চাকরিপ্রত্যাশীদের কেন্দ্র করে ৬০০ কোটি টাকার বই বাজার
স্নাতক পাশের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত গ্র্যাজুয়েটদের কেন্দ্র করে দেশে রমরমা বইয়ের বাজার গড়ে উঠেছে।
চাকরি সংক্রান্ত বই বাজারের আকার এখন ৬০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কর্মখাতে প্রবেশের সঙ্গে দিন দিন তা আরও বেড়ে চলেছে।
প্রথম শ্রেণির চাকুরিজীবী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশের চাকরিপ্রত্যাশীদের বড় একটি অংশ দিনরাত ধরে বই আত্মস্থ করে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস, বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ গণিত, মানসিক ক্ষমতা এবং বিভিন্ন মৌলিক বিষয় নিয়ে বিপিএসসির সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে।
প্রস্তুতির জন্য চাকুরিপ্রার্থীরা সবচেয়ে ভালো ও তথ্যবহুল বইগুলো খুঁজে থাকেন। ফলস্বরূপ একেকজন প্রার্থীকে প্রিলিমিনারির মতো প্রাথমিক যুদ্ধে জয়ী হতে কমপক্ষে ২০ থেকে ৫০টি বই কিনতে হয়।
প্রতিটি বইয়ের দাম গড়ে ৩০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি সেট বইয়ের জন্য প্রত্যেক শিক্ষার্থী পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ করেন। এছাড়াও, তাদের নিয়মিত কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের বিভিন্ন বই কিনতে হয়।
চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে বিসিএস প্রস্তুতির উচ্চহারের কারণে প্রকাশকরা চাকরি সম্পর্কিত নিত্যনতুন বই নিয়ে হাজির হচ্ছেন।
বিসিএস ছাড়াও অন্যান্য সরকারি চাকরির জন্য বিভিন্ন ধরনের বই রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ব্যাংক এবং অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতির জন্য ভিন্ন ধরনের বই রয়েছে।
সূত্রানুসারে, বাংলাদেশে সরকারি চাকরির বইয়ের বাজারে এমপিথ্রি পাবলিকেশনস, প্রফেসর পাবলিকেশনস এবং ওরাকল পাবলিকেশনসের আধিপত্য বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহিম রহমান (ছদ্মনাম) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে স্নাতকে পড়ছে। প্রতিদিন ভোর ৬টায় উঠে স্নান ও প্রয়োজনীয় কাজ সেরে ব্যাগে বই নিয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যায় সে।
সকাল ৮টায় লাইব্রেরি খুলে। কিন্তু সিট সংকট থাকায় ফাহিম দেড় ঘণ্টা আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছে। বিভাগের ক্লাস থাকলে ক্লাস করে এসে লাইব্রেরিতে আবার চাকরির প্রস্তুতি নেয় সে। সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দৈনিক দিনে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় চাকরির প্রস্তুতির পিছনে ব্যয় করে ফাহিম।
সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, বিকালের হালকা নাস্তা সবই লাইব্রেরির সামনের হাকিম চত্বর, মিলন চত্বর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া আর অন্যান্য হলের ক্যান্টিনগুলোতেই সেরে নেয়।
শুধু ফাহিম নয়, চাকরিপ্রার্থীদের সকলেরই দৈনন্দিন রুটিন এটি। বিভাগের পড়াশোনার চেয়ে চাকরির প্রস্তুতিই তাদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়।
মামুন বুক হাউজ চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। নীলক্ষেত মোড়ে রাস্তার বামপাশে দোকানটি অবস্থিত। দোকানের আকার আনুমানিক ৩ ফুট বাই ৩ ফুট।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাস্তার পাশ ঘেঁষা দোকানটিতে প্রচন্ত ভীড়। দাঁড়ানোর সুযোগ একদমই নেই। ভীড়ের মধ্যেই চলছে বইয়ের কেনাকাটা। চাকুরিতে প্রবেশের প্রস্তুতির জন্য সব ধরনের বই রয়েছে এখানে।
বইয়ের দোকানের একজন মালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "প্রতিদিন তারা কয়েক লাখ টাকার বই বিক্রি করেন। বিশেষ করে বিসিএসকেন্দ্রিক বইয়ের বিক্রি বেশি। এছাড়াও ব্যাংক ও অন্যান্য বইও বিক্রি হয়, তবে তা খুব কম।"
ওরাকল পাবলিকেশনসের মালিকদের একজন মোহাম্মদ মহিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ওরাকলের বই নির্ভরযোগ্য হওয়ায় তা চাকরিপ্রার্থীদের বিশ্বস্ততা অর্জন করেছে।
"কোভিড-১৯ মহামারির সময় ২০২০ সাল থেকে চাকরির সার্কুলার একরকম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমরা সমস্যায় পড়ি। দেশের মহামারির পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়ায় আমাদের বিক্রি বাড়বে বলে আশা করি," জানান তিনি।
এমপিথ্রি প্রকাশনার শীর্ষ ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সোহেল রানা টিবিএসকে বলেন, "শিক্ষার্থীদের চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। কয়েক বছর আগেও আমরা ৫-৭ হাজার বই বিক্রি করতাম। মহামারি পরিস্থিতির অবনতি না হলে সামনে আমরা ৫০ হাজার বই ছাপানোর পরিকল্পনা করছি"।
প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে বইয়ের চাহিদা বাড়ে
প্রকাশকরা জানান, মূলত প্রিলিমিনারি পরীক্ষার বই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। বিসিএস পরীক্ষায় প্রবেশের প্রথম ধাপে বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থী অংশ নেওয়ায় বই বিক্রি বেশি হয়।
