হুমকির কারণে বিশ্বের ৬০ শতাংশ অ্যামাজন নদীর গোলাপী ডলফিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
অবশ্য প্রজাতি সংরক্ষণের ইতিবাচক তথ্যও পাওয়া গেছে।
উদাহরণস্বরূপ- পূর্ব আফ্রিকার ভিরুঙ্গা পর্বতমালায় পাহাড়ি গরিলার একটি জাত ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে ডব্লিউডব্লিউএফ বলেছে, 'আবাসস্থল ব্যাপক ধ্বংসের প্রেক্ষাপটে এই বিচ্ছিন্ন সাফল্য যথেষ্ট নয়।'
রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুশাস্ত্রের অধ্যাপক টম অলিভার [তিনি এই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন] বলেছেন, এই তথ্যগুলো যখন অন্যান্য প্রাণীর তথ্যের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়, ভয়ানক চিত্র উঠে আসে। যেমন ধরুন- পোকা-মাকড় কমে যাওয়ার হার। সবমিলিয়ে আমরা বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির একটি শক্তিশালী ও উদ্বেগজনক ছবি খুঁজে পাচ্ছি।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আবাসস্থল কমে যাওয়া এবং ক্ষতি বন্যজীবনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এরপরে একে একে অতিরিক্ত শোষণ, আক্রমণাত্মক প্রজাতি, রোগ, জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ এর বিলুপ্তিতে প্রভাব ফেলে।
গবেষণার প্রধান লেখক ও ডব্লিউডব্লিউএফের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা মাইক ব্যারেট বলেন, মানুষের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে; 'বিশেষ করে যেভাবে আমরা আমাদের খাদ্য উৎপাদন ও ভোগ করি, তার ফলে ক্রমেই স্বাভাবিক আবাসস্থল হারাচ্ছি।'
প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, প্রকৃতি ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত বিশ্বকে অনিবার্য টিপিং পয়েন্টের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার একটি সম্ভাব্য 'শিকার' হলো আমাজন বনভূমি। এর ফলে আমাজন বন আর কার্বন ধরে রাখতে পারবে না এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন করতে পারবে না।
ব্যারেট বলেন, 'দয়া করে প্রকৃতি ধ্বংস নিয়ে শুধু দুঃখ প্রকাশ করেই বসে থাকবেন না। জেনে রাখুন এটি এখন মানব সভ্যতার জন্য একটি মৌলিক হুমকি এবং আমাদের এখনই কিছু করতে হবে।'
জুলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব জুলজির ভ্যালেন্টিনা মার্কনি বিবিসিকে বলেন, প্রাকৃতিক বিশ্ব একটি 'অনিশ্চিত অবস্থানে' রয়েছে। তবে বিশ্ব নেতাদের দ্রুত ও সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমে 'আমাদের এখনও এটিকে ইতিবাচক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে'।
অন্যদিকে, বিশ্ব নেতারা কলম্বিয়ায় জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সম্মেলনে প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের উপায় নিয়ে আলোচনা করার জন্য একত্র হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
প্রায় ২০০টি দেশ প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ২০২২ সালের জাতিসংঘের একটি যুগান্তকারী চুক্তিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে, যার মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ৩০% অংশকে প্রকৃতির জন্য সংরক্ষণ করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
যুক্তরাজ্য এই অঙ্গীকারনামায় সই করেছে।
দেশটির পররাষ্ট্র সচিব ঘোষণা করেছেন, জলবায়ু ইস্যু এবং প্রকৃতি ধ্বংস রোধ সরকারের নীতিনির্ধারণের মূল লক্ষ্য হতে পারে।
মিস স্টিল বলেন, এই প্রতিবেদন 'ঘুরে দাড়ানোর আহ্বান'।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'স্বাস্থ্যকর বাস্তুতন্ত্র আমাদের স্বাস্থ্য, সমৃদ্ধি ও সুস্থতার ভিত্তি।'
তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি না সাধারণ নাগরিকের কাঁধে এ সংক্রান্ত কোনো বোঝা চাপানো উচিত – এটি মূলত ব্যবসায়ী ও সরকারের দায়িত্ব।
মিস স্টিল বলেন, 'ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের ভূমি এবং আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান বন্য আবাসস্থলের যত্ন নিতে হবে।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি