ফিরে আসা তার
লাইব্রেরির তালা খোলা হয়নি বহুকাল। ঢোকার আগে মরচে ধরা তালাটা ভেঙে ফেলতে হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে এই সম্পত্তি ব্যবহারের জন্য হস্তান্তর করা হলেও বিগত ডিসিদের কেউই এই ভাঙা জমিদারবাড়ি ব্যবহারের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
সে নিজে আগ বাড়িয়ে বহুবার মনে করিয়ে দিয়েছে; কাজ হয়নি কোনো। তার পর থেকে সে একা একাই আসে এখানে।
কালের কামড়ে ঝরঝরে হয়ে পড়া একদার কাছারিঘরটার বারান্দায় ঝুম ধরে বসে থাকে। আর বালিয়াটির ছোট জমিদার বাবু নবাকান্ত রায়কে দেখে কখনো দহলিজে, কখনো কাছারিঘরের বারান্দায়, কিংবা কখনো বাঁধানো দিঘির পৈঠায়, গম্ভীর হয়ে বসে আছে। কথা হয় না কোনো তাদের। কথা হওয়ার জোও নেই। মৃতেরা জীবিতের সঙ্গে কথা বলে না। আর সে-ও এ ব্যাপারে নিশ্চিত না যে জমিদারপুত্র নবাকান্তকে সে সত্যিই দেখে, না সবই সে কল্পনায় বানিয়ে নেয়। তবে একটা ব্যাপার বানানো না। একদম না। কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক, এটা সত্যি; জমিদার নবাকান্তের জন্য সে এ বাড়ি আসে না। সে আসে শুধু একটা আওয়াজের টানে। কখনো এ আওয়াজ শুধুই নূপুরের, আবার কখনো তা চুড়ির মিহি রিনিঝিনির।
অদ্ভুত সচল এ আওয়াজ, বেশির ভাগ সময়ই আসে ভিতর বাড়ি থেকে। প্রথম। তারপর ছড়িয়ে পড়ে। বাড়ির বিভিন্ন দিক থেকে আসতে শুরু করে। যেন মনে হয় চঞ্চল ত্রস্ত পায়ে কেউ ছোটাছুটি করছে পুরো বাড়িময়। তখনই ঝুমুর ঝুমুর করে বাজে পায়ের নূপুর!
সে কাছারিঘরসংলগ্ন পুরোনো লাইব্রেরি ঘরটার পৈঠার ধাপে বসে থাকে, উৎকর্ণ হয়ে। ক্ষণ গোনে, কখন আসবে! কিন্তু সব দিন সে আসে না। দীর্ঘ অপেক্ষায় থেকে কোনো কোনো দিন বিমর্ষ হয়ে ফিরে যায়, সেদিন বুকটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে যেন!
প্রথম যেদিন নবকান্ত রায়, এই নুপুরের নিক্বণ–এসবের ঘটনা ঘটল, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল সে। ঘোর লাগা ভূতগ্রস্ত এক মানুষের মতো ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে, বাড়ি ফিরে এসেই জ্বরে পড়ল। উথালপাতাল জ্বর। জ্বর নামল চার-পাঁচ দিন পর। তখনো তার বেঘোর অবস্থা।
আরও কদিন বিছানায় কাটল। তারপর দুবলা শরীর নিয়েই জোর করে উঠে দাঁড়াল সে। হাঁটাচলা শুরু করল। তারপর একদিন যেন অজান্তেই অদৃশ্য কোনো সুতার টানে পায়ে পায়ে এসে হাজির হয়ে গেল জমিদারবাড়িতে।
পুরোনো জায়গায় এসে বিব্রত, আর বিস্ময় নিয়ে ভাবে; কেন এসেছে সে? এ আকর্ষণ কিসের! কিসের এই অমোঘ টান! নেশার মতো ছুটে আসা!
