বাংলাদেশের শাহ আলমের ৩৫ সেন্টের কলা বিক্রি হয়েছে ৬.২ মিলিয়ন ডলারে—বিশ্বাস করতে পারেননি!
বছরের পর বছর ধরে শিল্পজগতে তুমুল বিতর্ক তুলে দেওয়া একটি কলা সদেবিজ-এর সমকালীন শিল্প নিলামে ৬.২ মিলিয়ন ডলারে—বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৭৫ কোটি টাকা—বিক্রি হয়েছে। সেই কলা অবশ্য খেয়েও ফেলেছেন এর ক্রেতা চীনা বংশোদ্ভূত ক্রিপ্টো উদ্যোক্তা জাস্টিন সান।
কলাটি কেনা হয়েছিল এক বাংলাদেশির দোকান থেকে, দোকানির নাম শাহ আলম। ম্যানহাটনের আপার ইস্ট সাইডে তার ফলের দোকান। শাহ আলমের দোকান নিলাম প্রতিষ্ঠান সদেবিজের বাইরের রাস্তায় বেশ ভালো ব্যবসা করে, যেখানে ফলের দাম কয়েক সেন্ট থেকে কয়েক ডলারের মধ্যে। অথচ সথেবিজের ভেতরে শিল্পকর্মের কেনাবেচা হয় লাখ বা কোটি ডলারে।
তার দোকান থেকে ৩৫ সেন্টে কেনা কলা যে পাশের সদেবিজের নিলামে ৬.২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে তা জানতেনও না তিনি। শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন।
বিক্রির কয়েকদিন পর একদিন বৃষ্টির মধ্যে ম্যানহাটনের ইয়র্ক অ্যাভিনিউ এবং ইস্ট সেভেন্টি টু স্ট্রিটের কোণে দাঁড়িয়ে কলার গোছা থেকে একটি একটি করে কলা আলাদা করছিলেন তিনি। ঠিক সেই সময় এক সাংবাদিক এসে তাকে জানান, তার বিক্রি করা কলাটি একটি শিল্পকর্মের অংশ হিসেবে দেয়ালে টেপ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল এবং সেটি পরে নিলামে ৬.২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে।
নিজের বিক্রি করা কলার এমন আকাশচুম্বী দাম শোনার পর কাঁদতে শুরু করেন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ৭৪ বছর বয়সি শাহ আলম বলেন, 'আমি একজন গরিব মানুষ। আমার জীবনে এমন টাকা কখনও আসেনি; এত টাকা আমি কখনও দেখিনি।'
কলাটির শিল্পকর্মে পরিণত হওয়ার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৯ সালে। এটি একটি কনসেপ্ট আর্টওয়ার্ক, নাম 'কমেডিয়ান'। শিল্পকর্মটি প্রখ্যাত ইতালীয় শিল্পী মরিজিও ক্যাটেলান প্রথমবারের মতো প্রদর্শন করেন আর্ট বেসেল মায়ামি বিচে, একটি আন্তর্জাতিক শিল্প মেলায়।
শিল্পপ্রেমীদের কাছে শিল্পের চিরাচরিত মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয় 'কমেডিয়ান'। এর পক্ষে-বিপক্ষে ওঠে আলোচনার ঝড়।
তবে পারফর্ম্যান্স আর্টিস্ট ডেভিড ডাটুনা শত শত দর্শকের সামনে দেয়াল থেকে কলাটি তুলে খেয়ে ফেলার পর ঘটনা নতুন মোড় নেয় । ডাটুনা পরে দাবি করেন, কলা খাওয়ার কাজটি তার নিজস্ব আর্টিস্টিক পারফর্ম্যান্স ছিল। কোনো ধরনের উগ্রতা প্রদর্শনের ইচ্ছায় তিনি কাজটি করেননি।
পরে জননিরাপত্তার কারণে মিয়ামির প্রদর্শনী থেকে 'কমেডিয়ান' সরিয়ে নেওয়া হয়। মিয়ামিতে শিল্পকর্মটির প্রতিটি সংস্করণ ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের মধ্যে বিক্রি হয়েছিল।
তবে শিল্পীর নির্দেশনা অনুযায়ী এটি প্রতিস্থাপনযোগ্য। এটি একটি বিস্তারিত মালিকানার নির্দেশিকা সহ এসেছিল, যাতে বলা ছিল কীভাবে কলাটি টেপ দিয়ে দেয়ালে আটকে রাখতে হবে এবং তা পঁচে গেলে আবার নতুন কলা বসানোর অনুমতি পাওয়া যাবে।
