আপনার পেটে বাস করা ব্যাকটেরিয়া বলে দেবে, আপনার বন্ধু কারা
প্রাচীন চীনা দার্শনিক মেঞ্চিয়াস বহু শতক আগে লিখেছিলেন, "বন্ধুত্ব মানে দুটি দেহে একটি মন।" আধুনিক বিজ্ঞান হয়ত এর সাথে আরও একটি স্তর যোগ করবে– বন্ধুত্ব মানে দুটি দেহে একক মাইক্রোবায়োটা।
সাম্প্রতিক একটি গবেষণা দেখিয়েছে, যত বেশি মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে, ততই তাদের দেহের জীবাণুগুলোর গঠন আরও বেশি মিলে যায়, এমনকি তারা একই বাড়িতে বসবাস না করলেও।
'নেচার'-এ প্রকাশিত এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তির মাইক্রোবায়োম শুধু তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সামাজিক সম্পর্ক দিয়েই প্রভাবিত হয় না, বরং তার বন্ধুদের বন্ধুদের সম্পর্কও এতে প্রভাব ফেলে।
পশ্চিম হন্ডুরাসের জঙ্গলের ভেতরে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ১০ বছর ধরে ১৮টি বিচ্ছিন্ন গ্রামের ১ হাজার ৭৮৭ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের থেকে শারীরিক নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। সকল অংশগ্রহণকারী একটি প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতেন এবং অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য ওষুধের প্রতি সীমিত সংস্পর্শে ছিলেন।
গবেষণার প্রধান লেখক নিকোলাস ক্রিস্টাকিস ব্যাখ্যা করে বলেছেন, "আমরা ভাগ্যবান যে অংশগ্রহণকারীরা সাহায্যকারী এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।" গবেষকরা প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবীর সম্পর্কগুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন ছিল, যা মাদ্রিদ বা নিউইয়র্কের মতো শহরগুলোতে করা অনেক বেশি কঠিন হত। হন্ডুরাসের গ্রামগুলো এই ক্ষেত্রে আদর্শ ছিল।
বার্সেলোনার ভ্যাল ডি'হেবরন জেনারেল হাসপাতালের ডাইজেস্টিভ সিস্টেম রিসার্চ ইউনিটের পরিচালক ফ্রান্সিসকো গার্নার এইভাবে মাইক্রোবায়োটাকে সংজ্ঞায়িত করেন, "এটি ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের একটি সম্প্রদায় যা পেটের অন্ত্রকে উপনিবেশিত করে। আমরা একে মানবদেহের আরেকটি অঙ্গ হিসেবে ভাবতে পারি– এটি এমন এক জৈবিক কার্যক্রমের সেট যা একজন ব্যক্তির টিকে থাকতে জন্য সাহায্য করে।"
যদিও এই "অঙ্গ" আমাদের মধ্যে অবস্থান করে, এটি নিজের নিয়ম এবং শ্রেণিবদ্ধতায় কাজ করে এবং সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
গার্নার বলেন, "এটি খাবার হজমের জন্য অপরিহার্য। এটি আমাদের এমন এনজাইম এবং বিপাকীয় পথ প্রদান করে, যা মানুষের নেই।"
উদাহরণস্বরূপ, মাইক্রোবায়োটার কারণে আমরা ফাইবার হজম করতে পারি। এটি সঠিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা মাইক্রোবায়োটার গঠন বিশ্লেষণ করেছেন যাতে এটি কীভাবে প্রতিটি মানুষের মধ্যে বিকশিত হয়, তা বোঝা যায়। পম্পেউ ফাব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োম রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক মিরেইয়া ভ্যালেস কলোমার-এর মতে, পূর্বে মনে করা হতো যে ভার্টিকাল বা উলম্ব ট্রান্সমিশন (মা থেকে সন্তান) ছিল সবচেয়ে সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।
তিনি বলেন, "আমরা মূলত এই মাইক্রোঅর্গানিজমগুলো আমাদের মায়ের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাই, শিশুর জন্ম এবং স্তন্যপান এর মাধ্যমে। আমরা সেই ব্যাকটেরিয়াগুলোও শেয়ার করি যা আমাদের দাদি আমাদের মাকে দিয়েছিলেন।"
তবে নতুন গবেষণাটি ইঙ্গিত দেয়, মাইক্রোবায়োটা জীবনব্যাপী বিকশিত হয়। সেখানে সামাজিক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। এটিকে বলা হয় হরাইজন্টাল বা অনুভূমিক ট্রান্সমিশন।
গবেষণার প্রধান লেখক নিকোলাস ক্রিস্টাকিস বলেন, "সামাজিক যোগাযোগের মধ্যে মাইক্রোবিয়াল শেয়ারিংয়ের পরিমাণ কতটা, তা জেনে আমরা সত্যিই অবাক হয়েছিলাম আমরা আসলে আপনার বন্ধুদের চিনতে পারি তাদের মল থেকে মাইক্রোবসের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে।"
ডেটা অনুযায়ী, একই বাড়িতে বসবাসকারী ব্যক্তিরা তাদের অন্ত্রের মাইক্রোবিয়াল স্ট্রেনের ১৪ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার করেন। যারা একসঙ্গে বসবাস করেন না, কিন্তু উল্লেখযোগ্য সময় একসঙ্গে কাটান, তারা ১০ শতাংশ শেয়ার করেন।
তবে যারা একই শহরে বসবাস করেন, কিন্তু সীমিত যোগাযোগ রয়েছে, তারা কেবল ৪ শতাংশ শেয়ার করেন। লেখকরা উল্লেখ করেছেন, একটি স্পষ্ট ট্রান্সমিশন চেইন রয়েছে, কারণ বন্ধুর বন্ধুদের মধ্যে মাইক্রোবিয়াল স্ট্রেনের শেয়ারিং এমনভাবে ঘটে, যা ধারণা করা যায় না।
প্রবাহের পদ্ধতি
এই গবেষণার একটি প্রশ্ন হলো, কীভাবে ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেইনগুলো এক মাইক্রোবায়োটার থেকে অন্য মাইক্রোবায়োটায় স্থানান্তরিত হয়। মাইক্রোবায়োম রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক মিরেইয়া ভ্যালেস কলোমার বলেন, "আমাদের কাছে এ প্রশ্নের চূড়ান্ত উত্তর নেই, এই ট্রান্সমিশন কীভাবে ঘটে।"
তিনি বলেন, "যা ধারণা করা হয় তা হলো, যেটি অন্ত্রে পৌঁছায় তা মুখ দিয়ে যেতে হবে। মাইক্রোবায়োটার অনেক ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেনের সংস্পর্শে খুব বেশি সময় থাকতে পারে না। তাই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রয়োজন। তবে আমরা জানি না এটি কীভাবে ঘটে।"
তবে, গার্নার ব্যাখ্যা করেন, "ফিকাল-ওরাল রুট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ট্রান্সমিশন ভেক্টর মনে হয়।" অন্য কথায়, যদিও আমরা বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখি, আগের গবেষণাগুলোর মাধ্যমে জানা গেছে অন্ত্রে সাধারণত পাওয়া যায় এমন ব্যাকটেরিয়াগুলো হাতেও উপস্থিত থাকে। এর মাধ্যমে তারা শেষ পর্যন্ত মুখে পৌঁছায়।
কিছু ব্যাকটেরিয়া অন্ত্র থেকে যাত্রা করতে সফল হয় স্পোরের আকারে, যা ছত্রাকের স্পোরের মতো। "এই ট্রান্সমিশন পদ্ধতিতে সরাসরি যোগাযোগ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হতে হবে না। এটি তোয়ালে বা পোশাকের মাধ্যমে ঘটতে পারে," ব্যাখ্যা করেন গুয়ার্নার।
এটি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। এই মাইক্রোঅর্গানিজমের স্থানান্তর অনেকভাবে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। আসলে, মাইক্রোবায়োটা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নতুন গবেষণা নির্দেশ করছে, একটি স্বাস্থ্যকর এবং সুষম মাইক্রোঅর্গানিজমের সম্প্রদায় আমাদের বিভিন্ন দিক থেকে সুস্থতার উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
কিছু গবেষক মাইক্রোবায়োটা এবং নন-কমিউনিকেবল রোগগুলোর [এমন রোগ যা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমিত হয় না] মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন, যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং এমনকি বিষণ্নতা। গার্নার ব্যাখ্যা করেন, "এটি এখনও কিছুটা অনুমান করা। তবে যা সাধারণত লক্ষ্য করা হয় তা হলো, এই রোগগুলো একটি অসম্পূর্ণ মাইক্রোবায়োটার সঙ্গে সম্পর্কিত।" ভ্যালেস যোগ করেন, "এটি লক্ষ্য করা গেছে যাদের 'আধুনিক রোগ' রয়েছ, তাদের মাইক্রোবায়োটার গঠন পরিবর্তিত হয়েছে।"
তবে, এটি এমন নয় যে একটি নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া এই রোগগুলোর জন্য দায়ী। বরং এটি মাইক্রোবায়োটার অভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যের মোট ক্ষতি, যা স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে গবেষণাটি আরও অনুসন্ধানের দরজা খুলে দেয় এবং নিশ্চিত করে, এই নন-কমিউনিকেবল রোগগুলোতে আসলেই কোনও ট্রান্সমিশন ফ্যাক্টর থাকতে পারে।
যদি একটি পুরো সম্প্রদায় দুর্বল মাইক্রোবায়োটার শিকার হয়, তবে এই রোগগুলো সেই জনগণের মধ্যে আরও সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভ্যালেস বলেন, "আমরা আগে জানতাম যে সামাজিক পরিবেশ সাধারণ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, এটি আমাদের মাইক্রোবায়োটা গঠন করতে সাহায্য করে এবং এটি এমন কিছু যা আমরা আর উপেক্ষা করতে পারি না। আমরা মানুষকে এককভাবে অধ্যয়ন করতে পারি না, বরং যে সম্প্রদায়ে তারা অংশগ্রহণ করছে, সেটিকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।"