'এ যেন সায়েন্স ফিকশন': পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কোরের আকৃতি বদলে যাচ্ছে, বললেন বিজ্ঞানীরা
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/11/earth_core.jpg)
গত ২০ বছরে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রের (ইনার কোর) আকৃতিতে পরিবর্তন এসেছে বলে জানিয়েছেন একদল বিজ্ঞানী। সাধারণত এটি গোলাকৃতির বলে মনে করা হলেও নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু স্থানে এর প্রান্ত ১০০ মিটার বা তার বেশি উচ্চতায় বিকৃত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন ভিদালে নেতৃত্বাধীন গবেষণায় উঠে এসেছে, কঠিন ইনার কোর এবং তরল ধাতব বাইরের কোরের সংযোগস্থলে এই পরিবর্তন হতে পারে। গবেষণাটি সম্প্রতি ন্যাচার জিওসায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
পৃথিবীর কেন্দ্র মূলত দুটি অংশে বিভক্ত—তরল বাইরের কোর ও কঠিন অভ্যন্তরীণ কোর। ইনার কোরের গতিশীলতা পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে, যা সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে আমাদের রক্ষা করে। যদি এটি বন্ধ হয়ে যায়, তবে পৃথিবীও মঙ্গলগ্রহের মতো প্রাণহীন হয়ে পড়তে পারে।
অভ্যন্তরীণ কোর স্বতন্ত্রভাবে ঘুরতে থাকে, যা বাইরের কোর ও পুরো গ্রহের গতির সঙ্গে সবসময় মিল থাকে না। তবে গবেষকরা দেখেছেন, ২০১০ সালের দিকে এটি পৃথিবীর ঘূর্ণনের তুলনায় ধীরগতিতে চলতে শুরু করেছিল, পরে আবার গতি বাড়ায়।
ভূমিকম্পের ঢেউ বিশ্লেষণে মিলেছে নতুন তথ্য
বিজ্ঞানীরা সরাসরি পৃথিবীর কোরে পৌঁছাতে পারেননি, কারণ এটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার মাইল গভীরে অবস্থিত। তাই ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট শকওয়েভ বিশ্লেষণ করেই কোরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
১৯৯১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে একই জায়গায় সংঘটিত ভূমিকম্পের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ইনার কোরের পরিবর্তনের প্রমাণ পেয়েছেন। অধ্যাপক ভিদালের মতে, বাইরের কোরের তরল প্রবাহ ও অসমান মাধ্যাকর্ষণ টানের ফলে ইনার কোর বিকৃত হতে পারে।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হার্ভোজ টকালসিক, যিনি গবেষণায় সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, একে 'গুরুত্বপূর্ণ ধারণা' বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, গবেষণাটি কোরের সান্দ্রতা (ভিস্কোসিটি) সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারে, যা এখনো বিজ্ঞানের অন্যতম রহস্য।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের মধ্যে সবচেয়ে রহস্যময় ও দূরবর্তী হলো এর অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র। লোহা ও নিকেলের তৈরি এই কঠিন গোলকটির আকার চাঁদের প্রায় ৭০ শতাংশ, এবং এর ব্যাসার্ধ প্রায় ১,২২১ কিলোমিটার।
এই অভ্যন্তরীণ কেন্দ্রে তাপমাত্রা প্রায় ৫,৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, আর চাপ হতে পারে ৩৬৫ গিগাপাস্কাল—যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের গড় বায়ুমানের চেয়ে ৩০ লাখ গুণ বেশি। সরাসরি পর্যবেক্ষণ সম্ভব না হলেও, বিজ্ঞানীরা ভূকম্পনের তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করেন।
ভূমিকম্পের ফলে দুটি ধরনের তরঙ্গ তৈরি হয়—প্রাইমারি (পি) তরঙ্গ, যা ভূমিকে একই দিকে সরায়, এবং শিয়ার (এস) তরঙ্গ, যা তুলনামূলক ধীরগতিতে ভূমিকে তরঙ্গের গতির বিপরীত দিকে সরায়।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, পি তরঙ্গের বিশেষ ধরনের কম্পন অভ্যন্তরীণ কোরের সবচেয়ে উপরের স্তরে বিকৃতি ঘটানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেখানে কঠিন অভ্যন্তরীণ কোর তরল বাইরের কোরের সংস্পর্শে আছে, সেই সীমান্তের উপরের স্তর অপেক্ষাকৃত নমনীয় হতে পারে।
'অভ্যন্তরীণ কোরের পৃষ্ঠে কী ঘটছে, তা কল্পনা করাও প্রায় সায়েন্স ফিকশনের মতো,' বলেছেন গবেষক ভিদালে। 'এটি এমন এক স্থান, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন—সময়, উপাদান ও শক্তির মাত্রা সবই আলাদা। তবুও সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ করেই আমরা সেখানে কী ঘটছে, তা জানতে পারছি।'
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের তরল কোর জমে অভ্যন্তরীণ কোরে পরিণত হচ্ছে। তবে পুরোপুরি কঠিন হতে এখনও কয়েক বিলিয়ন বছর লেগে যাবে। তবে এর আগেই পৃথিবী হয়তো সূর্যের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র বিভিন্ন সময় আকস্মিক পরিবর্তনের শিকার হয়েছে। এই পরিবর্তন ইনার কোরের বিকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত কি না, তা জানতে আরও গবেষণা প্রয়োজন। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এটি পৃথিবীর কোর থেমে যাচ্ছে বলে ভাবার কোনো কারণ নেই। বিজ্ঞানের জগতে নতুন তথ্য সবসময় আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়'।