যেভাবে ইন্টেলের উত্থান, যেভাবে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে পতনের দ্বারপ্রান্তে
নানা সমস্যায় জর্জর প্রযুক্তি খাতের বিখ্যাত কোম্পানি ইন্টেল। ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই করেছে সেমিকন্ডাক্টর চিপ ও কম্পিউটার ডিভাইস উৎপাদনকারী কোম্পানিটি। সুবিধা করতে পারছে না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চিপ বিক্রির ক্ষেত্রে।
উৎপাদন দক্ষতায় পিছিয়ে পড়েছে ইন্টেল। মোবাইলফোন ও এআইয়ের জন্য ব্যবহৃত চিপের বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পিছিয়ে পড়েছে অনেকটাই।
এই অবস্থায় সমস্যাগ্রস্ত ইন্টেলের দায়িত্ব চেপেছে নতুন সিইও প্যাট গেলসিঙ্গারের কাঁধে।
একনজরে দেখে নেওয়া যাক ইন্টেলের উত্থান এবং একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের কারণে পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস
১৯৬৮: রবার্ট নয়েস ও গর্ডন মুরের হাত ধরে ইন্টেলের যাত্রা শুরু। ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারা ভ্যালিকে ফলবাগান থেকে সিলিকন ভ্যালি প্রযুক্তি কেন্দ্রে রূপান্তরিত করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তারা।
১৯৭১: ২,৩০০ সংবলিত বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত প্রোগ্রামেবল মাইক্রোপ্রসেসর ৪০০৪ নিয়ে আসে ইন্টেল। নির্দিষ্ট কার্যক্রম সম্পাদনের প্রোগ্রাম করা চিপগুলোর মধ্যে ছিল এগুলো। সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের ইতিহাসে এটি একটি মাইলফলক। এর হাত ধরেই সিপিইউগুলোর উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন হয়।
১৯৮১: ২৯,০০০ ট্রানজিস্টরযুক্ত ইন্টেলের ৮০৮৮ মাইক্রোপ্রসেসর আইবিএম পার্সোনাল কম্পিউটারের (পিসি) মস্তিষ্ক হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে শুরু হয় পিসির যুগ।
১৯৮২: দ্বিতীয় কোম্পানি হিসেবে ইন্টেল ৮০৮৬ মাইক্রোপ্রসেসর উৎপাদন করে অ্যাডভান্সড মাইক্রো ডিভাইসেস (এআমডি)। পরে এএমডির ইন্টেলের এক্স৮৬ চিপ ব্যবহারের অধিকার নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই চলে। আজকের দিনের অধিকাংশ পিসি ও সার্ভার চিপের ভিত্তি এই এক্স৮৬।
১৯৮৫: ডায়নামিক র্যান্ডম অ্যাক্সেস মেমোরির (ডিআরএম) বাজার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ইন্টেল, যা দিয়ে তারা প্রথমে পরিচিতি পায়। ডিআরএমের চাহিদা কমে যাওয়ায় তারা মাইক্রোপ্রসেসরে মনোযোগ দেয়।
১৯৮৫: অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে এ শিল্পে মন্দা দেখা দিলে কর্মীর সংখ্যা কমাতে শুরু করে ইন্টেল। ১৯৮০-র দশকের বাকি সময়ে কয়েক হাজার কর্মীকে চাকরিচ্যুত করে কোম্পানিটি।
১৯৮৭: অ্যান্ডি গ্রোভ ইন্টেলের তৃতীয় সিইও হন। চিপ বাজারে ব্যাপক মন্দার মধ্য দিয়ে কোম্পানিটি চালান তিনি। মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে ইন্টেল। অন্যদিকে এএমডি ও ন্যাশনাল সেমিকন্ডাক্টরের মতো প্রতিযোগীরা রীতিমতো সংগ্রাম করছিল।
১৯৯১: পিসির জন্য ইন্টেল তাদের চিপ নিয়ে 'ইন্টেল ইনসাইড' মার্কেটিং প্রচারণা শুরু করে। কোম্পানিটির টেলিভিশন বিজ্ঞাপনগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৯৩: পেন্টিয়াম মাইক্রোপ্রসেসর নিয়ে আসে ইন্টেল। ৩.১ মিলিয়ন ট্রানজিস্টর দিয়ে তৈরি এ প্রসেসর ৮০৮৮-এর চেয়ে ৩০০ গুণ দ্রুত কাজ করতে সক্ষম।
১৯৯৯: ইন্টেল ও উইন্ডোজ উৎপাদনকারী মাইক্রোসফট প্রথম দুই প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে মর্যাদাকর পুঁজিবাজার সূচক ডাউ জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ-এ অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৯৯: এনভিডিয়া তাদের প্রথম গ্রাফিকস প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) চালু করে। ২০০০-এর দশকে গেমিং ও মাল্টিমিডিয়া অ্যাপ্লিকেশনের আবির্ভাবে পিসি ও সার্ভারের গুরুত্বপূর্ণ ফিক্সচার হয়ে ওঠে এটি। ইন্টেলের উন্নয়ন কৌশলে সিপিইউয়ের ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়। ২০২০-এর দশকের এআই বিপ্লবে ইন্টেলের পিছিয়ে পড়ার কারণ এটি।
২০০০: ডট-কম-এর রমরমার হাত ধরে ইন্টেলের শেয়ারবাজার মূল্য রেকর্ড ৪৯৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। কম্পিউটার বিক্রি হুড়হুড় করে বেড়ে যাওয়ায় তার সুফল ঘরে তোলে ইন্টেল, মাইক্রোসফট, সিস্কো সিস্টেমস ও ডেল। তবে ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ইন্টেলের বাজারমূল্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসে।
২০০৭: আইফোন বাজারে নিয়ে আসে অ্যাপল। মোবাইল ফোনের রমরমা যুগ শুরু হওয়ায় এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এই সুযোগটা ইন্টেল নিতে পারেনি। সিইও পল ওটেলিনির অধীনে ইন্টেল আইফোন প্রসেসর উৎপাদনের একটি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে। কারণ, তারা মনে করেছিল আইফোনের প্রসেসর বানিয়ে খুব একটা লাভ করতে পারবে না। এ চুক্তি ভেস্তে যাওয়ার পর আর্ম হোল্ডিংসের নকশার ওপর ভিত্তি করে বানানো চিপ ব্যবহার করে অ্যাপল। আর্ম হোল্ডিংসের এ প্রযুক্তি এখন মোবাইল বাজারে আধিপত্য বিস্তার করেছে।
২০০৯: কয়েক দশকের আইনি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে এএমডিকে ১.২৫ বিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয় ইন্টেল।
২০১৩: বিনিয়োগকারীদের চাপের মুখে সিইওর পদ থেকে ইস্তফা দেন ওটেলিনি। সাবেক প্রধান অপারেটিং অফিসার ব্রায়ান ক্রজানিচ সিইও হন। তিনি পিসি ছাড়াও ডেটা সেন্টার বাজার ও অটোমোটিভ চিপে ব্যবসা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেন। এ উদ্দেশ্যে আলটেরা ও মোবিলআই অধিগ্রহণ করা হয়।
২০১৪-১৬: সিইও ক্রজানিচের অধীনে ইন্টেল পরবর্তী প্রজন্মের চিপের জন্য এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট লিথোগ্রাফি (ইউভি) প্রযুক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে পড়ে। ইন্টেলের ধারণা ছিল, এ প্রযুক্তি 'কখনও কাজ করবে না'। এই সিদ্ধান্ত ইন্টেলের ডিজাইন ও উৎপাদন ব্যবসাকে প্রায় পাঁচ বছর পিছিয়ে দেয়।
২০১৬: পিসি শিল্পের অন্যতম ভয়াবহ মন্দার মধ্যে ১২ কর্মী ছাঁটাই করে ইন্টেল।
২০১৭: আয়ের দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম চিপ প্রস্তুতকারক হিসেবে মার্কিন কোম্পানি ইন্টেলকে ছাড়িয়ে যায় স্যামসাং। মেমোরি বাজারে স্যামসাংয়ের দাম বেড়ে যাওয়ায় এই সাফল্য। অন্যদিকে তাইওয়ানের টিএসএমসির কাছে উৎপাদন প্রযুক্তির শীর্ষস্থান হারায় ইন্টেল। টিএসএমসি এখন বিশ্বের বৃহত্তম চুক্তিভিত্তিক চিপ প্রস্তুতকারক; তাদের গ্রাহকের মধ্যে অ্যাপলও রয়েছে।
২০১৮: উৎপাদনের সমস্যার কারণে পদত্যাগ করেন ক্রজানিচ। অন্তর্বর্তীকালীন সিইও হন প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা বব সোয়ান।
২০১৮: ওপেনএআইতে বিনিয়োগের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় ইন্টেল। সিইও সোয়ান ভেবেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে বাজারে উৎপাদনশীল এআই আসবে। ২০২৪ সালের মধ্যে ওপেনএআইয়ের বাজারমূল্য ইন্টেলকে ছাড়িয়ে যায়।
২০২০: মহামারীর সময় পিসি বিক্রি ভালো হওয়ায় ইন্টেলের বার্ষিক আয় ৭৭.৮৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। পরে এএমডি ও এনভিডিয়া তীব্র প্রতিযোগিতায় ফেলে দিলে ইন্টেলের আয় কমে যায়।
২০২০: এনভিডিয়া জিপিইউ জেনারেটিভ এআই প্রযুক্তির প্রধান চিপ হয়ে ওঠায় এনভিডিয়ার বাজারমূল্য ইন্টেলকে ছাড়িয়ে যায়।
২০২১: ইন্টেলের সিইও হন প্যাট গেলসিঙ্গার। বিনিয়োগকারীরা তাকে নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। উৎপাদন বিলম্ব ও বাজার হিস্যা হারানোর পর তারা ঘুরে দাঁড়াতে চাইছিলেন। যেসব কোম্পানি চিপ ডিজাইন করে কিন্তু উৎপাদন করে না, ইন্টেলকে তাদের সরবরাহকারীতে পরিণত করার লক্ষ্য নেন তিনি। তার আরেকটি লক্ষ্য ছিল ইন্টেলকে আরও প্রতিযোগিতাসক্ষম কোম্পানিতে পরিণত করা। তবে সেজন্য প্রয়োজন ছিল বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ। এতে কোম্পানিটির নগদ প্রবাহ ও মুনাফার মার্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০২১: অ্যারিজোনায় দুটি উৎপাদন কারখানা নির্মাণের জন্য ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করে ইন্টেল।
২০২২: সার্ভার সিপিইউ ও পিসি চিপের বাজারের বড় হিস্যা চলে যায় তুলনামূলক ছোট কোম্পানি এএমডির দখলে। এর ফলে ইন্টেলের বাজারমূল্য এএমডির চেয়ে কমে যায়। এর মাধ্যমে এনভিডিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে এএমডি।
২০২৪: চারটি মার্কিন রাজ্যে কারখানা নির্মাণ ও সম্প্রসারণের জন্য ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা ক্রএ ইন্টেল। মার্কিন চিপ উৎপাদনকে শক্তিশালী করতে সরকারের পক্ষ থেকে অনুদান ও ঋণ পাওয়ার পর এ ঘোষণা আসে।
২০২৪: সাড়ে ১৭ হাজারে কর্মী ছাঁটাই করেছে ইন্টেল। এছাড়া লভ্যাংশ স্থগিতের পাশাপাশি লোকসানি উৎপাদন ব্যবসাকে ঘুরে দাঁড় করানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।