ছোটবেলায় নেয়া থেরাপি যেভাবে বিল গেটসের জীবন বদলে দিয়েছে
বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তি বিপ্লবের অন্যতম রূপকার বিল গেটসকে আমরা সাধারণত সফটওয়্যার জগতের এক নিরলস উদ্ভাবক ও সমাজসেবী হিসেবেই চিনি। তবে তার বেড়ে ওঠার গল্পটাও ছিল ব্যতিক্রমী।
১০ বছর বয়সে বিল গেটস ছিলেন মেধাবী, তবে ভীষণ জেদি। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে তার মতবিরোধ লেগেই থাকত। একবার রাগান্বিত হয়ে মাকে বলেছিলেন, 'আমি চিন্তা করছি। তুমি কি কখনো চিন্তা করো না? একবার চেষ্টা করো দেখো!'
তখন যদি এডিএইচডি বা অটিজম স্পেকট্রামের নির্ণয়ের সুযোগ থাকত, তবে হয়ত বিল গেটসকেও সেই তালিকায় ফেলা হতো।
বিল গেটসের বাবা-মা তাকে সাপ্তাহিক থেরাপি সেশনে পাঠাতেন ড. চার্লস ক্রেসির কাছে, যা তার চিন্তাভাবনায় পরবর্তীতে গভীর প্রভাব ফেলে।
শৈশবে এই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কীভাবে থেরাপি সেশনগুলো তার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছিল? নিজের নতুন স্মৃতিকথা 'সোর্স কোড'-এর বিশেষ একাংশে তিনি জানিয়েছেন সেই অভিজ্ঞতার কথা—
'আমি আমার বাবা-মার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত,' আমি বললাম ড. ক্রেসিকে।
প্রতি শনিবার সকালে আমার বাবা-মা আমাকে সিয়াটলের ইউনিভার্সিটি ডিস্ট্রিক্টের এক সোনালি রঙের ভিক্টোরিয়ান বাড়ির সামনে নামিয়ে দিতেন। ভেতরে ঢুকে অপেক্ষা করতে হতো, অন্য ক্লায়েন্টদের সেশন শেষ হওয়ার পরই ডাক পড়ত আমার। দেয়ালের ওপাশে আমি শুনতে পেতাম, কিছু দম্পতি নিজেদের দাম্পত্য জীবনের সমস্যা নিয়ে ঝগড়া করত—তারা হয়ত তাদের বিয়ে টেকানোর চেষ্টা করছিলেন। যখন আমি প্রথম যাওয়া শুরু করলাম, তখন ভাবতাম, এই মানুষদের তো সত্যিই বড় সমস্যা আছে। আমি কেন এখানে আছি?
আমাকে একটি জানালার পাশে বসিয়ে ড. ক্রেসি ঘণ্টাখানেক কথা বলতেন। ঘরটি বেশ আরামদায়ক ছিল, যেন কোনো বাসার বসার ঘর। জানালার বাইরে ছিল এক বিশাল গাছ, বসন্ত এলে যেখানে ফুটত সাদা রঙের ফুল।
ড. ক্রেসি ছিলেন অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ও সহজেই মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারা একজন মানুষ। কখনোই মনে হয়নি যে তিনি আমাকে কোনো শিক্ষামূলক উপদেশ দিতে চান। বরং আন্তরিক কৌতূহল নিয়ে আমার কথা শুনতেন—স্কুল কেমন চলছে, মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, আমি কেমন অনুভব করছি। সাধারণত এমন ব্যক্তিগত প্রশ্ন এড়িয়ে যেতাম, কিন্তু তার আন্তরিকতা আমাকে কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করত।
তিনি অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া একজন মানুষ। সোশ্যাল ওয়ার্কে ডিগ্রি নেওয়ার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধবিমানের পাইলট ছিলেন। পরে ওষুধ কোম্পানির বিক্রেতা হিসেবে কাজ করে সেখান থেকে সঞ্চিত অর্থ দিয়ে এই কাউন্সেলিং প্র্যাকটিস শুরু করেন। তবে তিনি নিজের জীবনের গল্প কখনোই বেশি বলেননি, বরং তিনি আমাকেই গল্প বলার সুযোগ দিতেন।
তিনি আমাকে কখনোই বলেননি যে আমার কীভাবে চিন্তা করা উচিত বা আমি কী সঠিক বা ভুল করছি। কোনো অতিরিক্ত ব্যাখ্যা ছাড়াই "তুমি পারবে," বলে আমাকে আশ্বস্ত করতেন। তখন বুঝতে পারিনি, কিন্তু পরে উপলব্ধি করলাম—তিনি আমাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে শেখাচ্ছিলেন।
তিনি তার কাজ নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। সবসময় সাইকোলজি আর থেরাপি নিয়ে নতুন নতুন বই পড়তেন, যাতে সেখান থেকে পাওয়া ধারণাগুলো তার কাউন্সেলিংয়ে কাজে লাগাতে পারেন। এসব বইয়ের কিছু আমাকে পড়তেও দিতেন—জাং, ফ্রয়েড বা অন্য বিশেষজ্ঞদের লেখা, যেগুলো পরে আমরা আলোচনা করতাম। আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় লাগত যে, কিছু মানুষ মানুষের মন ও আচরণ বোঝার চেষ্টা করছে।
কথাবার্তা যত এগোতে লাগল, আমি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করলাম, তিনি ঠিকই বলেছিলেন। আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে যে যুদ্ধের কথা আমি ভাবতাম, সেটি আমি নিজেই জিতব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার স্বাধীনতা বাড়বে, একদিন আমি নিজেই নিজের জীবন গড়ব। কিন্তু আমার প্রতি আমার বাবা-মায়ের ভালোবাসা একই থাকবে। ভাবুন তো, কত দারুণ ব্যাপার—যুদ্ধ জিতব, অথচ তাদের ভালোবাসা হারাব না!
তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, আসলে বাবা-মা আমার শত্রু নন, বরং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে তারা আমার পাশে রয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে ঝগড়া করে সময় নষ্ট করার চেয়ে আমার উচিত হবে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া।
পরে অবশ্য আমি জানতে পারি, ড. ক্রেসির বাল্যকালও বেশ কঠিন ছিল। তিনি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, যার কারণে তার ভেতরে প্রচণ্ড রাগ জমে ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, সেই রাগ পুষে না রেখে ভালোবাসা ছড়ানোর জন্য কাজ করবেন।
তিনি জানতেন, আমার সমস্যাগুলো তার নিজের জীবনের কষ্ট বা অন্য রোগীদের তুলনায় খুব সামান্য। কিন্তু তারপরও, তিনি কখনো আমার অনুভূতিগুলোকে ছোট করে দেখাননি।
একদিন তিনি আমাকে বললেন, 'তুমি ভাগ্যবান ছেলে'। আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম, কিছু বলিনি, কিন্তু মনে মনে জানতাম, তিনি ঠিকই বলেছেন।
বিল গেটসের 'সোর্স কোড: মাই বিগিনিংস' বইটি ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের অ্যালেন লেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে নফ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন