প্রেডাটরি স্প্যারো: ইরানের কারখানায় আগুন জ্বালানো কারা এই হ্যাকার গোষ্ঠী?
হ্যাকারেরা কাজ করেন ডিজিটাল দুনিয়ায়। তাদের পক্ষে বাস্তবের দুনিয়ায় কোনো আঘাত হানা খুবই বিরল একটি ঘটনা।
কিন্তু দুসপ্তাহ আগে ইরানের একটি স্টিল নির্মাণ কারখানায় আগুন লাগার পেছনে হ্যাকারদের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রেডাটরি স্প্যারো নামক একটি হ্যাকিং গোষ্ঠী দাবি করেছে, তারা ওই ঘটনার পেছনে ছিল। এ দাবির সমর্থনে তারা একটি ভিডিও-ও প্রকাশ করেছে।
সিসিটিভি ফুটেজের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, কর্মীরা কারখানার ভেতরের একটি অংশ ত্যাগ করছেন। তার একটু পরে একটি মেশিন থেকে গলিত স্টিল ও আগুন বের হতে দেখা যায়। ভিডিওর শেষে দেখা যায় কর্মীরা হোসপাইপ দিয়ে আগুনের ওপর পানি ঢালছেন।
প্রেডাটরি স্প্যারো ফার্সি ভাষায় গঞ্জেশকে দারান্দে নামেও পরিচিত। তারা আরও দাবি করেছে, ইরানের বিভিন্ন স্টিল কারখানায় গত ২৭ জুন তারা তিনটি হামলা চালিয়েছে। ইসলামিক রিপাবলিকের দ্বারা চালানো কোনো 'আগ্রাসনের' উত্তর হিসেবে তারা এ হামলাগুলো পরিচালনা করেছে। তবে কী ধরনের 'আগ্রাসন', তা স্পষ্ট করেনি প্রেডাটরি স্প্যারো।
এ হ্যাকার দলটি গিগাবাইট সাইজের বিভিন্ন ডেটাও প্রকাশ করতে শুরু করেছে। এ ডেটাগুলো তারা বিভিন্ন ইরানি কোম্পানি থেকে চুরি করেছে বলে জানিয়েছে। এগুলোর মধ্যে গোপনীয় ইমেইলও রয়েছে।
নিজেদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে প্রেডাটরি স্প্যারো লিখেছে: 'এ কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার অংশ, এবং তারা নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদের রক্ষা করার জন্য এ সাইবার হামলাগুলো সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা করা হচ্ছে।'
তাদের এ বার্তার শেষ বাক্যটি পড়ে সাইবার নিরাপত্তার দুনিয়া নড়েচড়ে বসেছে।
এটা স্পষ্ট যে, এ হ্যাকারদল জানত তারা মানুৃষের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু কারখানায় হামলা চালানোর আগে তাদেরকে ভেতর থেকে সব মানুষকে বের করে দেওয়ার প্রচণ্ড চেষ্টা করতে দেখা গেছে। একইসাথে তারা তাদের এই সতর্কতার কথা সবাইকে বোঝানোর জন্যও উঠেপড়ে লেগেছে।
এতে করে অনেকে সন্দেহ করছেন, প্রেডাটরি স্প্যারো কোনো সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত, পেশাদার ও কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত সামরিক হ্যাকারও হতে পারে।
চেক পয়েন্ট সফটওয়্যার-এর সাইবার গবেষণার প্রধান ইটাই কোশেন বলেন, 'তারা নিজেদেরকে হ্যাকটিভিস্ট বলে দাবি করে। কিন্তু তাদের উচ্চ প্রভাব দেখে মনে হয়, এ দলটির পেছনে কোনো দেশের হাত রয়েছে।'
ইরান সম্প্রতি অনেকগুলো সাইবার হামলার শিকার হয়েছে। ওই হামলাগুলোর প্রভাব বাস্তব দুনিয়াতেও লেগেছিল। কিন্তু সেগুলো প্রেডাটরি স্প্যারো'র মতো মারাত্মক ছিল না।
সাইবার পলিসি জার্নাল-এর সম্পাদক এমিলি টেইলর বলেন, 'এগুলো যদি কোনো রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়ে থাকে, তাহলে এর তাৎপর্য হতে পারে ব্যাপক।'
'২০১০ সালে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে স্টাক্সনেট-এর সাইবার হামলা ইতিহাসের অন্যতম সাইবার হামলা যা বাস্তবিক দুনিয়াতে সরাসরি ক্ষতিসাধন করেছে।'
ওই হামলার পর থেকে সাইবার হামলার মাধ্যমে বাস্তব দুনিয়ায় ক্ষতিসাধন করার খুব কম ঘটনার কথাই প্রমাণিত হয়েছে।
২০১৪ সালে জার্মানি জানিয়েছিল, একটি সাইবার হামলায় দেশটির একটি স্টিল কারখানায় 'ব্যাপক ক্ষতি' হয়েছে, যার ফলে ওই কারখানাটি জরুরিভিত্তিতে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এর বাইরে আর বেশি কিছু জানায়নি জার্মান কর্তৃপক্ষ।
তবে অনেকগুলো সাইবার হামলার ঘটনায় বাস্তব দুনিয়ায় মারাত্মক ক্ষতি হতে পারত, কিন্তু সেগুলো সফল হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, পানি সরবরাহ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে পানিতে রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল হ্যাকারেরা।
এমিলি টেইলর জানান, যদি প্রমাণিত হয় যে কোনো দেশ হ্যাকিং-এর মাধ্যমে ইরানের স্টিল কারখানায় ভৌত ক্ষতিসাধন করেছে, তাহলে এর মানে দাঁড়াবে ওই দেশটি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে। এতে করে ইরানের পাল্টা জবাব দেওয়ার আইনি ভিত্তি তৈরি হবে।
যদি প্রেডাটরি স্প্যারো কোনো রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হ্যাকারদল হয়, তাহলে সেটি কোন দেশ?
স্টাক্সনেট হামলার পেছনে ইসরায়েলের হাত আছে বলে ধারণা করা হয়। এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্রেরও সহায়তা ছিল বলেও মনে করেন অনেকে। প্রেডাটরি স্প্যারোর সঙ্গেও ইসরায়েলের সম্পর্ক থাকা নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছে।
আর এ কারণে নড়েচড়ে বসেছে ইসরায়েলের প্রশাসন। দেশটির গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গানটজ বিষয়টি নিয়ে একটি তদন্তের আদেশ দিয়েছেন।
আঙ্কারার এডিইও সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিসেস-এর এরসিন কামুটোগলু বলেন, 'যদি এ সাইবার হামলা কোনো রাষ্ট্রের ইন্ধনে হয়ে থাকে, তাহলে এক্ষেত্রে প্রধান সন্দেহভাজন হচ্ছে ইসরায়েল। ইরান আর ইসরায়েল সাইবার যুদ্ধে অনেক আগে থেকেই লিপ্ত আছে, আর দুই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এটি স্বীকারও করেছে।'
২০২১ সালের অক্টোবর মাসে ইরানের জাতীয় জ্বালানি কেন্দ্রের অর্থ পরিশোধ ব্যবস্থা অচল (অফলাইন) করে দেওয়ার দায় স্বীকার করে প্রেডাটরি স্প্যারো। এছাড়া রাস্তার পাশে থাকা ডিজিটাল বিলবোর্ড হ্যাক করার দাবিও করেছিল গ্রুপটি। ওই বিলবোর্ডে লেখা ওঠে, 'খামেনি, আমাদের জ্বালানি কই?'
তবে ওই হামলার আগে ইরানের জরুরি বিভাগকে সতর্ক করে দিয়েছিল হ্যাকার গ্রুপটি।
চেক পয়েন্টের গবেষকেরা জানিয়েছেন, প্রেডাটরি স্প্যারো'র ব্যবহার করা ক্ষতিকারক সফটওয়্যারের কোডের সঙ্গে তারা ইন্ড্রা নামের আরেকটি হ্যাকার গ্রুপের ব্যবহৃত কোডের মিল খুঁজে পেয়েছেন। ইন্ড্রা গত বছরের জুলাই মাসে ইরানের রেলস্টেশনের ডিসপ্লে বোর্ড হ্যাক করেছিল।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্টিল কারখানায় হামলা নির্দেশ করছে এ ধরনের আক্রমণের মাত্রা ও গুরুত্ব বেড়ে যাচ্ছে।
মোবারাক স্টিল কোম্পানিতে ওই আগুনের ঘটনা ঘটেছিল। কোম্পানিটির সিইও জানিয়েছেন, সেদিনের আগুনে কারখানার কাজের কোনো ক্ষতি হয়নি, কেউ আহতও হয়নি। বাকি দুইটি আক্রান্ত কোম্পানিও একই কথা জানিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইরানের বিরোধী দলীয় কর্মী ও স্বাধীন সাইবার-এসপিওনাজ তদন্তকারী নাইরম্যান ঘারিব স্টিল কারখানায় আগুনের প্রকাশ করা ভিডিওগুলো আসল বলেই মনে করেন। তিনি বলেন, 'এসব হামলার পেছনে যদি ইসরায়েল দায়ী থাকে, তাহলে আমার মনে হয় তারা দেখাতে চাচ্ছে সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে বাস্তবিক ক্ষতিও তাদের পক্ষে করা সম্ভব। এ থেকে বোঝা যায়, ঘটনা খুব দ্রুতই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যেতে পারে।'
সূত্র: বিবিসি