রোলস-রয়েস, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজসহ ৪০ বিলাসবহুল গাড়িতে ৫০০ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি
বাংলাদেশে বর্তমানে বিলাসবহুল রোলস-রয়েস ব্রান্ডের ১০ থেকে সর্বোচ্চ ১১টি গাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে চারটি। তেলে চালিত এসব গাড়ি বৈদ্যুতিক গাড়ি হিসেবে বন্দর থেকে খালাস নেওয়ায় ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকার শুল্ক নেমে আসে মাত্র ৪ কোটি টাকায়।
প্রতিটি গাড়িতে সর্বনিম্ন ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিলেও এই চারটি গাড়িতে অন্তত ১২০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম এই চারটি রোলস-রয়েস গাড়ি আমদানির বিষয়ে তদন্ত করছে।
শুধু এই চারটি গাড়িই নয় ২০১৫ সাল থেকে এ পযৃন্ত নামিদামি ব্রান্ডের অন্তত ৪০ টি গাড়িতে জালিয়াতি করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত করছে শুল্ক গোয়েন্দা। চট্টগ্রাম এবং মোংলা সমুদ্র বন্দর দিয়ে আমদানি হয় বিএমডব্লিও, মার্সিডিজ বেঞ্জ, অওডি, নিশান সাফারি, নিশান জিটিআর ব্রান্ডের এসব গাড়ি। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে তিনটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দও করা হয়েছে।
কাস্টসম গোয়েন্দা এবং তদন্ত অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা চারটি রোলস-রয়েস গাড়ির বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধানের কাজ চলছে। তেলে চালিত একটি রোলস-রয়েস গাড়ির শুল্ক ৩৫ থেকে ৪০ কোটি টাকা। বৈদ্যুতিক গাড়ি হিসেবে এর শুল্কায়ন করা হলে শুল্ক নেমে আসে মাত্র চার কোটি টাকায়। সর্বনিম্ন ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিলেও এই চারটি গাড়িতে অন্তত ১২০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে।
চল্লিশটি গাড়ির মধ্যে বাকি ৩৬ টি গাড়িতে গড়ে ১০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি হলেও ৩৬০ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি হয়েছে। সব মিলিয়ে ৪০ টি গাড়িতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
কাস্টমস গোয়েন্দা এবং তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মিনহাজ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম এবং মোংলা সমুদ্র বন্দর নিয়ে আমদানি করা ৪০ টি গাড়ির আমদানি তথ্য চেয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসগুলোকে চিঠি দিয়েছি। আন্ডার ইনভয়েসিং, গাড়ির মডেল, সিরিজ পরিবর্তন করে এসব গাড়ি খালাস নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসগুলোর তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তীতে এসব গাড়ি আমদানিকারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কাস্টমস জানিয়েছে, গাড়ি আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় সর্বোচ্চ ৮২৭ শতাংশ। অর্থাৎ একটি গাড়ির ক্রয়মূল্য ১ কোটি টাকা হলে এটি খালাসে কাস্টমসে ৮ কোটি ২৭ লাখ টাকা শুল্ক দিতে হয়।
সিসি এবং হাইব্রিড, নন হাইব্রিড গাড়ি ভেদে শুল্কের তারতম্য রয়েছে। শুল্ক ফাঁকি দিতে গাড়ির ম্যানুফ্যাকচারিং ইয়ার থেকে মডেল নম্বর পরিবর্তন করে গাড়ি খালাস করছে একটি অসাধু চক্র। আবার গাড়ির যন্ত্রাংশ আমদানির ঘোষণা দিয়ে বদলে নিয়ে আসছে বিলাসবহুল গাড়ি।
এর আগে গত ২৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী এলাকায় একটি ভবনের গ্যারেজ থেকে বিলাসবহুল নিশান সাফারি ব্র্যান্ডের গাড়ি জব্দ করে কাস্টমসের গোয়েন্দা দল। আমদানির নথিপত্র না থাকায় শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে সন্দেহে গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। গাড়িটির আনুমানিক শুল্ককর ১০ কোটি টাকা।
৫ হাজার ৬০০ সিসির নিশান জিপগাড়িটির গায়ে লেখা 'নিশান পেট্রোল'। নিশান পেট্রোল হিসেবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) থেকে নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে। তবে গাড়ির চেসিস নম্বর দিয়ে অনলাইনে সার্চ করা হলে দেখা যায়, গাড়িটি 'নিশান সাফারি' ব্র্যান্ডের। এই ব্র্যান্ড নিশান পেট্রোল থেকে আরও উন্নতমানের।
এর ১২ দিন আগে রাজধানী ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে বিএমডব্লিউ সেভেন সিরিজের একটি গাড়ি জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। ওই গাড়িও মিথ্যা ঘোষণায় জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানি করা হয়। পরপর দুটি গাড়ি জব্দের ঘটনায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে জালিয়াতির বিষয়টি উঠে এসেছে। এ দুটি গাড়ি আমদানির বিপরীতে প্রায় ২০ কোটি টাকার মতো শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ দেওয়ান টিবিএসকে বলেন, ২০২৩ সালের শেষ দিকে রোলস-রয়েস ব্রান্ডের তেল থেকে ইলেকট্রিক করার পর বাংলাদেশে কিছু গাড়ি আমদানি হয়েছে। এসব গাড়ি খালাসের ক্ষেত্রে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান জালিয়াতির আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এছাড়া অন্যান্য বিলাসবহুল গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রেও যদি কেউ প্রতিষ্ঠান শুল্ক ফাঁকির সাথে সম্পৃক্ত থাকে তাদের বিরুদ্ধে কাস্টম গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিতে পারে।
এসব জালিয়াতির ক্ষেত্রে কাস্টমসসের সংশ্লিষ্ট রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কাস্টমসের যোগসাজশ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা ঘটার সুযোগ কম। এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে কাস্টমস বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সানক) চট্টগ্রাম মহানগরের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, দেশের সর্বত্রই দুর্নীতির আখড়া। কাস্টমসও এর ব্যতিক্রম নয়। কাস্টমসের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এভাবে বিলাসবহুল গাড়ি ছাড় করিয়ে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যাংকের ঋণখেলাপিরাই এ ধরনের জালিয়াতির সাথে জড়িত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই।