‘শ্বাস নেওয়া দায়’: বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরে জনজীবন
দিল্লির দূষণজনিত অসুস্থতার চিকিৎসায় নিবেদিত প্রথম ক্লিনিকে বসে দীপক রজক নিঃশ্বাস নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ৬৪ বছর পুরোনো হাঁপানি সম্প্রতি আরও তীব্র হয়ে উঠেছে এবং দ্রুত শারীরিক অবনতি দেখে তার মেয়ে তাকে জরুরিভিত্তিতে ক্লিনিকে নিয়ে এসেছেন।
ওয়েটিং রুমে রজক সিএনএনকে জানান, তিনি তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছেন এবং কাঁশি থামাতে পারছেন না।
'শ্বাস নেওয়া যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বাসে আসার সময় মনে হচ্ছিলো, আমার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে,' রজক জানান।
গত বছর দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া (আরএলএম) হাসপাতালে এ বিশেষায়িত ক্লিনিকটি স্থাপিত হয়েছিল। এটি ক্রমশ বাড়তে থাকা বায়ু দূষণের কারণে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য কাজ করছে, বিশেষ করে শীতকালে যখন দূষণের মাত্রা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
দিল্লির বাতাসে গত মাসের শেষ থেকে যেন বিষাক্ত ধোঁয়ার চাদর পুরো শহরকে ঢেকে ফেলেছে। রাতে আর দিনে কোনো পার্থক্যই নেই। ফ্লাইট চলাচল ব্যাহত হচ্ছে, দূর থেকে বহুতল ভবনগুলোও অস্পষ্ট দেখাচ্ছে—এমন এক চাদরে ঢাকা পড়েছে শহর, যা লক্ষ লক্ষ বাসিন্দার জীবনকে বিপন্ন করে তুলছে।
বৈশ্বিক বায়ু গুণমান পর্যবেক্ষক আইকিউ এয়ার-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত সপ্তাহ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্য কোনো অঞ্চলে বায়ু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এতটা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না।
এতটাই খারাপ পরিস্থিতি যে, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী চিকিৎসাক্ষেত্রে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন, কর্তৃপক্ষ স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে এবং মানুষকে বাড়িতে থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
তবে রজকেরা কোনো সমাধান পাননি, কারণ তিনি ড্রাই ক্লিনিংয়ের কাজ করে পরিবারের ভরণপোষণ করেন।
রজক বলেন, 'আমার কী করার আছে? আমাকে তো কাজে যেতে হবেই। উপার্জন না করলে তো খাব কী? আমি যখন বাড়ি থেকে বের হই, গলা আটকে আসে, সন্ধ্যা হতে হতে মনে হয়, আমার জীবন শেষ।'
এ বছর দূষিত বায়ুতে শ্বাসকষ্ট বাড়ানোর কারণে রজককে একবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ দূষণ থেকে মুক্তির কোনো উপায় না দেখে তার মেয়ে কাজল রজক বলেন, তিনি আশঙ্কা করছেন, আবারও তার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হতে পারে, যা তাদের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক চাপ। ইনহেলার এবং ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার জন্য অর্থ জোগাড় করাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
এমনকি বাবাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বলে কাজল জানান। তিনি বলেন, 'আমাদের সামনে কী আছে, তা দেখা যাচ্ছিল না। আমরা বাসস্টপে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বাসের নম্বরও দেখতে পারছিলাম না, এমনকি বাস আসছে কি না সেটাও বোঝা যাচ্ছিল না, সবকিছু ছিল ঝাপসা!'
