বৈদ্যুতিক গাড়ির বিশ্ববাজার দখলের দৌড়ে চীন কি এরমধ্যেই জিতে গেছে?
শেনঝেন থেকে ডংগুয়ান ও গুয়ানঝৌ পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে চলে গেছে চীনের মূল শিল্পাঞ্চলের বুক চিড়ে। যদি কিছুক্ষণ এই সড়কে চোখ রাখেন, দুনিয়ার তামাম ব্র্যান্ডের সব মডেলের গাড়িই দেখতে পাবেন। দেখবেন, দৈত্যাকৃতির ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যাংকার লরি পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছে টয়োটার সেডানগুলো। চকচকে মার্সিডিজ বা মেবাখে চড়ে যাচ্ছেন হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী। এরমধ্যে নিঃশব্দে ছুটে চলা টেসলার বৈদ্যুতিক গাড়ির দ্যুতিও চোখ কাড়বেই। ভক্সওয়াগনের বহুল ব্যবহৃত গলফ চুগ মডেলের কারও দেখবেন এই পথে অনেক। কিন্তু, দুনিয়ার চেনাশোনা এসব মডেলের কারের বাইরে অর্ধেক গাড়ি দেখবেন আপনার কাছে অপরিচিত। এই সড়কে চলা প্রতি দুটি গাড়ির মধ্যে একটির ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, বিচিত্র সব ডিজাইনের হেডলাইটওয়ালা অনেক গাড়ি বৈদ্যুতিক মোটরের শক্তিতে ছুটছে।
আসলে এই গাড়িগুলোই কব্জায় নিচ্ছে চীনের স্থানীয় বাজার। আর একদিন তারা পুরো পৃথিবীও দখল করবে।
চীনে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত গাড়ির ব্যবহার দিনকে দিন বাড়ছে, আর তাতে ক্ষতি হচ্ছে সুদূর দেশে (গাড়ি রপ্তানির উৎসে)। যেমন জার্মানিতে প্রথমবারের মতো তাদের কিছু কারখানায় তালা ঝোলানোর পরিকল্পনা করছে ভক্সওয়াগন। এতে বেকার হয়ে পড়বে হাজার হাজার কর্মী, কারণ চীনা গাড়ির সাথে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না জার্মান উদ্যোক্তারা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অটোমোবাইল মার্কেট– চীনের স্থানীয় বাজারের অংশীদারত্ব ক্রমশ হারাচ্ছে তারা।
কিন্তু, এতো সবে শুরুমাত্র। দুনিয়ার তামাম নামীদামী কার উৎপাদকদের (চীনের বাইরের) এখন খরচ আরও কমানোর অঙ্গীকার করতে হচ্ছে, সরকারের কাছেও ভর্তুকি ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন তাঁরা। একইসঙ্গে চাইছেন আমদানি করা (চীনা) গাড়ির ওপর বাড়তি শুল্কারোপ। ঠিক যেমনটা সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনয়ন (ইইউ) করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের গাড়ি উৎপাদকরা প্রচলিত অন্তর্দাহ ইঞ্জিনচালিত গাড়ি উৎপাদনে আস্থা রেখেই এই রেসে টিকে থাকতে চান। কিন্তু, পুরোনো এসব ধ্যানধারণা আর পদক্ষেপ কাজে দেবে না। এগুলোর লক্ষ্য যদিওবা স্থানীয় কর্মসংস্থান রক্ষা করাও হয়– তবুও এহেন প্রচেষ্টা ব্যর্থতাতেই পর্যব্যসিত হবে।
কারণ, এটা শুধু চীন বা বৈদ্যুতিক গাড়ির বিষয় নয়, বরং এদুয়ের সম্মিলন। অর্থাৎ, চীনের কম খরচে উৎপাদনের সাথে যুক্ত হয়েছে বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যাপক পরিমাণে উৎপাদনের দক্ষতা। স্থানীয় বাজার দখলের মাধ্যমেই বিশ্বকে জয় করার ভবিষ্যৎ সামনে এনেছে – দামে ভোক্তাবান্ধব এসব গাড়ি।
এক শতকের বেশি সময় ধরে বিশ্বের যেকোনো দেশের শিল্পোৎপাদনের প্রতীক হয়ে রয়েছে তাঁদের গাড়ি উৎপাদনের সক্ষমতা, এমনটা কেন– আগে তা বুঝতে হবে। এর অন্যতম কারণ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে গাড়ি উৎপাদন ও তাতে ব্যবহৃত প্রযুক্তি। ফলে প্রতিটি গাড়িকে বলা যায় আধুনিক অটোমোবাইল প্রকৌশলের এক একটি বিস্ময়। যার প্রতিটিতে সংযোজিত রয়েছে হাজারো যন্ত্রাংশ, উচ্চ সহনশীলতা ও পথের নানান চড়াই- উৎরাই মাথায় রেখেই টেকসইভাবে যেগুলো তৈরি করার পর সংযুক্ত করতে হয়। ক্রেতা যেন বহু বছর নিরাপদে গাড়িটি চালাতে পারেন– সেটিও নিশ্চিত করতে হয় বহু বছরের লদ্ধ অভিজ্ঞতা, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার মিশ্রণে। ঋতুর পরিবর্তনে প্রতিকূল বিভিন্ন আবহাওয়া পরিস্থিতি, পথের ঝাঁকুনি, চালকের অপটুতা বা যথাযথ মেরামত ছাড়া অত্যাধিক ব্যবহার হতে পারে– সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয় উৎপাদককে। যেহেতু গাড়ির বাজার-ও ব্যাপক প্রতিযোগিতাপূর্ণ। চলতি পথে গাড়ি যতই দেখি না আমরা, নেপথ্যের শিল্পটি কিন্তু এত সহজ না।
অন্তর্দাহ ইঞ্জিনের প্রচলিত এই গাড়ি শিল্পের বিপরীতে– ইভি বা বৈদ্যুতিক গাড়িকে বলা যেতে পারে মূলত 'ব্যাটারি অন হুইল' – রূপক হিসেবে বলা যায়, শিশুদের ছোট খেলনা গাড়িরই আরও বড় ও উন্নত সংস্করণ। এখানে মূল বিষয়টিই হচ্ছে, শক্তিশালী ও টেকসই ব্যাটারি উৎপাদন, যা কারিগরি কম বরং রাসায়নিক প্রক্রিয়া বেশি। আর তাই চীন না থাকলেও– ইভি পৃথিবীর অটোশিল্পের রূপান্তর একদিন না একদিন করতোই।
তবে রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদনে চীন অত্যন্ত পারদর্শী। এসব পণ্য ব্যাপক হারে উৎপাদন করতে হয়, যাতে প্রতি ইউনিটের দাম কম রাখা সম্ভব হয়। এসব শিল্প স্থাপনে দরকার হয় সস্তা সুদে বিপুল ঋণ বা পুঁজির, পরিচালন ব্যয় কম রাখা এবং কারিগরি জ্ঞানসমৃদ্ধ সুলভ শ্রমশক্তি।
এছাড়া, চীন সরকারের যে বিপুল ভর্তুকি দেশটির ইভি উৎপাদকরা পান– তা নিয়েও সঙ্গত কারণেই মনঃক্ষুণ্ণ বিদেশি প্রতিযোগীরা। যদিও এই ভর্তুকির সহায়তা না নিলেও চীনা উৎপাদকরা দুর্দান্ত প্রতিযোগী হিসেবেই থাকতো।
এই অবস্থায়, দুনিয়ার বাঘা বাঘা প্রতিষ্ঠিত গাড়ি উৎপাদকরা কী করতে পারে? সেক্ষেত্রে উপায় বেশকিছু আছে তাদের সামনে, কিন্তু তার কোনোটিই আখেরে ভালো নয়।
এরমধ্যে একটি হতে পারে চীনা গাড়ি আমদানিতে বড় অংকের শুল্কের বাধা। তাতে অবশ্য পাল্টা চীনের তরফ থেকেও একই পদক্ষেপ আসবে। ফলে এই বিষয়টি বিশ্ববাণিজ্যের বিকাশের জন্য মোটেও ইতিবাচক নয়। তাছাড়া, শুল্কবাধা কেবল একটি স্থানীয় বাজারকেই রক্ষা, যা হয়তো যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আমদানিকারকদের জন্য কাজ করতে পারে, কিন্তু জার্মানি, জাপান বা দ. কোরিয়ার মতো দেশে করবে না। কারণ, এসব শিল্পোন্নত দেশের রয়েছে আকর্ষণীয় রপ্তানি বাণিজ্য, যার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল তাদের অর্থনীতি। বিশ্বব্যাপী তাদের বাজারের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও সৌদি আরবের মতো দেশ, যাদের ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা ভালো হলেও– নেই নিজস্ব শক্তিশালী গাড়ি উৎপাদন শিল্প। ফলে এইসব দেশ গাড়ির ওপর শুল্কের বাধা একেবারেই মানবে না, আর চীনা গাড়ির ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক বাধা তারাও অনুসরণ করবে– এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টিকে অন্যভাবে মোকাবিলার চেষ্টা করছে, মার্কিন সরকার বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) এবং নতুন ব্যাটারি কারখানা স্থাপনে ভর্তুকি দিচ্ছে। এই সহায়তা শিল্পটিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, তবে প্রতিযোগীর উৎপাদন ব্যয় যেখানে যথেষ্টই কম – সেইক্ষেত্রে টিকে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। জো বাইডেনের এই উদ্যোগের সুবাদে এখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নতুন নতুন কারখানা চালু হচ্ছে– যা তাঁর শিল্পনীতির বিজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে, তবে পাঁচ বছর পর হয়তো এই নীতিকে এতোটা সঠিক বলে মনে হবে না।
আরেকটি ভুল পদক্ষেপ হতে পারে, বাজারকে ভিন্ন প্রযুক্তির দিকে চালিত করার প্রচেষ্টা। যেমন জাপানের টয়োটা হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল গবেষণায় খুবই জোর দিচ্ছে। তবে এই প্রযুক্তিটি আরও অনেক জটিল হওয়ায়– উৎপাদন ও বিপণনের বেলায় বেশি বাধার সম্মুখীন হবে। ফিল্ম ক্যামেরা থেকে শুরু করে শব্দগতির চেয়ে দ্রুত যাত্রীবাহী কনকর্ড বিমান– সবগুলো ক্ষেত্রেই দেখা গেছে প্রমাণিত, টেকসই ও তুলনামূলক কম জটিল প্রযুক্তিই বাজার প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে। ফলে অটোমোবাইল বাজারের রুপান্তর যখন ঘটবে বলেই জানা যাচ্ছে – তখন সেটাকে ভিন্নভাবে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা – আসলে আরও পিছিয়েই দেবে।
আরেকটি বিকল্প হচ্ছে, চীন থেকে কম দামে ব্যাটারি কিনে স্থানীয়ভাবেই ইভির অন্যান্য যন্ত্রাংশ উৎপাদনের মাধ্যমে তাতে ব্যাটারি সংযোজন। এইক্ষেত্রে গাড়িগুলোর আরামদায়কতা, পারফরম্যান্স ও নিরাপত্তা বাড়ানোর মতো ফিচারে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। কিছু স্থানীয় কর্মসংস্থান তাতে ধরে রাখা যেমন সম্ভব হবে, তেমনি প্রযুক্তিগত উন্নয়নও করা যাবে। তবে আখেরে এটাও খুব একটা ভালো বিষয় হবে না। স্থানীয় গাড়ির উৎপাদন যদি সংযোজন নির্ভর হয়েই পড়ে– তাহলে স্থানীয় খাতের কর্মীদের কর্মীদের কাজের সুযোগ সেভাবে বাড়বে না।