যারা পরীক্ষার জন্য ভালো প্রস্তুতি নিতে চান, তারা বিভিন্ন প্রকাশনীর একাধিক সেট বই কেনেন।
আবার যারা প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ভালো করেন বা লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পান, তারা লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যও অগ্রীম বই কেনেন।
সাধারণত, প্রিলিমিনারিতে কয়েক লাখ পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করলেও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ২০-২৫ হাজার, যারা সবাই নৈর্ব্যত্তিক পরীক্ষার বই বাদ দিয়ে শুধুমাত্র লিখিত পরীক্ষার বই কেনেন। যার কারণে প্রিলিমিনারির বই বেশি বিক্রি হয় বলে জানান প্রকাশকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নোমান হোসেন টিবিএসকে বলেন, তার মূল লক্ষ্য বিসিএস ক্যাডার হওয়া এবং সেজন্য তিনি এমপিথ্রি বইয়ের সেট কিনেছেন। এর বাইরেও চাকরি সংক্রান্ত আরও কিছু বই তিনি সংগ্রহ করেছেন।
"আমি আমার অ্যাকাডেমিক পড়ার পাশাপাশি বইগুলো পড়ে মুখস্থ করার চেষ্টা করি। তবে আমি চাকরি সংক্রান্ত পড়াকেই বেশি গুরুত্ব দিই। 'কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স'-এর মতো নিয়মিত প্রকাশিত ম্যাগাজিনও পড়ি। শুধু আমিই নই, আমার অনেক বন্ধুও একই কাজ করছে," বলেন তিনি।
ভোলা সরকারি কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাস করা নোমান টিবিএসকে আরও বলেন, তিনি প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালেই বিসিএসের পড়াশোনা ও বই সংগ্রহ করা শুরু করেন। তার কাছে এখন অন্তত ২০টি চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন বই রয়েছে।
"আমাদের ক্লাস করার তেমন চাপ নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষার আগে অ্যাকাডেমিক বই পড়ি আর বাকি সময় পড়ি চাকরির বই পড়ি," বলেন নোমান।
বইয়ের বাজারে কাদের আধিপত্য বেশি?
এমপিথ্রি, ওরাকল, প্রফেসরস, অ্যাসুরেন্স, খায়রুলের গণিত, অগ্রদূতের বাংলা, মোস্তফা কামালের ইংরেজি, সায়েন্স আওয়ারস, ইউনিক ও নবাবের বিজ্ঞান বিষয়ক চাকরি সংক্রান্ত বইগুলো বাজারে বেশি চলছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্ররা বিসিএস সংক্রান্ত বিভিন্ন লেখালেখি ও লেকচার নোট শেয়ারের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেকচারের মাধ্যমে তিনি ভালো টাকা উপার্জন করেন।
বিভিন্ন প্রকাশনা সূত্রে জানা যায়, পুরো বাজারের ৭৫ শতাংশই এমপিথ্রির দখলে।
বাড়ছে বিসিএস পরীক্ষার্থী
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মতে, প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক পাস করেন।
এদের মধ্যে প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী আসেন বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ থেকে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও এক লাখ। এর বাইরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত কলেজগুলো থেকে প্রতিবছর আট লাখের বেশি শিক্ষার্থী বের হয়।
বিশ্লেষকদের মতে সদ্য পাস করে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েটদের প্রায় ৮০ শতাংশই প্রথমে সরকারি চাকরির চেষ্টা করেন এবং চাকরির বিভিন্ন বই কিনে থাকেন।
প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ের অন্তত ১৫টি বড় আকারের বই কেনার কথা জানান সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা।
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় দুই লাখ ২১ হাজার প্রার্থী অংশ নেন।
এর মাত্র ৭ বছর পর ৪১ তম বিসিএসে আবেদনকারীরার সংখ্যা চার লাখ ৭৫ হাজারে পৌঁছে যা বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
কোভিড-১৯ এর সময় অনেক শিক্ষার্থীর পরীক্ষার বয়স পেরিয়ে যাওয়াসহ শিক্ষার্থীরা সেশন জটে পড়লেও ৪৩ ও ৪৪ তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় একই ছিল।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দেশের শিক্ষার্থীদের একটি বিশাল অংশ অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা বাদ দিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে যা জাতির জন্য একটি সতর্কবার্তা।
"বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গবেষণায় মনোনিবেশ করা উচিত কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা চাকরি সংক্রান্ত পড়াশোনায় ব্যস্ত। এটা খুবই অপ্রীতিকর দৃশ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীরা তাদের চাকরির গাইড বই পড়ে," বলেন তিনি।
সরকার বিসিএস বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পারে বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিলিমিনারি বিভাগ, লিখিত বিভাগ এবং ভাইভার মতো আলাদা বিভাগ থাকতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, "শিক্ষকরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হওয়ার সুযোগ পাবেন না। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "উচ্চশিক্ষা হওয়া উচিত গবেষণাভিত্তিক। শিক্ষার্থীদের গবেষণায় ব্যস্ত থাকতে হবে। অথচ শিক্ষার্থীরা চাকরি পাওয়ার জন্য পড়া মুখস্থ করতে ব্যস্ত। এসব বন্ধ করে চাকরির পরীক্ষা সৃজনশীল পদ্ধতিতে নেওয়া উচিত"।