চলছে গাড়ি চাকার স্কুলে...
ঘড়িতে সময় তখন সকাল ১০টা ছুঁই ছুঁই। চোখেমুখে একরাশ আনন্দ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এসে বাসের দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল পাঁচ কী ছয়বছরী একটি শিশু। একটু এগিয়ে যেতেই শিশুটি ঘুরে পেছনে তাকালো। নাম জিজ্ঞাসা করতেই হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেয়ে হেসে উত্তর দিলো, 'আমার নাম নিতামনি, আমি এই চাকার স্কুলে পড়ি'। কথা বলা শেষ করে মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই লাফিয়ে বাসে উঠে নিজের জায়গা দখল করে নিলো সে। তারপর অপেক্ষা করতে থাকে বাকি বন্ধুদের জন্য; সবাই এলে বাসের ভেতর শুরু হবে পড়াশোনা।
'চাকার স্কুল' শুনতেই কেমন একটা অদ্ভুতগোছের লাগছে তাই না? এ আবার কেমন স্কুল, যে স্কুলে শিশুদের আসতে হয় না বরং স্কুলই শিশুদের কাছে যায়! হ্যাঁ এমন স্কুলও রয়েছে শহরতলীর বুকে। মিরপুর দিয়াবাড়ি থেকে একটু এগিয়ে গেলেই নজরে পড়বে চার চাকার উপর চলমান বাসের স্কুল, যেখানে বাসের ভেতরেই পড়ানো হয় নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের। বাইরে থেকে বাসটিকে দেখলে মনে হবে এটি বুঝি কোনো স্কুলের স্কুল বাস। কিন্তু আদতে রঙিন স্টিকারে মোড়ানো বাসটি অনেক শিশুর স্বপ্নের হাতেখড়ি। অর্থের অভাবে যেসব অভিভাবক শিশুদের পড়াতে পারেন না তাদের চোখে রঙিন স্বপ্ন বুনতে কাজ করে যাচ্ছে চাকার স্কুল।
বাসের স্কুল চাকার স্কুল!
চাকার স্কুলের বাহ্যিক সৌন্দর্য একেবারে অন্যরকম। বাসের গায়ে রং-তুলি, বই, স্কেল, পেন্সিল, গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ দিয়ে মুড়িয়ে লেখা চাকার স্কুল। পাশে মুখে নির্মল হাসি নিয়ে ব্যাগ কাঁধে দণ্ডায়মান একটি শিশু।
বাইরে থেকে সাধারণ বাসের মতো দেখতে লাগলেও চাকার স্কুলের ভেতরের চিত্র একেবারেই অন্যরকম। বাসের চালকের বসার পেছনের স্থানে অর্থাৎ যাত্রী বসার স্থানে তৈরি করা হয়েছে বিশেষায়িত ক্লাসরুম। পরিপাটি সেই ক্লাসরুমে শিশুদের জন্য আগেই সাজানো আছে বসার জায়গা, খাতা, কলম-পেন্সিল, মাস্ক, পানি খাওয়ার ফ্লাক্স। চিরচেনা শ্রেণিকক্ষের মতো এক পাশে সাজানো আছে হাজিরা খাতা আবার সামনে আছে হোয়াইট বোর্ড, মার্কার ডাস্টার। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যালয়ে যা যা থাকে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
আনন্দের সাথে পড়াশোনা
সকাল ১০টার পরেই প্রবল উচ্ছ্বাস নিয়ে বাসের সামনে হাজির হয় পাঁচ থেকে সাত বছর বয়সী শিশুরা। এখানে গৎবাঁধা পড়াশোনা নেই, আছে আনন্দের সাথে পড়াশোনা। সারি বেঁধে বাসের সামনে হাজির হওয়ার পর তাদেরকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুলের ভেতরে ঢুকতে হয়। করোনাকালে ক্লাসে ঢোকার পর শিশুদের আসন গ্রহণ করার পর বলা হয় মাস্ক পরার কথা, পাশাপাশি স্প্রে স্যানিটাইজার ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের করা হয় জীবাণুমুক্ত। মহামারীর কারণে তাদের ক্লাসরুমে দূরত্ব মেনেই বসতে হয়; দুপাশে মুখোমুখি বসে ক্লাস করতে হয় তাদের। এরপর হাজিরা খাতার মাধ্যমে নাম ডাকার পরেই শুরু হয় ক্লাস।
শ্রেণিকক্ষের দুপাশে সাঁটানো আছে স্বরবর্ণ, ব্যাঞ্জনবর্ণ, বাংলাদেশের মানচিত্র সমেত পর্দা। শ্রেণিকক্ষের একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে শিশুদের শেখানোর জন্য বিশ্বের কোন মহাদেশে কোন পশুপাখি পাওয়া যায় তার মানচিত্রও পর্দার মাধ্যমে ঝুলানো আছে। পাঠপর্ব শুরু হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা সমস্বরে পড়তে শুরু করে সপ্তাহের সাতদিনের নাম। শনিবার...রবিবার পড়া শেষ হওয়ার পর শুরু হয় বাংলাদেশের পতাকা আঁকার কাজ। যেসব শিক্ষার্থীরা পতাকা আঁকতে পারছিলো না, তাদের হাতে ধরে আঁকা শেখাচ্ছিলো শিক্ষক। আঁকা শেষে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছিলো রং। রঙের আলোয় হাসিমুখে লাল সবুজ রং দিয়ে খাতা আলোকিত করছিলো শিশুরা।
এখানে শিশুরা পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছবি আঁকে, নিজেদের মধ্যে নাটক করে এবং করানো হয় শরীরচর্চা। কোনোকিছুই যাতে মানসিক চাপ সৃষ্টি না করে তা লক্ষ্য রাখে শিক্ষকেরা।
চাকার স্কুলের পাঠ্যবস্তু
চাকার স্কুলের পাঠ্যবস্তুও বেশ দারুণ। সরকারের গাইডলাইন অনুযায়ী এনসিটিবি কারিকুলাম অনুসারেই শিশুদের পড়ানো হয়। যদিও প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারের কোনো স্থায়ী কারিকুলাম নেই, তাই চাকার স্কুল শিশুদের জন্য নিজেরাই কারিকুলাম তৈরি করেছে। এই কারিকুলাম তৈরির কাজও বেশ চমকপ্রদভাবে করা হয়েছে। চাকার স্কুল পাইলটিং প্রজেক্ট চলাকালীন সময়ে নিম্নবিত্ত পরিবারের বা পথশিশুদের বিহেভ্যারিয়াল স্টাডি, ইমোশনাল স্টাডি পর্যালোচনা করেছে। তারা কোন বিষয়ে কীভাবে সাড়া দেয় বা কোন বাচ্চার সাথে কীভাবে কথা বললে সে রিএক্ট করে তার উপর ভিত্তি করেই কারিকুলাম তৈরি করা হয়েছে। তারপর কিছু বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলে সেগুলো অনুমোদিত করা হয়েছে।
যাত্রা শুরুর গল্প
'চাকার স্কুল' মূলত ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন দ্বারা পরিচালিত একটি প্রকল্প। ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা আদনান হোসেইনের শিশুদের নিয়ে কাজ করার প্রাথমিক চিন্তাভাবনা মাথায় আসে ২০০৯ সালে। তিনি বলেন, 'আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তখন। উত্তরবঙ্গে একটি শীতকালীন ক্যাম্পেইন চলাকালীন সেখানকার কিছু পরিবারের সাথে কথা বলার পর জানতে পারি ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় না কারণ তারা যেখানে কাজ করে সেখান থেকে সপ্তাহে ৮০ টাকা বেতন পায়। সপ্তাহে ৮০ টাকা পায় এটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম তখন। স্কুলে গেলে টাকা উপার্জন বন্ধ হয়ে যাবে এমন চিন্তাভাবনা থেকে অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে পাঠাতো না'।
শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষা না পেয়ে কাজ করবে তা মানতে অনেক কষ্ট হয়েছিলো আদনানের। এরপর প্রায় ছয় মাস পরিকল্পনার পর ২০১০ সালের ৪ জুন ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য ছিলো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য পড়াশোনার ব্যবস্থা করা। প্রাথমিক পর্যায়ে ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনকে কোনো প্রতিষ্ঠান হিসেবে রূপ দেয়ায় চিন্তা আদনানের ছিলো না, একদম ব্যক্তিপর্যায় থেকেই কাজ শুরু করেছিলো এই তরুণ। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭ জন বাচ্চা নিয়ে সৈয়দপুর, নীলফামারিতে একটি বাসার বারান্দায় বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করেন। প্রতিদিন দু ঘন্টা ধরে ১৭জন বাচ্চাকে পড়ানো হতো তখন। পড়ানোর পাশাপাশি বাচ্চাদের খাবার, স্টেশনারি সামগ্রী সবই দেওয়া হতো। ১৭ জন বাচ্চাকে নিয়ে কাজ করতে করতে ভাবনা আরো বড় হতে থাকে এই তরুণ উদ্যোক্তার।
প্রেরণা যখন স্যার ফজলে হাসান আবেদ
আদনান হোসেইন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহও তার বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। তাই ছয় মাস অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার পর তা প্রতিষ্ঠানের আওতায় নিয়ে আসার কথা চিন্তা করেন তিনি। আদনানের বক্তব্যানুসারে, 'অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যদি শিশুদের এত আগ্রহ থাকে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে তা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু তার জন্য আরো শিক্ষক দরকার, শ্রেণিকক্ষ দরকার'। তাই যে বাড়ির বারান্দাতে শিশুদের পড়ানো হতো, সে বাড়িরই বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলে আরেকটি রুম ভাড়া নিয়ে ২০১১ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাপ্রদান শুরু করে আদনান। প্রতিষ্ঠানের নাম দেয় কাইটস একাডেমি। ক্রমশ একাডেমির শিক্ষার্থী বাড়তে থাকে। ১৭ জনকে নিয়ে শুরু করার পর তা ঠেকে ১২০ জনে। আশপাশের মানুষও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে থাকে; ফলাফলস্বরূপ আদনানের আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
কাইটস একাডেমির সফলতা দেখে আদনানের মনে হতে থাকে এই পুরো প্রক্রিয়াটি যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের আওতায় নিয়ে আসা যায় তাহলে তার কাজের প্রসার যেমন বাড়বে তেমনি তা মানুষের কাছেও পৌঁছানো সহজ হবে। যে ভাবনা সেই কাজ, ২০১২ সালে পরিপূর্ণভাবে ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন আত্মপ্রকাশ করে।
কীভাবে এলো চাকার স্কুল?
'চাকার স্কুল' শুরুর পথটা এতটাও সহজ ছিলো না। ৫ বছরের পরিকল্পনার পর প্রকল্প আশার আলো দেখে। 'চাকার স্কুল' প্রজেক্টের চিন্তাভাবনা শুরু হয় ২০১৫ সালে। মূলত দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার কথা মাথায় রেখে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। আদনানের ভাষ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দেখা যায় একটি শিশুর স্কুলের ভর্তিপ্রক্রিয়াতে অভিভাবক লাগে, ঠিকানা লাগে; মোট কথা প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে ভর্তির কাজ সম্পন্ন করাটা কিঞ্চিৎ জটিল। কিন্তু আমাদের আশেপাশে যেসব পথশিশুরা আছে সেভাবে কোনো থাকার জায়গাও নেই, আবার শিক্ষাও নেই। ফলাফলস্বরূপ শিক্ষা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে তেমন কোনো ইচ্ছাও দেখা যায় না। প্রথমদিকে এই প্রকল্প চাকার স্কুল নামে চিন্তা করা হয়নি। প্রাথমিক ভাবনা ছিলো ভ্যানগাড়ি বা বাস বা পিকাপ মাধ্যমে জায়গায় জায়গায় গিয়ে বাচ্চাদের পড়ানো। ২০১৬ সালে পুরো প্রজেক্ট কেমন হতে পারে, কী কী ঘটতে পারে তা নিয়ে কাজ শুরু হয়।
২০১৭ সালে আদনান ও ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের অন্যান্য কলিগরা মিলে বিস্তারিতভাবে আলোচনা শুরু করে। কারণ একটি প্রজেক্ট দাঁড় করানোর পেছনে আনুষঙ্গিক অনেক খরচ থাকে। ফান্ডিং পাওয়া যাবে কীনা তারও কোনো নিশ্চয়তা তখন ছিলো না। কিন্তু আদনান দমে যায়নি। যদি এই প্রকল্পে সফল হওয়া যায় তাহলে অনেক মানুষের কাছে তারা পৌঁছাতে পারবে ভেবে ঝুঁকি নিলো। সেসময় আদনান হোসেইনের লক্ষ্য কেবল শিক্ষাদান নয় বরং শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া। তার উপর অভিনবত্বের দিক থেকে বাসের মাধ্যমে শিশুদের পড়ানোর দিকটিও একদম নতুন।
২০১৮ সালে গিয়ে যারা অর্থায়ন করবে তাদের সাথে উদ্যোগটি নিয়ে আলোচনা করা হয়। প্রথমদিকে তারাও বিষয়টি ধরতে পারছিলো না। সে বছরের শেষের দিকে একটি লোকাল গার্মেন্টস 'চাকার স্কুল' উদ্যোগের কথা শুনে অর্থায়ন করতে রাজি হয়। অবশেষে প্রজেক্ট 'চাকার স্কুল' স্বপ্নের মুখ দেখা শুরু করে। ২০১৯ সালে এই প্রজেক্টটি সম্পূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। লক্ষ্য ছিলো ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে 'চাকার স্কুল' চালু করার। কিন্তু বিধাতা এ যাত্রাতেও ব্যাগড়া দিলেন। শুরু হলো কোভিড-১৯। কাজ শুরুর দিকেই এত বড় ধাক্কা সামলানো চাট্টিখানি কথা নয়। তারপরেও ভেঙ্গে না পড়ে কীভাবে সামনে আগানো যায় সেই চিন্তাই করেছিলো তারা।
করোনাই যখন আশীর্বাদ!
করোনা মহামারীতে সারাদেশে যখন লকডাউন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ তখন। এই সুযোগটিই নেয় আদনান ও তার দল। তারা পাইলট প্রজেক্টের আওতায় একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটির কাছে গিয়ে গিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু করে। বাচ্চারা স্কুলে আসার পরিবর্তে স্কুলই বাসের মাধ্যমে বাচ্চাদের কাছে যাওয়া শুরু করলো। পাইলট প্রজেক্টে সফল হলো। ২০২০ এবং ২০২১ সাল ভালোভাবেই চললো। প্রথম দিকে শিক্ষার্থী ছিলো ৩০ জন। ২০২০ সাল থেকে ২০২১ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত চাকার স্কুলে শিশুরা পড়াশোনা করেছে। বছরশেষে ২১ জন শিক্ষার্থীকে মিরপুর দিয়াবাড়ির লোকাল স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ৫ বছর এসব শিক্ষার্থীরা ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে থাকবে।
এছাড়াও ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের স্টুডেন্ট স্পন্সরশীপ প্রোগ্রামের আওতায় এসব বাচ্চাদের নতুন স্কুলের প্রয়োজনীয় সব সামগ্রীও সরবরাহ করা হয় এখান থেকে। বাচ্চারা ঠিকঠাকভাবে নতুন স্কুলে পড়াশোনা করছে কীনা, তাদের অগ্রগতি কতটা হচ্ছে এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত স্কুলের সাথে আলোচনা করা হচ্ছে। যেহেতু বাচ্চারা নতুন স্কুলে ভর্তির পর স্পন্সরশীপ প্রোগ্রামের আওতায় আসে, তাই নিয়মিত ডোনারদেরকেও রিপোর্ট পাঠানো হয়। এভাবেই চাকার স্কুল কাজ করে যাচ্ছে আর এটিই মূলত চাকার স্কুলের প্রথম সাফল্যের গল্প।
উদ্যোক্তা আদনান হোসেইন বলেন, 'এখানে বাচ্চাদের বাসের মধ্যে পড়ানো হচ্ছে, সেটা ইন্টারেস্টিং। পাশাপাশি বাচ্চাদের হাতে ট্যাব দিয়ে ডিজিটালি পড়ানো হচ্ছে। ডিজিটালি ফোকাসটাও তার মধ্যে থাকছে। যত রকমের এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ, কো কারিকুলার এক্টিভিটিজ, স্টাডিট্যুর সবকিছুর মধ্যে ওদেরকে ফরমালাইজ প্রসেসে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে'।
চাকার স্কুলে খুশি অভিভাবকেরা!
ঢাকার মিরপুরের দিয়াবাড়ি সংলগ্ন শিন্নিরটেক এলাকায় গিয়ে জানা গেলো এখানকার অধিকাংশ শিশুরাই আসে আশেপাশের বস্তি থেকে। এদের অনেকের বাবা দিনমজুর, অনেকের মা গার্মেন্টসকর্মী আবার অনেকে গৃহপরিচারিকার কাজ করে। মা-বাবাদের অনেকসময় ভালো স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য হয়তো থাকে না কিন্তু তাদের বুকভরা বাসনা থাকে তাদের সন্তানও পড়াশোনা করবে। তাদের ইচ্ছাকে হাতের মুঠোয় এনে দিতে হাজির হয়েছে চাকার স্কুল। অভিভাবকেরা চাকার স্কুল নিয়ে আশ্বস্ত থাকে তাদের সন্তানেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভর্তির আগের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা পাচ্ছে। শুধু তাই নয় যেসব শিশুরা চাকার স্কুলে পড়ছে তারা বিশুদ্ধ পানীয় জল ও একবেলা খাবারও পাচ্ছে।
চাকার স্কুল পরিচালনাকারী সংগঠন ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর নিম্ন-আয়ের পরিবারের ১২০ জন শিক্ষার্থী পায় এই বাসের স্কুলে পড়াশোনার সুযোগ। সপ্তাহে তিনদিন দুটি ব্যাচের মাধ্যমে ২ ঘন্টা করে পড়ানো হয় শিশুদের। বছরজুড়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাপ্রদানের পর তাদেরকে ভর্তি করা হয় এলাকা সংলগ্ন বিভিন্ন সরকারী বা বেসরকারী স্কুলে। সেখানেও তাদের নিয়মিত ফলো আপ করা হয়। ঢাকার মিরপুর ছাড়াও বনশ্রীতে এই কার্যক্রম চালু রয়েছে।
ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা
ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের ভিশন হচ্ছে 'সাসটেইনেবল সলিউশন ফর মারজিনালাইজড কমিউনিটি'। তাই তাদের উদ্যোগে তারা কেবল বাচ্চাদের নিয়েই কাজ করে না, সাথে অভিভাবকও যুক্ত থাকে। বাচ্চারা যাতে এখানে পড়াশোনার পর তা ছেড়ে না দেয় তার জন্য পুরো প্রোগ্রামকে তিনটিভাগে ভাগ করে পরিচালনা করে। ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের আওতায় মোট ৮টি স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে ছয়টি রেগুলার স্কুল ও দুইটি প্রজেক্টবেসড স্কুল। এর মধ্যে একটি হলো আলোক; যেটি মূলত শিখন প্রতিবন্ধী (Learning Disable) শিশুদের নিয়ে কাজ করে। ঢাকার টঙ্গির বস্তি এলাকায় যেসব শিশুদের মধ্যে ডিসলেক্সিয়া, এডিএইচডি রয়েছে তাদেরকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে এসে কাজ করা হয়। অপর প্রজেক্টটি হচ্ছে চাকার স্কুল।
এছাড়াও নারী ক্ষমতায়নের জন্য প্রজেক্ট প্রতিভা কাজ করছে। এখানে নারীদের ট্রেনিং দিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্পের এর কাজ শেখানো হয় এবং সেখান থেকে তারা যাতে অর্থ উপার্জন করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখা হয়। যুবকদের কেন্দ্র করে সেন্টার ফর ইয়থ ডেভেলপমেন্ট নামে আরেকটি প্রজেক্ট নিয়েও কাজ করছে ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। এছাড়াও ২০২১ সালে 'প্রজেক্ট হাতেখড়ি' নামে আরেকটি নতুন উদ্যোগ শুরু করে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত ট্রাস্ট টেকনিক্যাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউটের আওতায় অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর শিক্ষার্থীরা চারটি বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ নিতে পারে।
বর্তমানে ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের ৮টি স্কুলে মোট ৬৫০ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।
চাকার স্কুলের পাশাপাশি করোনা মহামারীতে উঠান পাঠশালা, হোম স্কুলিং, ডিজিটাল লার্নিং প্রসেস সহ নানা রকমের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ইটস হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। তাছাড়া শিশুদের কতটুকু উন্নতি হলো তা নিয়ে প্রত্যেক মাসে অভিভাবকদের সাথে সাক্ষাত আয়োজন করে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের জন্যও বিভিন্ন আয়োজন করা হয় যেমনঃ শীতকালে কম্বল দেওয়া হয়, বিভিন্ন ঈদের আগে খাবার দেওয়া হয়। করোনার মরশুমে চাকার স্কুলের ১২ বছরের বা তার চেয়েও বড় শিশুদের করোনার টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এখন যেসব বাচ্চারা পড়ছে তারা সবাই পাঁচ থেকে সাত বছরের। তাদের সবাইকেই করোনার টিকার অধীনে নেওয়া হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন আদনান হোসেইন।
চাকার স্কুল একটি শহরভিত্তিক প্রোগ্রাম। শহরে পথশিশুদের সংখ্যা বেশি থাকায় এই প্রজেক্টের প্রথম লক্ষ্য শহর। আদনানের স্বপ্ন বাংলাদেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ৮টি বাস হবে। শহরকেন্দ্রিক কোনো পথশিশু যাতে পড়াশোনা থেকে দূরে না চলে যায় তারই স্বপ্ন দেখে আদনান ও তার দল।