ব্যাখ্যা নেই।
দিন যায়।
আর যেন কোনো ভয়ডর নেই তার। জমিদারপুত্র নবাকান্ত রায় তাকে দেখে কি দেখে না, এসব ভেবে সে আর বিচলিত হয় না। আর নূপুরের নিক্বণও এখন আর তাকে চমকে দিয়ে হারিয়ে যায় না, পালিয়ে যায় না নিমেষেই। বরং তার চারপাশ দিয়েই পরিচিত ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে নিঃশঙ্ক হেঁটে যায় সে, অশরীরী এক। কখনো কখনো নিশ্বাস ফেলার মতো তার একেবারে কানের কাছে এসেও খিলখিল করে হাসে। তার হাসি প্রতিধ্বনিত হয় নীরব জমিদারবাড়ির জনহীন মাঠ, দহলিজে, শূন্য ঘরে থেকে ঘরে। কিন্তু অশরীরী থেকে ওই নিক্বণী কখনোই অবয়ব নিয়ে হাজির হয় না। সে আশায় থাকে। একদিন সশরীরে আসবে সে। এ আশায় আশায় তার অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। কিন্তু হাল ছাড়ে না সে। ভাবে নবাকান্তের মতো এ-ও একদিন শরীর ধারণ করে তার সামনে মানুষরূপে এসে দাঁড়াবে! চমকে দেবে।
নতুন ডিসিকে বলেকয়ে, লাইব্রেরিঘরের বইপত্রগুলো পরখ করে দেখার অনুমতি পেয়েছে সে। মায়, ঠিক হয়েছে ভালো মূল্যবান কোনো সংগ্রহ তার চোখে পড়লে সে জানাবে। প্রয়োজনে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে জেলা প্রশাসন।
দুরু দুরু বুকে ধূলিধূসর লাইব্রেরির ভেতরে ঢোকে সে। আর তার পর থেকেই দুনিয়া আরেক দফা ওলটপালট হয়ে যায় তার। প্রতিদিন নিজের মধ্যে আত্মস্থ, ভূতগ্রস্তের মতো সে ফিরে ফিরে যায়। সব নাওয়া-খাওয়া ভুলে, দিনের কোনো কিছুই আর তার নিয়মে থাকে না।
এক রাতে মোটা জীর্ণ এক বইয়ের ভেতর থেকে টুক করে তার পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ল এক টুকরো কাগজ। ঝুঁকে কাগজটা তুলে নিয়ে সে দেখল, একটা চিঠি। পুরোনো, তুলট কাগজের মতো কোনো কাগজে লেখা কারও চিঠি। আসল রং হারিয়ে কবেই বিবর্ণ, হলুদ।
কত পুরোনো? নবাকান্তের সময়ের? না আরও আগের?
গোটা গোটা অক্ষর! কোনো মেয়ের হাতের লেখা বুঝি! ঠাহর করে সে। চিঠির একেবারে নিচের দিকে আলতা দিয়ে প্রায় অস্পষ্ট টিপসইয়ের মতো একটা ছাপ। কোন আঙুলের, বোঝার উপায় নেই। লাল আলতার রং বহু আগেই শুকিয়ে রক্তের মতো কালচে হয়ে গেছে। অবশ্য আলতাই কি না, তাই বা নিশ্চিত করে বলে কীভাবে!
দিন যায়। লাইব্রেরির ধুলোমাখা তাকে, নানা বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে আরও চিঠি খুঁজে পেতে শুরু করে সে। পুরোনো হলদে খামে ভরা চিঠি। কোনো দিন তা পোস্ট করা হয়নি প্রাপককে। লেখা হয়েছে কিন্তু প্রাপকের কাছে পৌঁছায়নি কখনোই।
যত্ন করে চিঠিগুলো বাড়ি নিয়ে এল। কোনো এক নারীর আবেগমথিত চিঠি তার দয়িতকে লেখা। এ চিঠি নিয়ে কী করবে সে! ভেবে পেল না।
সে জানে, এ চিঠির জন্য এখন আর কেউ অপেক্ষা করে নেই, এসব চিঠির মালিক বা যাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, দুজনের কেউই আর বেঁচে নেই। কোনো ঠিকানাতেও এ চিঠি আর পাঠানোর নয়!
এসব এখন এক একটা মৃত চিঠি।
চিঠিগুলো পড়া শুরু করে সে চমকায়, ভীষণরকম। চিঠি যেন কথা বলছে তার সঙ্গে। পড়তে গিয়ে মনে হয় এ চিঠি যেন তাকেই লেখা!
চিঠিগুলো আর লাইব্রেরিতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল না সে, অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছিঁড়ে নষ্টও করল না। বরং পুরোপুরি নিজের করে নেওয়ার পরিকল্পনায় নিশ্চিত, গোপনে এক সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিল।
প্রতি রাতে একটা করে চিঠি খামে ভরে, গায়ে নতুন ডাকটিকিট লাগিয়ে অফিসে যাওয়ার পথে ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে যায় সে।
এরপর প্রতিদিন ডাকপিয়ন তার জন্য চিঠি নিয়ে আসে!
এই অর্থহীন খেলায় অদ্ভুত এক মজা পেতে শুরু করল সে। পিয়ন চিঠি দিতে কখনো এক-দুই দিন দেরি করলে তার ছটফট শুরু হয়ে যায়। একই চিঠি বারবার পড়ে। বিছানায় শুয়ে, চেয়ারে বসে।
দিন গড়ায়।
জীবন বদলায়, একদিন তার কর্মস্থলও বদলায়। কিন্তু তার ক্ষেত্রে এই বদল একটু বেশিই দ্রুত ঘটে। অনেক কিছুই ওলটপালট হয়ে যায় সে ঝড়ে।
ঢাকা ফিরে আসে। দুমাসের মধ্যেই ওএসডি। এক অসহণীয় অবস্থা। তার জন্য নির্দিষ্ট কোনো অফিস নেই। কাজ নেই। এ দলে আরও কয়েকজন আছেন। সিনিয়র। সরকার তাদের ওপর বিরাগভাজন। রুষ্ট। অভিযোগ–তারা আগের সরকারের প্রতি অতি অনুগত ছিলেন, এ রকম কানাঘুষা শোনে।
কিন্তু তার বেলায় কেন এমন হলো? তার চাকরির বয়স দশও পার হয়নি। জিজ্ঞেস করে কোনো উত্তর মেলেনি। অপমানটা বড় তীব্র। চার মাসের মাথায় সে এই ভাসমান অবস্থার ইতি টানল। নিজেই ইস্তফা দিল চাকরিতে। এ রকম ঘটে না। সহকর্মীদের কেউ কেউ তাকে বোঝাতে চাইল: অপেক্ষা করো, সময় বদলাবে। ঝিম মেরে পড়ে থাকো।
হ্যাঁ, ঝিম মেরেই পড়ে থাকে সে এখনও, সাত বছর আগের সেই ঝড় তাকে একেবারে ধস্ত, আর নিরাসক্ত এক মানুষে পরিণত করে দিয়ে গেছে। চাকরি ছাড়ার পর সরকারি বাসা ছাড়া হয়েছে। ঢাকার কয়েক জায়গায় কিছুদিন ভাসমান অবস্থা পার করে এখন তার ডেরা বলতে এক দেড় তলার চিলেকোঠা। পুরান ঢাকার হেমেন্দ্র দাস লেন। ছোট এ চিলেকোঠায় দিনমান কাটে তার ঝিম মেরে পড়ে থেকেই। মাসকবারি কিছু আইএনজিওর খেপ মারে। ঘরে বসেই কাজ। ছোটাছুটি নেই। নির্দিষ্ট কোনো অফিস টাইম নেই। বেশির ভাগই অনুবাদের আর কিছু রিপোর্ট লেখার কাজ। তাতে যা পায়, চলে যায় ভালোই। লোকজন, বন্ধুবান্ধব কেউ নেই তার–কারও সঙ্গেই কোনো মেলামেশা নাই। শুধু প্রায় প্রতিদিন নীলক্ষেত যায় সে নিয়ম করে। ঘুরে বেভুল। পুরোনো বইয়ের দোকান, চায়ের ঠেক, এই বই, সেই বই–এই করে বইই এখন তার সঙ্গী। আর ওই এক তাড়া গোপন চিঠি।
আজ দিনটা অন্য রকম।
একটা অদ্ভুত ঘটনা অনেক দিন পর তার আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে। আজকে বুকপকেটে করে একটা চিঠি নিয়ে বের হয়েছে সে। চিঠিটা এসেছে গতকাল। ডাকপিয়ন নিয়ে এসেছে। এটা তার চিঠির তাড়ার সে রকম কোনো চিঠি না। জমিদারবাড়িতে পাওয়া সেই চিঠির কোনোটা না।
মুখবন্ধ একটা খাম। এটা পাওয়ার পর থেকেই এক বিস্ময় আর ঘোরের মধ্যে আছে সে। আজও নীলক্ষেতে এসেছে, কিন্তু এলেও বইপত্র কিছুই দেখতে ইচ্ছে করল না তার। গলির এক মাথা দিয়ে ঢুকে আরেক মাথা দিয়ে বের হয়ে এল।
মোড়ের তেঁতুলতলায় এসে ঘড়ি দেখল। আজ ফুটের রশীদ মিয়ার দোকানেও দাঁড়াল না। রশীদ মিয়ার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। দাঁড়াল না দেখে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সে।
হাতের ঘড়ির দিকে তাকাল। মোবাইল ফোনেই ঘড়ির কাজ চলে এখন সবার। কিন্তু সে এখনো ঘড়ি পরে, সময় ঘড়িতেই দেখে। সাড়ে চার বাজে।
চিঠিতে দেওয়া সময় ৬টা। মাথায় নাড়াচাড়া চলল এই সময় নিয়ে। ৬টা। তখন কী?
রাস্তাঘাট আজ ফাঁকা। কারফিউ উঠেছে। কিন্তু চারদিক থমথমে। দেশে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। অনেক তরুণ-কিশোর রাস্তায় নেমেছে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে প্রায় রোজই। এ রকম দিন কেউ কখনো দেখেনি। তার দমবন্ধ লাগে। আজ তার রাজু ভাস্কর্যে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। ভেবেছিল ছেলেদের সঙ্গে সে-ও যোগ দেবে! এতো মৃত্যু!
কিন্তু বদ্ধ খামের চিঠিটা এসে তাকে এক বেভুল-ঘোরগ্রস্ত মানুষ বানিয়ে দিল যেন, অযাচিত কত প্রশ্ন! জটিল একেকটা ধাঁধামতো মাথায় শুধু ঘুরছে।
তেঁতুলতলার মুরগি বিরিয়ানি-হালিমের ছোট্ট খুপরি দোকানটাতে ঢুকল সে। দোকানে কোনো খদ্দের নেই। থাকার কথাও না। মানুষের মনে ভয়। শহীদ মিনার থেকে একটা মিছিল কি গণভবনের দিকে যাওয়ার কথা। আজই? এ রকম কোনো ঘোষণা কি এসেছে?
পকেট থেকে খামটা বের করল সে। দেখল। স্পষ্টই এটা ব্রিটিশ-পরবর্তী পাকিস্তান সময়ের কোনো খাম না। একেবারে, এই সময়ের এখনকার পোস্ট অফিসের সিলছাপ্পর মারা চেনা হলুদ খাম। পোস্ট অফিসের দুদিন আগের সিলমোহর পরিষ্কার, বাংলাবাজার পোস্ট অফিস থেকে তার ঠিকানায় বিলি হয়েছে।
কার চিঠি? খামে প্রেরকের কোনো ঠিকানা নেই।
ভেতরে একটা কাগজের টুকরো, আর এক ভাঁজ করা একটা সাদা কাগজ, তাতে লেখা:
পিএস অস্ট্রিচ
ছাড়ার সময়: ৬:০০ (সন্ধ্যা)
আর চিরকুটের মতো এক টুকরো কাগজে লেখা:
আইজিএন দালান, টিকিট কাউন্টার
অগ্রিম বুকিং: সদরঘাট-কলকাতা
নিচে একটা প্যাঁচানো সই। পাশে লেখা ১২০৩ (এই সংখ্যার কী অর্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে সে)!
আর কোনো কথাবার্তা, নাম-ধাম কিছু নেই। বাসায় থাকতে নেট ঘেঁটে সে বুঝেছে আইজিএন হলো ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন (আইজিএন), আর এর সঙ্গে কাজ করে রিভার স্টিম নেভিগেশন, একে সংক্ষেপে আরএসএনও বলে। ব্রিটিশদের যৌথ কোম্পানি।
আর অস্ট্রিচ এক প্যাডেল স্টিমারের নাম। এখন আর সচল নেই। সদরঘাটে আইজিএন দালান নামেও কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই এখন।
ফিরতি পথে টিএসসির দিকে না গিয়ে আজিমপুর দিয়ে বেরিয়ে সে নাজিমউদ্দিন রোডে এসে উঠল। আড়াআড়ি ইমামগঞ্জ দিয়ে বের হবে ইংলিশ রোডে। ওখান থেকে তার বাসা দশ মিনিটের পথ।
কিন্তু আজ কী হলো?
অবাক হয়ে দেখল: ইমামগঞ্জের পরিবর্তে সে এসে হাজির হয়েছে শাঁখারীবাজারে! এটা কীভাবে হলো? এ রাস্তা তার নিজের হাতের তালুর মতোই চেনা। তার প্রতিদিনের ফেরার রাস্তা। অন্যমনস্ক থাকায় সে কি ভুল করে চলে এসেছে এ রাস্তায়? শাঁখারীবাজারের দিকে সে আসে না বহুদিন। চারপাশে সাদা সাদা শাখার গয়নার দোকান। এরপর অসংখ্য রিকশা ভিড় পেরিয়ে সে যে জায়গায় বেরিয়ে এল, তা পুরোই তার কাছে এক অচেনা জায়গা।
চোখের কোনায় দেখল ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
তখুনি কোত্থেকে আচমকা তাকে প্রায় মাড়িয়ে দেওয়ামতো একটা ঘোড়ার গাড়ি পাশ দিয়ে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেল। চউখ কোহানে! ঘোড়ার গাড়ির দিক থেকে আসা খিস্তিতে কান গরম হয়ে গেল তার।
চারদিকে হাটের মতো ব্যস্ততা, অগুনতি মানুষ। হাতে বাক্সপ্যাটরা। বোঁচকা। টিনের ট্রাঙ্ক মাথায় কুলি। কোনোরকমে ভিড় বাঁচিয়ে আরও সামনে এগোতেই বুড়িগঙ্গা নদী, পন্টুন, লঞ্চ, বিশাল এক স্টিমার আর এক পেল্লাই দালানে চোখ আটকে গেল তার।
সদরঘাট! অস্ফুটে বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। কিন্তু এই মানুষজন কারা, অনেকের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। ফতুয়া। দাড়ি-টুপির মানুষও অনেক। মুটেমজুর। ছোট খুপরি দোকান। চারপাশজুড়ে মহা হাঁকডাক। গমগম করছে। সবাই ছুটছে।
এটা কোন সদরঘাট!
চমকে চিঠির কথা মনে পড়ল: চিঠিতে অস্ট্রিচের আর এই বিশাল দালানের কথাই কি বলা হয়েছে! এটাই কি সেই আইজিএন–ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশনের দপ্তর।
এই সদরঘাট কোন সময়ের সদরঘাট!
এগোয় সে।
সন্ধ্যার মুখে মুখে, গ্যাস-বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করল যেন দপ দপ করে, একে একে।
মাথা ঘুরছে তার। কী হচ্ছে এসব!
তীব্র সিগারেট তেষ্টা পেয়েছে মনে হলো। গলার ভেতরটাও তেতো লাগছে।
ডান পাশে একটা দোকান, হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরনে, এখনকার টি-শার্টের মতো। সুতির। এ রকম গেঞ্জি সে তার নানা-দাদাকে পাঞ্জাবি-ফতুয়ার নিচে পরতে দেখেছে। টিনের ট্রাঙ্ক। সুটকেস। শুকনো খাবার নানা মণিহারি জিনিসপত্র সাজিয়ে বসা দোকানদারের কাছে সিগারেট চাইল সে।
কী সিগ্রেট?
কী আছে?
ক্যাপস্ট্যান আর গোল্ডফ্লেক।
বেনসন সাদা দেন...দমফোট গলায় বলে সে।
কী–খেঁকিয়ে উঠল দোকানি।–বিড়ি? টেন্ডু?
কয়েক মুহূর্ত সে কথা খুঁজে পেল না। ক্যাপস্ট্যান-গোল্ডফ্লেক এই ব্র্যান্ডের সিগারেট নিয়ে কোনো ধারণা নেই, টেন্ডু পাতার বিড়িটা বুঝতে পেরেছে। বইয়ে পড়েছে।
দোকানি অন্য খদ্দের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ততক্ষণে।
সিগ্রেট এক আনা। যেডাই লন, মাথা না ফিরিয়েই জানাল দোকানি।
সিগারেট। বলল সে।
সাদা রঙের প্যাকেট, নীল রংও আছে। সোনালি রঙে ক্যাপস্ট্যান কথাটা লেখা প্যাকেটের গায়ে। এক শলা সিগারেট বাড়িয়ে দিল তার দিকে।
এক আনা।
পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে দোকানদারের হাতে দিল। টাকা হাতে নিয়ে দোকানি একবার তার দিকে আরেকবার হাতের নোটের দিকে তাকাল, তারপর চোখে-মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বলল, এটা কী দিছেন? এই কাগজ দিয়া কী করমু! এক আনা বাইর করেন!
