বিখ্যাত ভারতীয় চিত্রশিল্পী এমএফ হুসেনের ‘বিতর্কিত’ ২ চিত্রকর্ম জব্দের নির্দেশ আদালতের
ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি আদালত দেশটির অন্যতম বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হুসেনের দুটি "বিতর্কিত" চিত্রকর্ম জব্দের নির্দেশ দিয়েছে। খবর বিবিসি'র।
সোমবার (২০ জানুয়ারি) আদালত পুলিশকে ওই চিত্রকর্ম দুটি জব্দের অনুমতি দিয়েছে। এক অভিযোগে বলা হয়েছিল, একটি আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত ওই দুটি চিত্রকর্মে দু'জন হিন্দু দেবতার ছবি রয়েছে এবং সেটি "ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে"।
ফিদা হুসেন ২০১১ সালে ৯৫ বছর বয়সে মারা যান। তিনি প্রায়ই তার চিত্রকর্মে হিন্দু দেবতাদের নগ্ন ছবি আঁকার জন্য সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন।
চিত্রকর্মটি প্রদর্শনী করা দিল্লি আর্ট গ্যালারি (ডিএজি) কোনো ভুল কাজের কথা অস্বীকার করেছে। তারা জানিয়েছে, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে "ন্যায়সংগত ও সঠিক সিদ্ধান্ত" আসবে বলে তারা আত্মবিশ্বাসী।
এই চিত্রকর্মগুলো 'হুসেন: দ্য টাইমলেস মডার্নিস্ট' নামের একটি প্রদর্শনীর অংশ ছিল। প্রদর্শনীটি ২৬ অক্টোবর থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএজিতে ১০০টির বেশি শিল্পকর্ম নিয়ে আয়োজন করা হয়।
অভিযোগকারী অমিতা সাচদেবা একজন আইনজীবী। তিনি জানিয়েছেন, ৪ ডিসেম্বর ডিএজিতে প্রদর্শিত "বিতর্কিত চিত্রকর্মের" ছবি তোলেন তিনি। এরপর প্রয়াত শিল্পীর বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী অভিযোগগুলো নিয়ে গবেষণা করে পাঁচ দিন পর পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন।
১০ ডিসেম্বর অমিতা সাচদেবা জানান, তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে গ্যালারিতে যান। সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান, চিত্রকর্মগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, গ্যালারির কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, তারা এসব চিত্রকর্ম কখনও প্রদর্শন করেননি।
অনলাইনে শেয়ার করা চিত্রকর্মগুলোতে হিন্দু দেবতা গণেশ ও হনুমানকে নগ্ন নারী মূর্তির পাশে দেখানো হয়েছিল। অমিতা আরও অভিযোগ করেন, দিল্লি পুলিশ এই বিষয়ে কোনো প্রতিবেদন দায়ের করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রদর্শনীর সময় গ্যালারির সিসিটিভি ফুটেজ সংরক্ষণ করতে তিনি পরে আদালতে আবেদন করেন।
সোমবার দিল্লির পাটিয়ালা হাউজ কোর্টের এক বিচারক জানান, পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তদন্ত অনুযায়ী, প্রদর্শনীটি একটি ব্যক্তিগত স্থানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। শুধু শিল্পীর মৌলিক কাজ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সেটি আয়োজন করা হয়েছিল।
ডিএজি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা পুলিশকে তদন্তে সহায়তা করছে। তারা উল্লেখ করে, প্রদর্শনীটি প্রায় ৫ হাজার দর্শনার্থী আকর্ষণ করেছিল। এটি গণমাধ্যম ও দর্শকদের কাছ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিল।
গ্যালারির ভাষ্যমতে, অভিযোগকারী একমাত্র ব্যক্তি যিনি প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত কোনো শিল্পকর্ম নিয়ে আপত্তি তুলেছেন।
তারা বলেছে, "অভিযোগকারী নিজেই ওই চিত্রগুলোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন সংবাদমাধ্যমে প্রচার করেছেন। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে চিত্রগুলো বড় পরিসরে দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। অথচ একই সময় দাবি করেছেন, এই চিত্রগুলো তার ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে।"
মকবুল ফিদা হুসেন ছিলেন ভারতের অন্যতম বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তাকে "ভারতের পিকাসো" বলা হতো। তবে তার শিল্পকর্ম দেশে প্রায়ই বিতর্ক সৃষ্টি করত। তার চিত্রকর্ম মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে।
এক নগ্ন দেবীর চিত্র আঁকার জন্য কট্টর হিন্দুরা তার প্রতি নিন্দা জানিয়েছিল। অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এতে তার কর্মজীবনে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
২০০৬ সালে ফিদা হুসেন তার আঁকা 'মাদার ইন্ডিয়া' চিত্রকর্মের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চান। সেই চিত্রটিতে এক নগ্ন নারীকে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ভারতের মানচিত্রের আকৃতি তৈরি করতে দেখা যায়। ওই বছরই তিনি দেশ ত্যাগ করেন এবং লন্ডনে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানে বসবাস করেন।
২০০৮ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হুসেনের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি কার্যক্রম শুরু করতে অস্বীকৃতি জানায়। আদালত বলেন, তার চিত্রকর্ম অশ্লীল নয় এবং নগ্নতা ভারতের চিত্রকলার ঐতিহ্য ও ইতিহাসে সাধারণ বিষয়।
সুপ্রিম কোর্ট তখন এক উচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ করে দেন। ওই রায়ে ভোপাল, ইন্দোর ও রাজকোটে হুসেনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যক্রম বাতিল করা হয়েছিল। আদালত ভারতে "নব্য পিউরিটানিজম" বৃদ্ধির নিন্দা জানিয়েছিল।
আদালত হুসেনকে নির্বাসনে থেকে ডেকে তার চিত্রকর্ম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে বলার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তার চিত্রকর্মগুলোর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও জাতীয় সংহতি নষ্ট করার অভিযোগ ছিল।
শীর্ষ আদালত বলেছিলেন, "এমন অনেক বিষয়, ছবি ও প্রকাশনা আছে। আপনি কি সবার বিরুদ্ধে মামলা করবেন? মন্দিরের স্থাপত্যগুলো কীভাবে দেখবেন? হুসেনের কাজ শিল্প। যদি এটি দেখতে না চান, তবে দেখবেন না। মন্দিরের স্থাপত্যেও এমন অনেক শিল্পকর্ম রয়েছে।"
অনেকে মনে করেন, ভারতে শিল্পীসত্তার বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার প্রবণতা বাড়ছে। অক্টোবরে বোম্বে হাইকোর্ট কাস্টমস বিভাগকে ভর্ৎসনা করেছিল। তারা বিখ্যাত শিল্পী এফ এন সুজা ও আকবর পদমসীর চিত্রকর্ম "অশ্লীল উপাদান" হিসেবে বাজেয়াপ্ত করেছিল।
আদালত রায় দেয়, সব নগ্ন বা যৌন বিষয়ক চিত্র অশ্লীল নয়। আদালত সাতটি বাজেয়াপ্ত চিত্রকর্ম ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়।