ভেপিং কি আপনার জন্য খারাপ, এটি কি পরিবেশের ক্ষতি করে, আর কীভাবেই বা নিয়ম পাল্টাচ্ছে?
শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও পরিবেশের ক্ষতি কমাতে আগামী বছরের জুন থেকে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ডিসপোজেবল (একবার ব্যবহারযোগ্য) ভেপ নিষিদ্ধ করার কথা জানিয়েছে সরকার। এছাড়া স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড একই সিদ্ধান্ত নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর বিবিসির।
সাধারণ সিগারেটের বিকল্প হিসেবে আজকাল তরুণদের মধ্যে ইলেকট্রনিক সিগারেট (ই-সিগারেট) বা ভেপ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেকেই মনে করেন, এই ভেপ ধূমপানের অভ্যাস ছাড়তে সহায়ক।
ডিসপোজেবল ভেপ কেন পরিবেশর জন্য এত ক্ষতিকর?
ডিপার্টমেন্ট ফর এনভায়রনমেন্ট, ফুড অ্যান্ড রুরাল অ্যাফেয়ার্সের তথ্যমতে, গত বছর প্রতি সপ্তাহে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন ডিসপোজেবল ভেপ এখানে-সেখানে কিংবা সাধারণ বর্জ্যের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গৃহস্থালির বর্জ্যের মধ্যে ব্যাটারি ফেলে দেওয়ার কারণে প্রতি বছর বর্জ্য বহনকারী গাড়ি ও বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে শত শত আগুনের ঘটনা ঘটছে। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির মতো ভেপসেও সার্কিট বোর্ড থাকে। ব্যবহার শেষে তাই সঠিকভাবে সেটি বন্দোবস্ত না করে যদি ওভাবেই ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে তা থেকে একসময় কোবাল্ট ও তামার মতো বিষাক্ত উপাদান পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সরকারি তথ্যমতে, ২০২২ সালে যতগুলো ভেপ ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সব মিলিয়ে সেগুলোতে ৪০ টনেরও বেশি লিথিয়াম ছিল। যা পাঁচ হাজার বৈদ্যুতিক গাড়ি চালানোর জন্য যথেষ্ট।
আকার ও উৎপাদন প্রক্রিয়াগত কারণে এসব ভেপের পুনর্ব্যবহারও খুব একটা সহজ নয়।
ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড অ্যাসেসমেন্টের তথ্যমতে, ডিসপোজেবল ভেপ পুনর্ব্যবহারের উপযোগী করার মতো বড় পরিসরে কোনো ব্যবস্থা বা সুবিধা এখনও যুক্তরাজ্যে নেই।
ভেপ বিষয়ক নিয়মগুলো কীভাবে বদলাচ্ছে?
সরকার বলেছে, আগামী বছরের পহেলা জুন থেকে ডিজপোজেবল ভেপের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে। এর মধ্যে দিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের সময় দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা তাদের স্টকে থাকা ভেপগুলো বিক্রি করে শেষ করতে পারেন। ওয়েলসও ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারাও একই সময় থেকে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করবে। স্কটল্যান্ড ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের সরকারও এ পথে হাঁটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
গত জুলাই মাসে লেবার পার্টি বলেছিল-
- ভেপস ও অন্যান্য নিকোটিন পণ্যগুলো শিশুদের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য ব্র্যান্ডিং ও বিজ্ঞাপন বন্ধ এবং প্যাকেজিং ও প্রদর্শন নিয়ন্ত্রণ করবে;
- তামাক ও ভেপসের অবৈধ বিক্রয় প্রতিরোধে ট্রেডিং স্ট্যান্ডার্ডসকে আরও ক্ষমতা দেবে এবং
- দেশব্যাপী তামাক পণ্যের বিক্রয় ধীরে ধীরে বন্ধ করার জন্য ধাপে ধাপে ধূমপান নিষেধাজ্ঞা চালু করবে।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়েস স্ট্রিটিং জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের পর জন্ম নেওয়া কারো কাছে সিগারেট বিক্রি নিষিদ্ধ করার জন্য আলাদা আইন এ বছরের ক্রিসমাসের আগেই পার্লামেন্টে পেশ করা হবে। এর আগে কনজারভেটিভ সরকারও ভেপিং ও ধূমপান মোকাবিলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল।
ভেপিং কি আপনার জন্য ক্ষতিকর?