পাঁচ বছর পর গত বুধবার আবার সদেবিজের নিলামে তোলা হয় 'কমেডিয়ান'কে। ধারণা করা হয়েছিল, এর দাম উঠবে ১ মিলিয়ন থেকে ১.৫ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু চূড়ান্ত দাম—৫.২ মিলিয়ন ডলার, সঙ্গে নিলামঘরের ফি যোগ হয়ে ৬.২ মিলিয়ন ডলার—শিল্পকর্মটি সব অনুমানকে ছাড়িয়ে গিয়ে ৬.২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হলো।
এই নিলামের জন্য ক্যাটেলান কোনো অর্থ দেওয়া হয়নি, যেহেতু এটি একজন সংগ্রাহকের হয়ে হয়েছিল, যার নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে ক্যাটেলান একটি ই-মেইলে জানান যে, নিলামের দাম শুনে তিনি খুবই খুশি।
তিনি বলেন, 'সত্যি বলতে, আমি অসাধারণ অনুভব করছি। বেসেলে শুরু হওয়া নিলামের পর এটি এখন একটি বৈশ্বিক অদ্ভুত ঘটনায় রূপ নিয়েছে। এভাবে, এই কাজটি স্বতঃসিদ্ধ হয়ে ওঠে: দাম যত বাড়বে, এটি তার মূল ধারণাকে ততই শক্তিশালী করবে।'
কলাটির মালিক চীনা বংশোদ্ভূত ক্রিপ্টো উদ্যোক্তা জাস্টিন সান এক্স-এ লিখেন, কলাটির 'গর্বিত মালিক' হতে পেরে তিনি সম্মানিত। 'আমি বিশ্বাস করি, এই শিল্পকর্মটি ভবিষ্যতে আরও চিন্তা এবং আলোচনা উত্পন্ন করবে এবং ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে', বলেন তিনি।
ঢাকার বাসিন্দা শাহ আলম আগে সরকারি চাকরি করতেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ২০০৭ সালে শাহ আলম মেয়ের কাছাকাছি থাকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ডে চলে আসেন। বর্তমানে ব্রঙ্কসের পার্কচেস্টারে একটি বেসমেন্ট অ্যাপার্টমেন্টে ৫ জনের সাথে রুম ভাগাভাগি করে থাকেন তিনি। প্রতি মাসের ভাড়া ৫০০ ডলার।
তার ফলের দোকানে কাজের শিফট ১২ ঘণ্টা, সপ্তাহে চার দিন—প্রতি ঘণ্টার জন্য ১২ ডলার করে পান। ইংরেজিতে খুব একটা দক্ষ না। শুধু ফলের নাম এবং দাম জানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেন শাহ আলম।
শাহ আলমের প্রতিক্রিয়া গভীরভাবে স্পর্শ করেছে কলাটির ক্রেতা জাস্টিন সানকে। তিনি বলেন, 'এই শিল্পকর্মে তার (শাহ আলম) ভূমিকা কোনোভাবেই অবহেলা করার মতো নয়।'
'তার প্রতিক্রিয়া শিল্পের অপ্রত্যাশিত প্রভাবকে তুলে ধরে... ', যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশি এই ফল বিক্রেতাকে সহায়তা করতে তার কাছ থেকে ১ লাখ কলা কিনবেন জাস্টিন। এসব কলা তিনি বিনামূল্যে বিতরণ করবেন বলেও জানান।
শাহ আলম কখনো নিলাম প্রতিষ্ঠান সদেবিজে প্রবেশ করেননি। তার দৃষ্টি শক্তি দুর্বল, ভালো করে দেখতে পারেন না। আসছে জানুয়ারিতে তিনি চোখের ক্যাটারেক্ট সার্জারি করাবেন।
শাহ আলম জানান 'কমেডিয়ান' শিল্পকর্মটি যেন তার ওপর রসিকতা। 'যারা এটি কিনেছে, তারা কী ধরনের মানুষ?, তারা কি জানে না কলা আসলে কী?', বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করেন শাহ আলম।
ক্যাটেলান ই-মেইলে জানান, শাহ আলমের প্রতিক্রিয়া তাকে স্পর্শ করেছে, কিন্তু তিনি তার সমালোচনায় এক মত হতে পারেননি ।
তিনি বলেন, 'কলার বিক্রেতার প্রতিক্রিয়া আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে, এটি দেখায় যে শিল্প কতটা অপ্রত্যাশিত এবং গভীরভাবে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তবে, প্রকৃতিগত ভাবে কোনো সমস্যার সমাধান শিল্প করতে পারে না—এটা রাজনীতির কাজ'।
অবশ্য শিল্পকর্ম হিসেবে কলা বিক্রি হলেও তা শাহ আলমের ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আনেনি, তিনি এখনও চারটি কলা ১ ডলার করেই বিক্রি করেন।