আমদানিকৃত জ্বালানি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাই যখন সংকটের মূল!
বিদ্যুতের লোডশেডিং সম্পর্কিত ঘোষণা বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ভবিষ্যত সংকটের ইশারা মনে করা যেতে পারে। ২০০১ থেকে শুরু করে ২০০৬ পর্যন্ত যে সরকার ক্ষমতায় ছিল, তাদের আমলে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের উন্নয়ন ও বণ্টন চুক্তি, সন্ধান চুক্তি, কয়লা উত্তোলনে ওপেন পিট অথবা খনন পদ্ধতি- সবকিছু মিলিয়ে এক বিশাল বিভাজনের শিকার হয়েছিল দেশ। সেই সময় দেশের নানান প্রান্তে তেল-গ্যাস বন্দর রক্ষার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনের ফলে ২০০৬ সালে দিনাজপুরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে। সে সময়ের বিরোধীদল ও সরকারি দল ঘোষণা দিয়েছিল আমাদের কয়লা উৎপাদন ওপেন পিট পদ্ধতিতে করা হবে না।
দেশে কয়লার মজুদ ৩১০ কোটি টন। যার প্রতি টনের বাজার মূল্য এখন প্রায় ৪০০ মার্কিন ডলার। ২০০৮ সালে নতুন সরকার নির্বাচিত হয়। নির্বাচিত নতুন সরকার বিদুৎ উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে মনোযোগী হয়। এখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা যদিও ২৫,০০০ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে, কিন্তু বিগত এপ্রিল মাসের হিসেবে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে আমাদের এখনো বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা এই মুহূর্তেই আরো কয়েক হাজার মেগাওয়াট বেশি। অথচ আমরা নানান গণমাধ্যমে জানতে পারছি সরকার প্রতিবেশি ভারতের কাছ থেকে আরও বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি করছে। এমন একটি সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের ঘোষণা এক মারাত্মক উদ্বেগের সৃষ্টি করছে। এ ঘোষণার অর্থ বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহে জ্বালানির আমদানি নির্ভরতা। জ্বালানি সংকট সরকারকে বাধ্য করছে লোডশেডিংয়ের রাস্তায় হাঁটতে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাস ও তেলের দাম ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
২০০১-এর সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তাৎক্ষণিকভাবে গ্যাস বিক্রির এক প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে সেই প্রচেষ্টাকে বাধা দিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল। এরপর দেশে কয়লা উৎপাদনে জোর দেওয়া হয় । তখন ওপেনপিট কয়লা উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করেও দেশে রাজনৈতিক আন্দোলন তীব্রতা পেয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরের বিশিষ্ট কিছু মানুষ তেল-গ্যাসবন্দর রক্ষা আন্দোলনের সূচনা করে, যাতে দেশের অভ্যন্তরে একটি তীব্র বিরোধী মতের সৃষ্টি হয়। ফলে সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনের জন্য পৃথিবীতে যারা সক্ষম তাদের প্রায় সকলেই মুখ ফিরিয়ে নেয় । তেল গ্যাস বন্দর রক্ষা ইত্যাদি নামে নানান সংগঠন গড়ে ওঠে। তাদের কার্যক্রমে তেল গ্যাস তথা জ্বালানি উৎপাদন নিয়ে এক মারাত্মক সংকটের সৃষ্টি হয়।
২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সরকার তেল গ্যাস কয়লা উৎপাদন সংক্রান্ত সকল পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল। সেই সময়কার সরকার সেজন্য কার্যকরভাবে জ্বালানি খাতের উন্নয়নের কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেননি।
এর পরের সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপের ফলে বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগ এবং তার লভ্যাংশ যথাযথভাবে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রায় উন্মুক্ত সুযোগ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের পরবর্তী সময় থেকেই এ নিয়েও তীব্র সমালোচনা চলতে থাকে। যে ঢালাও চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এতে সরকারের ব্যয় আকাশচুম্বী হয়ে দাঁড়ায়।
প্রথম দিকে এই চুক্তি করা হয় তিন বছরের জন্য। খুবই আশ্চর্যজনক চুক্তি ছিল এটা, তিন বছরের জন্য উৎপাদন এবং তা সরবরাহ করে কোনো প্রতিষ্ঠান কোনোদিনই তার মুনাফা কিংবা বিনিয়োগ ফেরত পেতে পারে না। যেকোনো শিল্পকারখানা ন্যূনতম ১০ বছর সময় না পেলে তার বিনিয়োগ ফেরত আসে না। এমন একটি পরিস্থিতিতে প্রথমে তিন বছর পরবর্তীকালে অব্যাহতভাবে তা নবায়নের সিদ্ধান্ত ভীষণভাবে সমালোচিত হয়।
চুক্তির শর্ত অনুসারে ওই বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জ্বালানি সরবরাহের দায়িত্ব ছিল মূলত সরকারের। সেদিনের ওইসব চুক্তির কারণে আজ দেশে সংকট তৈরি হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহে ব্যর্থতার কারণে দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি এখন। সংকটের যে নিকট ভবিষ্যতে কোনো সমাধান হবে তার কোনো ইঙ্গিত নাই। সরকারের পক্ষ থেকে তাই বাধ্য হয়ে লোডশেডিংয়ের ঘোষণা এসেছে ।
গত কয়েক মাস যাবত অব্যাহত লোডশেডিং চলছে। এই লোডশেডিং দেওয়া হয়েছে বিনা ঘোষণায়, ফলে শিল্পকারখানাগুলো দুই ভাবে ক্ষতির মুখে: এক, তাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে; দুই, চলমান উৎপাদন ব্যবস্থায় পূর্ব ঘোষণা ছাড়া লোডশেডিং দেওয়ার ফলে কারখানার প্রক্রিয়াজাতকরণ সকল কাঁচামাল নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে। বিনা ঘোষণার লোডশেডিংয়ের ফলে মিলকারখানাগুলোয় উৎপাদন দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির ব্যবস্থা না থাকায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও চাহিদা অনুসারে ১৩-১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাও এই মুহূর্তে নেই। ২৫ হাজার মেগাওয়াটের যে ঘোষণা তা খানিকটা রাজনৈতিক বটে কারণ প্রকৃতপক্ষে কখনোই ১৭ হাজারের উপরের উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হয়নি।
দীর্ঘকাল যাবত ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জ্বালানি খাতকে নিয়ে যে রাজনৈতিক বিভাজন তৈরি হয়েছিল তারই পরিণতিতে পরবর্তী সরকার জ্বালানি খাতকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। সেটাও যে দেশের সংকট সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ মিলছে এখন।
ওই সময় দেশের মজুদ কয়লা উত্তোলনকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করা হয়। দিনাজপুরের পাঁচটি কয়লা খনিতে ৩১০ কোটি টন কয়লা মজুদ থাকার পরেও বলা হয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কয়লা রক্ষা করা হোক। আজ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি মেট্রিক টন কয়লার বাজার মূল্য প্রায় ৩৮০ ডলার। সাগরে গ্যাস উত্তোলনের নতুন কোন কার্যকর চুক্তি করা হলো না আজ অবধি। কারণ চুক্তি নিয়ে চলমান দুর্নীতির মামলা ছাড়াও তেল-গ্যাস বন্দর রক্ষাকারীদের বিদেশি কোম্পানিকে চুক্তি দেওয়ার বিরোধিতা করার ফলে কেবলমাত্র বাপেক্সের ওপর নির্ভরতায়, প্রকারান্তে দেশ এক গভীর সংকটের মুখে আজ।
একদিকে মুদ্রাস্ফীতির ফলে বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। পাশাপাশি আজ জ্বালানি সংকট যেভাবে সামনে আসছে তাতে মনে হয় আমাদের সামনের দিনগুলোয় আরো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হবো।
এই মুহূর্তের যে সংকট আমাদের দেশে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার সুস্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা আমাদের হাতে নেই। একদিকে বিভিন্ন পণ্যর আমদানি মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমাদের বাণিজ্যিক ঘাটতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, অপরদিকে যদি জ্বালানির জন্য বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয় তাহলে সামগ্রিকভাবে গভীর অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবে। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করার দিকে মনোযোগী হয়েছে।
এদিকে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ার ফলে দেশের মূল টেক্সটাইল সেক্টরে উৎপাদন সক্ষমতা ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। তাদের সার্বিক ব্যয় একই জায়গায় থাকার পরেও ৭০ শতাংশ উৎপাদন নিয়ে আগামী দিনগুলোতে এই কারখানাগুলো কীভাবে টিকে থাকবে সেটিও এখন প্রশ্ন।
সরকারের পক্ষ থেকে উচিত এখনি রাজনৈতিক বিভাজনের পথ পরিহার করে একটি সমঝোতার রাজনৈতিক পথকে গ্রহণ করে দেশের কয়লা উত্তোলন, গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি ও নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করার পদক্ষেপ নিতে একটি জাতীয় সমন্বয় সৃষ্টি করা। এই মুহূর্তের সংকট থেকে এটি সুস্পষ্ট যে জ্বালানি খাতের যে কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল তা যথেষ্ট সংকট সৃষ্টি করেছে। জ্বালানি প্রবাহ নিজেরা বৃদ্ধি করার পরিবর্তে আমদানি নির্ভরতা দেশকে আজ গভীর সংকটে পতিত করেছে। আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কোন বুদ্ধিতে গ্রহণ করা হয়েছিল আজ তার দায়ভার নিরূপণ করার সময় এসেছে। যেখানে দেশে এক কোটি টন কয়লা উত্তোলিত হলে দশ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব সেখানে কিনা আমদানি নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠছে দেশে। বড়ই দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়।