ই-সিগারেট বা ভেপ ধূমপানের মতো ক্ষতিকর না হলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যারা ধূমপান করেন না, তাদের ভেপিং শুরু করা উচিত নয়। চিকিৎসকরা বলেন, ভেপিং তরুণদের ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করতে পারে।
ই-সিগারেট বা ভেপে ব্যবহৃত তরল মিশ্রণের মধ্যে সামান্য পরিমাণ রাসায়নিক ও কখনো কখনো নিকোটিনও থাকে। এর স্বাস্থ্যগত প্রভাব বা ক্ষতি ভালোভাবে বোঝার জন্য এ নিয়ে আরও গবেষণা দরকার।গত বছরের ডিসেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পক্ষ থেকে বলা হয়, স্বাস্থ্যের ওপর ই-সিগারেট বা ভেপের বিরূপ প্রভাবের প্রমাণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
বর্তমানে অবৈধ ভেপে বাজার সয়লাব। আর এসবে অন্যান্য ক্ষতিকারক রাসায়নিক বা ওষুধ থাকার সম্ভাবনাও অনেক বেশি।
ধূমপানের চেয়ে ভেপিং কেন ভালো?
সিগারেটের মধ্যে তামাক ও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকে। যারা নিয়মিত ধূমপান করেন, তাদের মধ্যে অর্ধেক মানুষ গড়ে ১০ বছর কম বাঁচেন। আর এ কারণেই ধূমপায়ীদের ধূমপান থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়।
বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে ধূমপান বন্ধ করার জন্য অন্য যেকোনো পদ্ধতির চেয়ে ভেপ দ্বিগুণ কার্যকরী হতে পারে। তবে ভেপ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। তাই এটি কেবল প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীদের জন্য সুপারিশ করা হয়। যাতে করে তারা ধূমপানের ইচ্ছা হলে ভেপ দিয়ে তা নিবারণ করতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে ধূমপান থেকে বিরত থাকার অভ্যাস তৈরি করাই উদ্দেশ্য।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) বলছে, এ পদ্ধতিতে কয়েক হাজার লোকের ধূমপানের অভ্যাস বন্ধ করা গেছে।
কত সংখ্যক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ভেপ ব্যবহার করেন?
অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্সের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ইংল্যান্ডে ভেপ বা ই-সিগারেট ব্যবহারকারী লোকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫.১ মিলিয়ন। যাদের মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সি। প্রতিদিন ভেপ ব্যবহারকারী ১৬ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা প্রায় ৬ শতাংশ। আর মাঝে মাঝে ব্যবহার করা লোকের সংখ্যা ৪ শতাংশ।
দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, ইংল্যান্ডে নিয়মিত ধূমপায়ী না হওয়া সত্ত্বেও ভেপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখজনকভাবে বেড়েছে। যেখানে ২০২১ সালে এমন ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রতি ২০০ জনে একজন, সেখানে এখন এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রতি ২৮ জনে একজন। আর এদের মোট সংখ্যা এক মিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে।
শিশু-কিশোরদের ভেপ ব্যবহারের হার
আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে কারো কাছে নিকোটিনযুক্ত ভেপ বিক্রি অবৈধ। তারা যদি প্রাপ্তবয়স্ক কারো পক্ষেও কিনতে চায়, তবুও তাদের কাছে বিক্রি করা যাবে না। তা সত্ত্বেও শিশু-কিশোরদের ভেপ ব্যবহারের হার বেড়েছে। তাদের কাছে ভেপ ধূমপানের চেয়েও দ্বিগুণ মাত্রায় সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
গত বছরের এপ্রিলে দুই হাজার শিশুর ওপর করা এক অনলাইন সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভেপ ব্যবহারকারী প্রায় ৮ শতাংশের বয়স ১১ থেকে ১৭ বছর। ২০২০ সালে যা ছিল ৪ শতাংশ।
অন্য দেশে কি আইন
যুক্তরাষ্ট্র নির্দিষ্ট কিছু ই-সিগারেটে ভেপের কিছু ফ্লেভার নিষিদ্ধ করেছে।
অস্ট্রেলিয়ায় নিকোটিনযুক্ত ই-সিগারেট সাধারণত কেবল ওইসব ব্যক্তির কাছেই বিক্রি করা হয়, যারা ধূমপান ছাড়তে চান। তবে এজন্য তাদের অবশ্যই প্রেসক্রিপশন দেখাতে হয়। আর সেখানকার কোনো ফার্মেসিই ডিসপোজেবল ভেপ বিক্রি করে না।
এদিকে নিউজিল্যান্ড গত বছর বেশিরভাগ ডিসপোজেবল ভেপ ও কিশোরদের কাছে আকর্ষণী কিছু ফ্লেভার নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত ও ব্রাজিলও এ বিষয়ে কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে। নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে চীনও।
ডব্লিউএইচওর তথ্যমতে, বিশ্বের ৮৮টি দেশে ভেপ কেনার জন্য ন্যূনতম কোনো বয়স নির্ধারিত নেই। আর ৭৪টি দেশে ই-সিগারেট কেনার জন্য কোনো বিধি-বিধান নেই।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক