সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আসাদ ও তার স্ত্রীর ভবিষ্যৎ কী?
গত রোববার বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাচ্যুতি সিরিয়ার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এটি শুধু তার ২৪ বছরের শাসনামলের সমাপ্তি নয়, বরং তার পরিবারের পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা শাসনের ইতি ঘটায়।
২০০০ সালে আসাদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের আগে, তার পিতা হাফেজ আল-আসাদ টানা তিন দশক ধরে সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর নেতৃত্বাধীন নতুন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর, ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী এবং তাদের তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।
আসাদ ও তার পরিবার বর্তমানে রাশিয়ায় রয়েছেন, যেখানে তাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের সামনে কী অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে।
রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়া দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি রক্ষা করেছে এবং ২০১৫ সালে আসাদের পক্ষে একটি বিমান অভিযানের সূচনা করে, যা যুদ্ধের গতিপথ পরিবর্তনে সহায়ক হয়।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী জানিয়েছে, গত নয় বছরে রুশ সামরিক অভিযানে ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৮ হাজার ৭০০ জন ছিলেন সাধারণ নাগরিক।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া হয়তো আসাদ সরকারকে বিদ্রোহীদের বিদ্যুৎগতির আক্রমণ ঠেকাতে যথাযথ সহায়তা দিতে পারেনি বা দিতে চায়নি।
বিদ্রোহীরা দামেস্ক দখল করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রুশ রাষ্ট্রায়ত্ত মিডিয়ায় খবর আসে, আসাদ এবং তার পরিবার মস্কো পৌঁছেছেন এবং তাদের 'মানবিক কারণে' আশ্রয় দেওয়া হবে।
তবে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাশার আল-আসাদের অবস্থান ও আশ্রয় প্রার্থনার বিষয়ে সরাসরি কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে এখন আমার কাছে বলার মতো কিছু নেই। তবে এটি এমন একটি সিদ্ধান্ত, যা রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদন ছাড়া নেওয়া সম্ভব নয়। এটি তারই সিদ্ধান্ত।'
আসাদ পরিবার ও মস্কোর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১৯ সালে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের একটি তদন্তে দেখা যায়, আসাদের পরিবার সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালীন বিপুল পরিমাণ অর্থ রাশিয়ার মস্কোতে স্থানান্তর করেছে। তদন্তে জানা যায়, তাদের পরিবারের সদস্যরা মস্কোতে অন্তত ১৮টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন।
অন্যদিকে, আসাদের বড় ছেলে হাফেজ বর্তমানে মস্কোতে পিএইচডি করছেন। সম্প্রতি একটি স্থানীয় পত্রিকা তার গবেষণাপত্র নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এদিকে, গত সপ্তাহান্তে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে জানানো হয় যে, মস্কোর কর্মকর্তারা সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীর সাথে আলোচনায় বসেছেন। উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি এবং কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
বাশার আল-আসাদের স্ত্রী আসমা আল-আসাদ একজন দ্বৈত ব্রিটিশ-সিরিয়ান নাগরিক। লন্ডনে জন্ম নেওয়া আসমা পশ্চিম লন্ডনে বেড়ে উঠেছেন এবং সেখানকার একটি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে তিনি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
২০০০ সালে, বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর, আসমা পুরোপুরি সিরিয়ায় চলে আসেন এবং আসাদকে বিয়ে করেন। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের (এলসিই) ভিজিটিং ফেলো ড. নেসরিন আলরেফাই মনে করেন, আসমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট থাকায় তার যুক্তরাজ্যে ফিরে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে বর্তমানে আসমার বাবা-মা মস্কোতে অবস্থান করছেন।
ফাওয়াজ আল-আখরাস, যিনি একজন কার্ডিওলজিস্ট, এবং তার স্ত্রী সাহার, একজন সাবেক কূটনীতিক, মস্কোতে তাদের মেয়ের পাশে থাকতে চান বলে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
আসাদ এবং আসমার তিন সন্তান রয়েছে: বড় ছেলে হাফেজ, যিনি পিএইচডি করছেন; মেয়ে জেইন এবং ছোট ছেলে করিম।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আসাদ পরিবারের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে। তাদের সম্পদ বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট, রিয়েল এস্টেট এবং অফশোর ট্যাক্স হেভেনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাশার ও আসমা সিরিয়ার বৃহৎ অর্থনৈতিক খেলোয়াড়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তাদের কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে অবৈধ কার্যক্রম থেকে অর্থ পাচার এবং সেই তহবিল শাসনব্যবস্থার কাছে পৌঁছে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
আসমা আল-আসাদের প্রভাব ছিল সিরিয়ার অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য গঠিত কমিটিতে। তিনি খাদ্য ও জ্বালানি ভর্তুকি, বাণিজ্য এবং মুদ্রা সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। এছাড়া, আসমা সিরিয়ার পুনর্গঠনকাজে ব্যবহৃত বিদেশি সহায়তার একটি বড় অংশ পরিচালিত 'সিরিয়া ট্রাস্ট ফর ডেভেলপমেন্ট'-এর ওপরও প্রভাব বিস্তার করতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও অভিযোগ করেন, আসমা আসাদ তার পরিবারের সহায়তায় সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জন করেছেন।
সিরিয়ার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাশার আল-আসাদ এবং তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরেই বিচার দাবি উঠছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, ব্যারেল বোমা হামলা, হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, গুম এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
ফ্রান্স ইতোমধ্যেই ২০১৩ সালের রাসায়নিক হামলার ঘটনায় আসাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।
তবে রাশিয়ার আইন অনুযায়ী, তারা তাদের নাগরিকদের অন্য কোনো দেশে প্রেরণ করে না। তাই আসাদ রাশিয়া ছেড়ে এমন কোনো দেশে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, যেখানে তাকে বিচারের মুখোমুখি হতে হতে পারে।