'চোখে যেন মরিচের গুঁড়ো'
আইকিউ এয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী, এ সপ্তাহে দিল্লির কিছু অংশে বায়ু দূষণের মাত্রা ১৭৫০-কে ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে ৩০০-এর ওপরের যেকোনো মাত্রা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য করা হয়।
গত বুধবার, দিল্লির বাতাসে পিএম ২.৫ দূষণের মাত্রা ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার ৭৭ গুণ বেশি।
এ দূষণ সম্পর্কে মন্তব্যের জন্য সিএনএন ভারতের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে।
শ্বাস নেওয়ার সময় পিএম ২.৫ কণা ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে এবং রক্তপ্রবাহে মিশে যেতে পারে, যা শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, ক্যান্সারসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এটি শিশুদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা তৈরি করতেও সক্ষম।
সিএনএন গত সপ্তাহ থেকে প্রায় ডজনখানেক দিল্লিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছে—বেশিরভাগই বলেছেন, দূষণের কারণে শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। অনেকেই জানিয়েছেন, বিষাক্ত বাতাসে তাদের দমবন্ধ লাগছে, চোখ জ্বালা করছে এবং গলা চুলকানোর সমস্যা হচ্ছে।
'মনে হয়, কেউ যেন আমার চোখে মরিচ গুঁড়া ছিটিয়ে দিয়েছে,' এভাবেই দিল্লিতে দীর্ঘদিন ধরে অটোচালক মুহাম্মদ ইব্রাহিম পরিস্থিতির বর্ণনা দেন। তিনি আরও বলেন, বাইরে সারাদিন কাজ করতে গিয়ে তার ক্রমাগত বুকে ব্যথা হচ্ছে।
'সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফিরি আর হাত-মুখ ধুই, আমার নাক দিয়ে কালো কালো কিছু বেরিয়ে আসে। এরকম কিছু আগে কখনও হয়নি,' বলেন ইব্রাহিম।
রজকের মতোই, ইব্রাহিমের কাজ না করে কোনো উপায় নেই, তার শারীরিক ক্ষতি যাই হোক না কেন।
ইব্রাহিম বলেন, 'আমি গরীব মানুষ। কাজ না করলে খাব কী, ভাড়া দেব কী?'
ঝুঁকিতে থাকা কিছু বাসিন্দা জানাচ্ছেন, দিল্লিতে এখন বেঁচে থাকা যেন এক চ্যালেঞ্জ। ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য ৬৪ বছর বয়সি আদিত্য কুমার শুক্লা জানান, তিনি দূষিত পরিবেশে বাইরে না যাওয়ার চেষ্টা করেন।
'নিজেকে এ দূষিত পরিবেশ থেকে বাঁচানোর কোনো উপায় নেই। বাড়িতেও থাকলে দূষিত বাতাস তো আসে, কারণ বাতাস খুবই নোংরা,' দিল্লির বাট্রা হাসপাতালে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি সিএনএনকে এসব বলেন।
শুক্লা জানান, তিনি এ বছর তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এবং পারলে তিনি এ শহর থেকে দূরে চলে যেতেন।
তিনি বলেন, 'আমি খুবই চিন্তিত, কিন্তু এ পরিস্থিতিতে কোথায় যাব? খুব রাগ হয়, মনে হয় দিল্লি ছেড়ে চলে যাই, কিন্তু কোথায় যাব? দিল্লির বাইরে হাঁপানি বা ফুসফুসজনিত রোগের চিকিৎসাসেবা ভারতের আর কোথাও নেই।'
দূষণজনিত চিকিৎসার এ ক্লিনিকের চিকিৎসক ডা. অমিত জিন্দাল জানান, তিনি এবং তার সহকর্মীরা সাম্প্রতিক সময়ে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধির পর থেকে বুক ব্যথা ও ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে রোগীদের সংখ্যা বাড়তে দেখেছেন। তিনি এও বলেন, দূষিত ধোঁয়ার সঙ্গে এ বৃদ্ধির সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
রোগীরা ক্রমাগত কাঁশি, বুক ও ফুসফুসের সমস্যা এবং চোখের সমস্যায় চিকিৎসার জন্য আসছেন। তবে রজক এবং শুক্লার মতো যাদের পূর্বে স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল বা যারা বাইরে নিয়মিত কাজ করেন, তারা আরও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন, বলেন ডা. জিন্দাল।
বাট্রা হাসপাতালের পালমোনোলজিস্ট ডা. গৌরব জৈন জানান, অধূমপায়ীরাও এখন ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)-তে আক্রান্ত হচ্ছেন, যা ফুসফুসের এক রোগ, যা বায়ুপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে এবং শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি বলেন, 'বহু রোগী যারা নিয়মিত দূষিত এলাকায় কাজ করেন বা বারবার দূষণ শ্বাসে টানেন, তাদের সিওপিডি হয়ে থাকে। তাদের ফুসফুস অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়ে, ফলে শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, এবং তাদের ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।'
দীর্ঘমেয়াদি সংকট
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দিল্লি উচ্চমাত্রার বায়ু দূষণের সঙ্গে লড়ছে। প্রতি বছর গ্রীষ্ম থেকে শীতের দিকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের মান আরও খারাপ হতে থাকে। বাতাসে ক্ষতিকর কণিকা, কৃষি বর্জ্যের আগুন, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং উচ্চমাত্রায় ট্রাফিকের কারণে শহরের আকাশে দূষিত ধোঁয়া সৃষ্টি হয়।
গত রোববার ভারতের দূষণ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দিল্লির বেশ কয়েকটি এলাকায় বায়ুর গুণমান 'গুরুতর+' পর্যায়ে ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হয়েছে, যার মধ্যে ছিল অপ্রয়োজনীয় ট্রাক চলাচল ও নির্মাণকাজ বন্ধ রাখা।
কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে রাস্তায় পানি ও ধুলা নিরোধক ছিটানো হচ্ছে এবং রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ চালানো হচ্ছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর নেওয়া এসব পদক্ষেপ শুধুমাত্র অস্থায়ী সমাধান, যা দূষণের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করে না।
'দূষণের উৎস থেকে নির্গমন কমানোর জন্য যে প্রকৃত পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন, তা খুবই সীমিত আকারে করা হচ্ছে। আর আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, সরকারের তরফ থেকে যে পদক্ষেপ বা প্রতিক্রিয়া আমরা দেখছি তা এ পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুযায়ী একেবারেই যথেষ্ট নয়,' বলেন পরিবেশ বিশ্লেষক সুনীল দাহিয়া।
২০১৯ সালে ভারত সরকার শহরগুলোতে পরিবেষ্টিত বাতাসের গুণমান উন্নত করার লক্ষ্যে জাতীয় বিশুদ্ধ বায়ু কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল এবং বায়ু দূষণ মোকাবিলা করার জন্য জাতীয় এবং রাজ্যভিত্তিক উভয় স্তরে আরও বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করেছে।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার টেকসই প্রচেষ্টা গ্রহণের পরিবর্তে জরুরি প্রতিক্রিয়ার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। দাহিয়া বলেন, শীতকালীন ফসল কাটার মৌসুমে খড় পোড়ানোর ফলে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এ সংকট সমাধানে দূষণ মোকাবেলায় সারা বছরব্যাপী বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
'আমাদের সুশৃঙ্খলভাবে এবং বিস্তৃত পরিসরে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করতে হবে যাতে দূষণকে গোড়া থেকেই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। এর মানে হচ্ছে পরিবহন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিল্প খাতে বায়ু দূষকের নির্গমন কতটা, সেটা নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করতে হবে,' বলেন দাহিয়া।
ক্লিনিকে বাবার শ্বাসকষ্ট ও হাঁটার অসুবিধায় ক্রমাগত স্বাস্থ্যের অবনতিতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন তার মেয়ে কাজল রজক। কাজল ক্ষুব্ধ, কিন্তু তিনি জানেন, ক্ষুব্ধ হয়ে কোনো লাভ নেই।
'সরকারকে এ ব্যাপারে কিছু করতেই হবে।'
অনুবাদ: নওরীন সুলতানা