রহস্যঘেরা রোলস রয়েস কাহিনী
ঢাকায় ২৭ কোটি টাকা দামের একটি নতুন রোলস রয়েস জব্দ করা নিয়ে রীতিমতো ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটে গেছে ব্যবসায়ী মহলে। গাড়িটির আমদানিকারকের কাছে সব আইনি কাগজপত্র থাকায় এই ঘটনা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
অনন্ত গ্রুপের একটি কৌশলগত ব্যবসায়িক ইউনিট জেএন্ডজে ইন্টিমেটস লিমিটেড প্রায় আড়াই মাস আগে যুক্তরাজ্য থেকে গাড়িটি আমদানি করে।
বুধবার কাস্টমস গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা গাড়িটি রাজধানীর বারিধারা থেকে আটক করে।
আটকের পর সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, গাড়িটি অবৈধভাবে চট্টগ্রামের ইপিজেড থেকে সরিয়ে এনে রাজধানীর বারিধারায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
তারা আরো বলে, এতে প্রায় ২৪ কোটি টাকা রাজস্ব হানির চেষ্টা করা হয়েছে। আকারে ইঙ্গিতে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়, প্রতিষ্ঠানটি শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, আমদানিকারক নিয়ম মেনে আমদানি করার পরও আড়াই মাসেও শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারলোনা কেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ?
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আমদানিকারক নিয়ম মেনে এবং বাংলাদেশ এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন অথরিটি (বেপজা) এর অনুমতি নিয়েই গাড়িটি আমদানি করেছে।
এছাড়া, শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা গাড়িটি পরীক্ষা করে এক সপ্তাহের মধ্যে ডিউটি অ্যাসেসমেন্ট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা মৌখিকভাবে জানালেও আসলে তা করা হয়নি।
আমদানি পারমিটে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, গাড়ির প্রবেশের বিল নিবন্ধন করা হয় ২৭ এপ্রিল, এবং পণ্যটির ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন সম্পন্ন হয় ১২ জুন।
টিবিএস দেখেছে, গাড়িটি নিয়ম মেনে এবং বেপজার অনুমতি নিয়ে আমদানি করা হয়েছিল বিধায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস আইনের অধীনে আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা।
যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার এম ফখরুল আলম টিবিএসকে বলেন, গাড়িটির আমদানিকারকের দলিপত্র ঠিকই ছিলো।
কাস্টমস আইনের বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ইজিডেজভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক ২০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি আমদানি করতে পারেন। আর সেটি যদি এসইউভি হয়, সেক্ষেত্রে সিসি'র বিষয়টি আইনে উল্লেখ নেই।
আইনি বিধান তুলে ধরে তিনি বলেন, "ইজিজেডভুক্ত প্রতিষ্ঠান বেপজার কাছ থেকে ইমপোর্ট পারমিট (আইপি) নিয়ে নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়ি আমদানি করতে পারে। ইপিজেড এর প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমদানিকৃত একটি কন্টেইনারের সব পণ্য যদি একই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের হয়, তা বন্দরে শুল্কায়নের বদলে কন্টেইনার ইপিজেডে নিজস্ব বন্ডেড ওয়্যারহাউজে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।"
পরবর্তীতে কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা ইপিজেড এ গিয়ে ওই পণ্য (যেমন গাড়ি) অ্যাসেসমেন্ট করে ডিউটি হবে কিনা, কিংবা হলে তার পরিমাণ উল্লেখ করে অ্যাসেসমেন্ট নোটিশ দেন।
"আমদানিকারক এই নোটিশের ভিত্তিতে কার্যক্রম সম্পন্ন করার পর কাস্টমস বিভাগ রিলিজ অর্ডার দেয় এবং পরবর্তীতে ইপিজেড থেকে গাড়িটি নেওয়ার অনুমতি পায়। গাড়ি সমেত কন্টেইনারের সব পণ্য জেএন্ডজে এর হওয়ায় গাড়িটি বন্দর থেকে ইপিজেডে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়," বলেন তিনি।
বেপজা থেকে দেওয়া আইপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, গাড়িটির সিসিসহ উল্লেখ করে বেপজা থেকে আইপি নিয়ে আমদানি করা হয় এবং তা ইপিজেডে নিয়ে আসা হয়। যথারীতি কাস্টমস বিভাগের কর্মকর্তারা গাড়িটি অ্যাসেস করার পর এক সপ্তাহের মধ্যে অ্যাসেসমেন্ট নোটিশ এবং রিলিজ অর্ডার দেওয়ার কথা মৌখিকভাবে জানান। গত এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখে গাড়িটি আমদানি করার পর এতদিনেও তা হয়নি।
কেন দেরি হলো, এর ব্যাখ্যায় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে বেপজার দেওয়া আইপি পরীক্ষার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু তা অনলাইনে না হওয়ায় সময়মত তথ্য পাওয়া যায়নি।
"জেএন্ডজে ইন্টিমেটস নামের প্রতিষ্ঠানটির মূল কোম্পানি ছিলো আদি টাওয়েল, যা ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। আদি টাওয়েলকে জেএন্ডজে ইন্টিমেটস ২০১৭ সালে ক্রয় করে," বলেন তিনি।
"কাস্টমস বিভাগের বিদ্যমান আদেশ (স্ট্যাচুটোরি রেগুলেটরি অর্ডার/ এসআরও) অনুযায়ী, ২০০৯ সালের আগে ইপিজেডের প্রতিষ্ঠিত হওয়া কারখানা একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ও নির্দিষ্ট সিসির গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।"
যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি ২০০৯ সালের পরে হস্তান্তর হয় (২০১৭ সালে), এবং মালিকানা ও নামও পরিবর্তন হয়; ফলে তারা গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে কিনা তাও একটি ইস্যু, বলেন তিনি।
কমিশনার বলেন, "এ বিষয়ে এনবিআরের মত চেয়ে আমরা এনবিআরকে চিঠি পাঠাই। ওই মতামত এখনো পাওয়া যায়নি বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া যায়নি।"
দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "প্রয়োজন হলে যৌক্তিক দেরি হতেই পারে। এমন পরিস্থিতিতে পণ্যটি দ্রুত রিলিজ করার প্রয়োজন হলে প্রভিশনাল অ্যাসেসমেন্ট এর আবেদন করা কিংবা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হয়। তা না করে তারা তাদের জিম্মায় থাকা গাড়িটি ইপিজেড থেকে সরিয়ে ফেলেন, যা বেআইনি।"
তিনি বলেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের প্রধান শরীফ জহির বুধবার তার সঙ্গে দেখা করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগেই গাড়িটি সরানো ভুল হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন।
আমদানিকারকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে জানান, "মালিকানা পরিবর্তন হলেও এনটিটি পরিবর্তন হয়নি, অর্থাৎ তা আদি টাওয়েল নামেই রয়েছে। এখনো বন্ড লাইসেন্স আদি টাওয়েল নামেই।"
"বেপজা এসব স্ক্রুটিনি করেই আইপি দিয়েছে। ফলে এই গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রাপ্য এবং এই প্রক্রিয়া শেষ হতে এত সময় লাগার কথা নয়।"
এদিকে, একসময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সাবেক এনবিআর সদস্য লুৎফর রহমান টিবিএসকে বলেন, "এসআরও সুবিধা বর্তমানে বহাল থাকলে এবং বেজপার আইপিতে বিস্তারিত উল্লেখ থাকলে আমদানিকারকের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার কথা। ২০০৬ সালের একটি এসআরও'র আওতায় সংসদ সদস্যরা এখনো গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনতে পারেন।"
তবে কাস্টমস বিভাগের আউট পাস বা রিলিজ অর্ডার ছাড়া গাড়িটি ছাড় করা আইনসিদ্ধ নয় বলে যোগ করেন তিনি।
অন্যদিকে, এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের সাবেক একজন কর্মকর্তা এ বিষয়টি নিয়ে এত শোরগোল হওয়া এবং কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স কর্তৃক কাউকে শুল্ক ফাঁকিবাজ সাব্যস্ত করতে উঠেপড়ে লেগে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
জানা গেছে, আমদানিকারক চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের কমিশনার ছাড়াও ঢাকায় কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
তারা বলেছেন, এনবিআরের মতামত পাওয়ার পর কোনো শুল্ক না হলে অবৈধভাবে সরানোর জন্য আইনগত জরিমানা করে গাড়িটি হস্তান্তরে আইনি উদ্যোগ নেওয়া হবে। বর্তমানে গাড়িটি ঢাকা কাস্টমস হাউজের জিম্মায় রাখা হয়েছে।
এদিকে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার শেষ বেলায় তারা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের রোলস রয়েস গাড়ির বিষয়ে চিঠি পেয়েছেন, যা গত ৫ জুন এনবিআরে পাঠানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআর একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "হয়তো তারা লিগ্যালি এই সুবিধা পায়। এই সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজই দিতে পারতো। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো অনুমতি না পেয়েই গাড়িটি বের হয়ে গেল কীভাবে? এর সঙ্গে কেউ (কাস্টম হাউজের কোনো কর্মকর্তা) জড়িত রয়েছে কিনা, তা আমরা তদন্ত করবো।"
বেপজার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, বৃহস্পতিবার ইস্যুটি নিয়ে বেপজায় আলোচনা হয়েছে। বেপজার রুলস পারমিট করেছে বলেই বেপজা থেকে ৬৭৫০ সিসির গাড়িটি আমদানির আইপি দেওয়া হয়েছে।
তবে তিনি বলেন, কাস্টমসের দুই গ্রুপের মধ্যে (চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ও কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স এন্ড ইনভেস্টিগেশন ডাইরেক্টরেট) ইন্টারপ্রিটেশনে সমস্যা থাকায় এ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে ৪৫০০ সিসির উপরে একটি গাড়ির ডিউটি-ট্যাক্সের পরিমাণ ৮২৫ শতাংশ। সেই হিসেবে রোলস রয়েসের একটি গাড়ির দাম যদি তিন কোটি টাকা বা এর কাছাকাছি হয়, সেক্ষেত্রে এর শুল্ককর আসবে প্রায় ২৪ কোটি টাকা এবং গাড়ির দাম হবে ২৭ কোটি টাকার মত।