রেলপথের অনুপ্রেরণায় টাইম জোনের উদ্ভাবন, আমেরিকাতেই ছিল ভিন্ন ১৪৪ টাইম জোন
রেলপথের উদ্ভাবন যেমন মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থাতে বড় পরিবর্তন এনেছিল, তেমনি এটি চিরকালের জন্য মানুষের সময়ের ধারণাকে বদলে দিয়েছিল।
১৮৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার রেলপথ কোম্পানিগুলো 'টাইম জোন'-এর ধারণা চালু করে। এটি মানুষের সময় পরিমাপের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনে।
টাইম জোন বা সময় অঞ্চল হলো পৃথিবীকে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করার একটি পদ্ধতি, যেখানে প্রতিটি অঞ্চল নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে থাকে। এটি মূলত গ্রিনউইচ মান সময় (জিএমটি) বা ইউনিভার্সাল টাইম (ইউটিসি) থেকে হিসাব করা হয়।
এর আগে, সময় সূর্যের অবস্থান অনুযায়ী নির্ধারিত হত এবং প্রতিটি শহরের সময় কিছুটা আলাদা ছিল। সূর্যঘড়ির পরিবর্তে যান্ত্রিক ঘড়ির ব্যবহার বাড়তে থাকলেও, শহরগুলো তখনো সূর্যের অবস্থান অনুযায়ী তাদের ঘড়ির সময় ঠিক করত।
এই পদ্ধতি ১৮০০-এর দশক পর্যন্ত চলেছিল। তখন উত্তর আমেরিকায় অন্তত ১৪৪টি ভিন্ন টাইম জোন ছিল।
যেহেতু অতীতে বেশিরভাগ মানুষ তাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে যেত না (সাধারণত ঘোড়া, উট বা গাড়ি যেখান পর্যন্ত যেতে পারত), তাই সময় হিসাবের এই সহজ পদ্ধতিটি তেমন সমস্যা সৃষ্টি করতো না। কিন্তু রেলপথের আবির্ভাবের পর এই পদ্ধতি আর চলেনি।
বাল্টিমোরের বি অ্যান্ড ও রেলপথ জাদুঘরের প্রধান কিউরেটর জন গোল্ডম্যান এর মতে, ১৮০০-এর মাঝামাঝি সময়ে যখন রেলপথ বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং রেলপথ প্যাসেঞ্জার ও মালবাহী যাত্রীদের দেশজুড়ে নিয়ে যেতে শুরু করে, তখন একটি সমন্বিত সময় হিসাবের পদ্ধতি তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা শুধু দক্ষতার ব্যাপার ছিল না, বরং এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও জরুরি ছিল।
তিনি বলেন, "বিভিন্ন স্থানীয় টাইম জোনের উপস্থিতি রেলপথের জন্য বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতে, মানুষ ট্রেন মিস করতে পারে; সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে, একটিমাত্র ট্র্যাক ব্যবহার করার কারণে ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়ে।"
প্রথম দিকে, যুক্তরাজ্যেও একই ধরনের সমস্যা হয়েছিল। রেলপথগুলো শহর এবং গ্রামগুলোকে একে অপরের সাথে আরও ভালোভাবে সংযুক্ত করতে শুরু করার পরেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে, স্টেশনগুলো স্থানীয় সময় অনুযায়ী অনেক ট্রেনের আগমণ ও ছেড়ে যাওয়ার সময় ঠিকমতো তালিকাভুক্ত করতে পারবে না।
১৮৪৭ সালে সমস্ত ব্রিটিশ রেলওয়ে একটি একক "রেলওয়ে সময়" গ্রহণ করেছিল। ১৮৮০ সালে এটি আনুষ্ঠানিক সময় হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং গ্রিনউইচ মান সময় (জিএমটি) নাম দেওয়া হয়। যুক্তরাজ্য প্রথম দেশ হিসেবে এমনটি করে।
জিএমটি হল গড় সময়। এটি পৃথিবীর মূল সমন্বিত সময় পদ্ধতি, যা গ্রিনউইচ অবজারভেটরির (গ্রেট ব্রিটেন) পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যরেখা (প্রাইম মেরিডিয়ান) থেকে মাপা হয়।
সময়ের মানকরণের ফলে যুক্তরাজ্যের রেলপথ আরও কার্যকর এবং নিরাপদ হয়ে ওঠে। এরপর, এই ধারণাটি উত্তর আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে, যুক্তরাজ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা পুরো মহাদেশে সময়ের মানকরণের প্রয়োজন ছিল।
১৮৭৯ সালে কানাডীয় প্রকৌশলী স্যার সানফোর্ড ফ্লেমিং একটি ট্রেন সময়মতো ধরতে না পারার পর টাইম জোন-এর ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন।
১৮৮৩ সালের ১৮ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার রেলওয়ে সংস্থা ফ্লেমিংয়ের ধারণা গ্রহণ করে। এরপর, পুরো উত্তর আমেরিকাকে পূর্ব, কেন্দ্রীয়, পাহাড়ি এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় নামে ৪টি প্রধান টাইম জোনে ভাগ করা হয়। এটি আজও ব্যবহার হচ্ছে।
জন গোল্ডম্যান বলেন, "নতুন একক টাইম জোন ব্যবস্থার ফলে রেলপথে দুর্ঘটনা অনেক কমে যায়।"
১৮৮৪ সালে ফ্লেমিং ওয়াশিংটন ডিসিতে আন্তর্জাতিক প্রাইম মেরিডিয়ান কনফারেন্স আয়োজন করতে সহায়তা করেন, যেখানে গ্রিনউইচ মেরিডিয়ানকে পৃথিবীর সর্বজনীন শূন্য দ্রাঘিমা হিসেবে এবং সময় হিসাব করার মানদন্ড হিসেবে নির্বাচন করা হয়।
উত্তর আমেরিকার স্থানীয় শহর ও গ্রামগুলো রেলপথের মাধ্যমে যে সমৃদ্ধি এবং সুযোগ আসে, তা দেখে নতুন অঞ্চলগুলো দ্রুত ট্রাইম জোন গ্রহণ করে।
তবে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিছুটা ধীরে গতিতে এগিয়ে গিয়ে ১৯১৮ সালে পুরোপুরি এই নতুন টাইম জোন গ্রহণ করে।