এককোষী জীবের জিন ব্যবহার করে ইঁদুর তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা
প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা এককোষী জীবের জিন ব্যবহার করে ইঁদুরের স্টেম কোষ তৈরি করেছেন। স্টেম কোষ এমন একটি বিশেষ কোষ যা নিজে থেকেই আরও কোষ তৈরি করতে পারে এবং অন্যান্য কার্যকরী কোষে রূপান্তরিত হতে পারে।
গবেষকরা এই স্টেম কোষ ব্যবহার করে একটি বিকাশমান ভ্রূণ থেকে জীবন্ত এবং শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে সক্ষম একটি ইঁদুর তৈরি করেছেন। গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি "ন্যাচার কমিউনিকেশনস" নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণার এই সাফল্য বিস্ময়কর কারণ এতদিন বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, স্টেম কোষ বিভাজন ও বিশেষায়নে সহায়ক জিনগুলো কেবল প্রাণীদের মধ্যেই পাওয়া যায়। কিন্তু প্রায় এক বিলিয়ন বছর পুরোনো এককোষী প্রোটিস্টে এমন জিনের সন্ধান পাওয়া সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই যুগান্তকারী আবিষ্কার শুধু প্রাণীজগতের বিবর্তনের রহস্য উন্মোচনেই নয়, জীববিজ্ঞানে নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচনে বড় ভূমিকা রাখবে। এটি ভবিষ্যতে চিকিৎসা, জিন প্রকৌশল এবং প্রাণীজগতের বিকাশ নিয়ে গবেষণায় নতুন পথ দেখাতে পারে।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেম কোষ জীববিজ্ঞানী এবং গবেষণার সহলেখক রালফ জক বলেন, "স্টেম কোষের আণবিক সরঞ্জাম আগের ধারণার চেয়েও অনেক প্রাচীন। এই আণবিক সরঞ্জাম প্রাণীজগতের স্টেম কোষগুলোর চেয়েও পুরোনো।"
তিনি বলেন, " এই প্রাকৃতিক বিবর্তনকে বোঝার মাধ্যমে আমরা আরও উন্নত স্টেম কোষ মডেল তৈরি করতে পারব। এটি আমাদের বিভিন্ন রোগ বা এমনকি বার্ধক্যকে প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।"
প্রাপ্তবয়স্ক কোষকে স্টেম কোষে রূপান্তর
প্রাণী ও প্রোটিস্টের পার্থক্য শুধু কোষের সংখ্যা দিয়ে নির্ধারিত হয় না। প্রোটিস্ট হলো এককোষী মাইক্রোস্কোপিক জীব [প্রাণী, ফাংগাস বা উদ্ভিদ নয়] এবং এটি সমস্ত কার্যকলাপ একক কোষের মাধ্যমে সম্পাদন করে। কিন্তু প্রাণীজগতে কোষগুলোর মধ্যে বিশেষায়িত ভূমিকা থাকে, যেখানে কিছু কোষ নির্দিষ্ট কাজ করে এবং অন্য কোষগুলি অন্যান্য কাজের দায়িত্ব পালন করে।
কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অ্যালেক্স ডে মেন্ডোজা বলেছেন, "আমরা জানি প্রাণীজগতের অধিকাংশ জীবের স্টেম কোষ প্রয়োজন, কারণ আপনি এমন কোষ চান যা বিভাজিত হতে পারে এবং অন্য কোষ তৈরি করতে সক্ষম হয়।"
২০১২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়া গবেষক শিনিয়া ইয়ামানাকা ২০০৬ সালে আবিষ্কার করেছিলেন, প্রাপ্তবয়স্ক কোষকে চারটি বিশেষ জিন– এসওএক্স২, পিওইউ৫এফ১, কেএলএফ৪ এবং এমওয়াইসি দিয়ে স্টেম কোষে রূপান্তরিত করা সম্ভব। এই বিশেষ জিনগুলোকে ইয়ামানাকা ফ্যাক্টর বলা হয়।
প্রথমে এসব জিনকে প্রাণীজগতের জন্যই বিশেষ বলে মনে করা হত, কারণ এককোষী জীবের মধ্যে স্টেম কোষের প্রয়োজন ছিল না বলে ধারণা করা হয়েছিল।
ডে মেন্ডোজা তার পিএইচডি গবেষণার সময় প্রোটিস্টে এসব জিনের সন্ধান করেননি। কিন্তু ২০২২ সালে, নতুন ডেটার মাধ্যমে তিনি আবারও গবেষণা শুরু করেন। প্রায় ৩০টি জিনের সিকোয়েন্স পরীক্ষা করার পর তিনি কিছু প্রোটিস্টে ইয়ামানাকা ফ্যাক্টরের সংস্করণ খুঁজে পান, যা প্রাণীজগতেও পাওয়া যায়।
ডে মেন্ডোজা বলেন, "আমরা এগুলো খুঁজে পেয়ে অবাক হয়েছি, কারণ আমরা একদমই আশা করিনি এগুলো এখানে পাওয়া যাবে।"
এই চমকপ্রদ আবিষ্কার প্রোটিস্টদের মধ্যে স্টেম কোষের বিবর্তন এবং তার প্রকৃত ভূমিকা নিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
প্রাণীজগতের চেয়ে পুরোনো জিন থেকে তৈরি করা ইঁদুর
বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি এক নতুন গবেষণায় আবিষ্কার করেছেন, একটি এককোষী প্রোটিস্টের জিন [প্রাণীজগতের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়] স্টেম কোষ তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোয়ানোফ্ল্যাগেলেট নামক এই প্রোটিস্ট আণুবিক্ষণিক আকারের, পানির মধ্যে চলাফেরা করে এবং ব্যাকটেরিয়া খায়। এটি প্রাণীজগতের উত্স নিয়ে নতুন ধারণা প্রদান করেছে।
গবেষকরা ২২টি কোয়ানোফ্ল্যাগেলেট প্রজাতির জিনোম পরীক্ষা করে ২টি প্রজাতিতে প্রাণীজগতের মতো এসওএক্স এবং পওইউ জিনের উপস্থিতি খুঁজে পান। এই জিনগুলো স্টেম কোষ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা প্রাণীজগতের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
বিশেষভাবে, এসওএক্স জিনটি ইঁদুরের কোষে বসানো হলে তা সাফল্যের সাথে স্টেম কোষে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু পওইউ জিনটি প্রাণীজগতের মতো কাজ করতে সক্ষম হয়নি, কারণ এটি এককোষী প্রোটিস্টে ডিএনএ-এর সাথে আলাদা ভাবে যুক্ত হয়।
গবেষণায় আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, এই জিনগুলোর পেছনে একটি প্রাচীন সাধারণ পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব রয়েছে, যা কোয়ানোফ্ল্যাগেলেট এবং প্রাণীদের মধ্যকার সম্পর্ক প্রকাশ করেছে।
গবেষকরা ধারণা করছেন, এই জিনগুলো সম্ভবত প্রাথমিক জীবিত কোষগুলোর মৌলিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হত এবং পরবর্তীতে বহুকোষী প্রাণী নিজেদের শারিরীক গঠনের জন্য এসব জিন পুনঃব্যবহার করেছে।
এটি প্রমাণ করে, বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নতুন কিছু তৈরি করার আগে পুরনো উপাদানগুলোকে পুনঃব্যবহার করা হয়, যা জীববিজ্ঞানের নতুন সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করছে।