নিয়ম মানলে এত হতাহত হতো না: বিএম ডিপোর ৪ ভুল তদন্ত প্রতিবেদনে
সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে ডিপো কর্তৃপক্ষের প্রধান চারটি ভুলের কথা বলা হয়েছে। এ চার কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে জানালেও অগ্নিকাণ্ডের স্পষ্ট কোন কারণ জানাতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব, অগ্নি নিরাপত্তার জন্য ফায়ার হাইড্রেন না থাকা ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে জানানো হয় চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল ম্যানেজার কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে। সম্প্রতিই এ প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হয়।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএম কনটেইনার ডিপোতে ক্যামিকেলসহ বিপজ্জনক পণ্যের কনটেইনার এবং পোশাকসহ অন্য রপ্তানিবাহী পণ্যের কনটেইনার একসঙ্গে রাখা হতো।
'নিয়ম মেনে বিপজ্জনক পণ্য আলাদা রাখা হলে এত মানুষ হতাহত হতো না', একই সঙ্গে ধোঁয়ার সূত্রপাত হওয়ার সময়ই নির্দিষ্ট একটি কনটেইনারটি নিরাপদে সরিয়ে নিতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেত না বলেও জানানো হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটি গঠনের তিন সপ্তাহ পর গত মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান বিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহানের কাছে ২৪ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।
তবে প্রতিবেদনে ধোঁয়ার কুণ্ডলী কিভাবে শক্তিশালী বিস্ফোরণে রূপান্তরিত হলো তার কোনো কারণ ব্যাখ্যা করা হয়নি। আগুনের সূত্রপাত হিসেবে সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা, কেমিক্যাল ভর্তি জার ও নাশকতার বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রিপোর্টের বিষয়ে আমরা এখনই কিছু বলতে চাই না। এটা আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হবে। তবে তদন্ত কমিটির যে সব সুপারিশ উঠে আসবে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকাতে সে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বিএম ডিপোয় বিস্ফোরণের জন্য ডিপো মালিকের আরেক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যালকেও দায়ী করা হয়েছে। আল রাজী কেমিক্যাল স্মার্ট গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের চালানগুলোর রপ্তানি নিয়ে জটিলতা ছিল। দুর্ঘটনার আগেই ২ জুন এসব কনটেনার ডিপো থেকে কারখানায় নেওয়ার কথা ছিল। সেটি তারা করেনি।
এছাড়া আবার হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড যেসব জার কনটেইনারে রাখা হয়েছিল সেগুলো আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন ছিলো না। বিপজ্জনক পণ্য পরিবহণে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন জার ব্যবহার বাধ্যতামূলক হলেও আল রাজী কেমিক্যাল তা করেনি। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি দায়দায়িত্ব এড়াতে পারে না বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়।
রিপোর্টে জানানো হয়, ডিপোতে আল রাজী কেমিক্যালের হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডবাহী ৩৭টি কনটেইনার ছিল। বিস্ফোরণের পরও ১২টি কনটেইনার অক্ষত রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্মার্ট গ্রুপের জিএম মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তারা এখনো রিপোর্ট পাননি।
'তবে যেভাবে ঢালাও ভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে তার কিছুটা সত্য আবার কিছুটা সত্য না। ক্যামিকেলবাহী কনটেইনার যেখানে রাখা হয়েছিলো সেখানে যেভাবে পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিলো সেটার অভাব ছিলো। ডিপোতে অগ্নি নির্বাপনের জন্য একটি প্রশিক্ষিত ফায়ার ইউনিটের অধিনে ১৭৭ টা ফায়ার স্টিংগুইসার ছিলো। এছাড়া দুটি জলাধারও আছে ডিপোর ভেতরেই।'
বন্দর কর্তৃপক্ষের চার শুপারিশ
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- কেমিক্যাল ভর্তি কনটেইনার আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা, কেমিক্যাল রাখার সক্ষমতা সম্পন্ন ডিপোতে কেমিক্যাল রাখার অনুমতি নেওয়া, ডিপোকে ধূমপান মুক্ত এলাকা ঘোষণা করা এবং অগ্নিনির্বাপণে সব বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি উপযুক্ত ডিপো নির্দিষ্ট করে সেখানে সব ধরনের আমদানি-রপ্তানিতব্য ডিজি কার্গো কিংবা রাসায়নিক পণ্য হ্যান্ডলিং করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সে ডিপোয় রাসায়নিক পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের নিরাপত্তাবিষয়ক সব ধরনের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। আর তা করা না গেলে অন্তত প্রতিটি ডিপোয় আলাদাভাবে বিপজ্জনক রাসায়নিক পণ্য হ্যান্ডলিং ও এর ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
ডিপোগুলোর কাছাকাছি অঞ্চলে যেসব ফায়ার স্টেশন রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে এমন কোনো চুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে, যার মাধ্যমে ডিপোরে কর্মীদের নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ ও মহড়ার আয়োজন করা যায়। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার গুরুত্বও তুলে ধরা হয়েছে।
অন্য সংস্থাগুলো কী বলছে
বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশন, জেলা প্রশাসন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর ছয়টি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল।
গঠিত ছয় কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য তিন থেকে সাত দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিস্ফোরণের প্রায় একমাস পূর্ণ হলেও একমাত্র বন্দর কর্তৃপক্ষ ছাড়া অন্য কোনো কমিটিই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, 'রোববার আমাদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কিছু ল্যাব টেস্টের রিপোর্ট হাতে না পাওয়ায় প্রতিবেদন জমা দেওয়া যায়নি। দ্বিতীয় দফায় আবারও সময় চেয়েছি। আশা করছি, এই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।'
চট্টগ্রাম কাস্টমস গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য কাস্টমসের সহকারী কমিশনার উত্তম চাকমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'তদন্ত কমিটির বেশ কয়েকটি মিটিংয়ে ছিলাম। সেখানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ক্যামিক্যাল বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড এই দুর্ঘটনার মূল কারণ নয়, সম্ভবত অন্য জায়গা থেকে আগুন ছড়িয়েছে।
'সেখান থেকে দীর্ঘ সময় আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় উচ্চ তাপে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডবাহী কনটেইনার বিস্ফোরিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ক্যামিকেল মজুদের নীতিমালা মানেনি ডিপো কর্তৃপক্ষ।'
গত ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে আগুন থেকে বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ৪৯ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আড়াই শতাধিক মানুষ।