ভাই সিগ্রেট রাখেন। মাল নাই।
কোলের ওপর সিগ্রেট প্রায় ছুড়ে দিয়েই দৌড়ে পালানোর মতো সরে এল সে। পেছনে দোকানি খিস্তিখেউড় করলেও শুনল না, ততক্ষণে দোকানির আওতার বাইরে চলে এসেছে সে।
পাশ দিয়ে এক বুড়ো বয়সী, সঙ্গে ঘোমটা দেওয়া দুই নারী আর এক কিশোর দ্রুত পাশ কাটিয়ে গেল তার। ছেলেটার মাথায় ট্রাঙ্ক। ওদের অনুসরণ করে সামনে এগিয়েই অস্ট্রিচের ওপর চোখ আটকে গেল তার। মাত্র কয়েক মিটার দূরের এই অস্ট্রিচই ৬টায় কলকাতার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে! চারপাশে এত তোড়জোড় এ কারণেই।
আইজিএন, ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশনের দপ্তর, নিচের বিশাল হলরুমে ঢুকে তার মনে হলো সে আরেকটা বাজারের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। মানুষজনে গমগম করছে বিশাল হলরুম, একপাশে শিক ঘেরা জায়গাটাকে টিকিটঘর বলে প্রত্যয় হলে। পকেটের চিরকুটের মতো ছোট কাগজটা বের করল সে। পড়ল একবার:
আইজিএন দালান, টিকিট কাউন্টার
অগ্রিম বুকিং: সদরঘাট-কলকাতা...
শিকের ঘেরের ভেতর বসা ভারী চশমা পরা লোকটা কাচের ওপর দিয়ে দেখল তাকে একপলক:
কোথায়? বরিশাল না খুলনা?
সে হাতের চিরকুট বাড়িয়ে দিল।
লোকটা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে পাশ থেকে মোটা লেজারের পাতা উল্টে থামল, কলম দিয়ে লিখল কিছু লেজারের পাতায়। তারপর কোলের কাছে ড্রয়ার থেকে ভুসো কাগজের একটা টিকিটের মতো এগিয়ে দিল তার দিকে।
তাড়াতাড়ি...মশাই। কেবিন ১৮। হাত উঁচিয়ে তাড়া দেওয়ার ভঙ্গি করল।
অস্ট্রিচের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে যাত্রীরা। এদিক-ওদিক থেকে হাঁকডাক, নানা নাম ধরে ডাকাডাকি। স্টিমারটা তীব্র স্বরে ডেকে উঠল তখুনি।
এক স্টিলের থামের পাশ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। হাতে ধরা তার টিকিট, বরিশাল-কলকাতা, তারিখ ৩-৮-৪০।
মানে ৩ আগস্ট ১৯৪০ সাল।
সে ১৯৪০ সালে চলে এসেছে!
সে কি স্বপ্ন দেখছে। কোনো ভোজবাজি। তার ঢাকা শহর তো এখন বিক্ষোভে ফুসছে। কারফিউ। কয়েক শ ছাত্র মারা গেছে। আজকে তার টিএসসিতে যাবার কথা ছিল। তার পরিবর্তে সে ১৯৪০ মালের সদরঘাটে কীভাবে এল।
এটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না! হাতের মুঠো আরও শক্ত করে, ককিয়ে ওঠার মতো টের পেল হাতের তালুতে আঙুলের নখ বসে যাচ্ছে তার। ব্যথা পাচ্ছে।
এ স্বপ্ন না!
আর তখনই তার মনে হলো, তার কাঁধে হাত রাখল কেউ। একটা চুড়ির চেনা আওয়াজ। নাকে ঝাপটা দিল খুব চেনা কোনো সৌরভ। ঘাড় ফিরিয়ে সে দেখল!
আপনি...! অস্ফুটে বলতে পারল কেবল।
চলো...
স্বপ্নোত্থিতের মতো এগোল সে তার সঙ্গে, অপেক্ষমাণ অস্ট্রিচ যেন তাদেরই অপেক্ষায়। তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে আরেকটি হাত।