শুভ জন্মদিন ‘পাপা’ হেমিংওয়ে
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে- মহাকালের বুকে অমর, অব্যয়, অক্ষয় হয়ে আলো ছড়ানো এক লেখক। হেমিংওয়ে কি কেবলই একজন কালজয়ী লেখক, না সেই সঙ্গে উঠে আসে তার সৈনিক পরিচয়টিও? অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষটির দুর্দমনীয় শিকারের নেশা, সাগরের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় মাছ শিকারের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালবাসা, কিংবদন্তীতুল্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা- এগুলোও কি তার পরিচয়ের অংশ নয়?
সেই সঙ্গে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ছুঁয়ে-ছেনে লেখনীর পরশ পাথর দিয়ে পাঠকদের পাতে তুলে দিতেন এমন এক জগৎ যা চিরকাল আমাদের এক অজানা পৃথিবীর গান শোনায়। সেই অদেখা জগতে আমরা কেবল হেমিংওয়ের বইয়ের মাধ্যমেই খানিকটা দুঃসাহসিক উঁকি দিতে পারি- বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে, আফ্রিকার উম্মুক্ত প্রান্তরে, প্রেইরির বুনো বাতাসে, মুষ্টিযুদ্ধের রিঙে, ইতালির থমকে থাকা কোনো শহরে, কিউবার উপকূলে চোরাচালানকারীর কারবারে, ক্যারিবীয় সাগরের সাথে জীবনের জন্য প্রতিনিয়ত ঝুঝে চলা বুড়ো জেলের নৌকায়। আকণ্ঠ ভালোলাগার মুগ্ধতায় ডুবেও সেই পৃথিবীটাকে আমরা কোনোদিনই ছুঁতে পারি না, হেমিংওয়ের একান্ত বাস্তবসম্মত বর্ণনা আর নিরেট ভাষা আমাদের সেই দেখা- না দেখা রূপের কাছে নিয়ে যায় বটে কিন্তু আটপৌরে জীবনে অভ্যস্ত আমাদের বিশ্বাস হয় না এমন কিছু ঘটা আদৌ সম্ভব কি!
সম্ভব না হোক, যে মানুষটি বহুদূরের সেই জগতগুলোর হদিস আমাদের এনে দিলেন তাঁর স্মৃতিকে তো অন্তত ছোঁয়া যায়। যার সাহিত্য সারা বিশ্বে মানুষের জীবন সংগ্রামের জয়গান গেয়ে যাচ্ছে আজও অবিরামভাবে, তার পদক্ষেপতো অনুসরণ করা সম্ভব। এমন আশা প্রথম মনে আস্তানা গেড়েছিল স্টকহোমের নোবেল প্রাইজ জাদুঘরের রেকর্ড রুমে এই প্রবাদ প্রতিম লেখকের সংরক্ষিত বলিষ্ঠ কণ্ঠের সাক্ষাৎকার শুনে। পরবর্তীতে প্যারিসের কিলোমিটার জিরোতে অবস্থিত শেক্সপিয়ার অ্যান্ড কোং বইয়ের দোকানে যার আড্ডা ও সাহচর্য তাকে লেখক হতে মূল প্রেরণা জুগিয়েছিল, ভেনিসে গ্র্যান্ড চ্যানেল পারের হোটেলে, ফ্লোরিডার কী ওয়েস্টের বাড়িতে। উনার সমাধি যেখানে আমেরিকার সেই আইডাহোতে- এমনি এক পথ পরিক্রমার শেষে নিজেকে অবাক হয়ে আবিষ্কার করি কোহিমার নামের এক ছোট্ট গ্রামে।
ক্যারিবিয়ান সাগরের সুনীল জলরাশি আলতো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে কোহিমারের সৈকতে, সাগরের দিকে কামান তাক করে আছে গত ৩০০ বছর ধরে স্প্যানিশদের গড়া এক পাথর দুর্গ, তার ঠিক পাশেই বিশ্বের প্রথম হেমিংওয়ে প্লাজা বা হেমিংওয়ে ভক্তদের তীর্থস্থান। চারপাশে স্তম্ভ ঘেরা জায়গাটির কেন্দ্রবিন্দুতে হেমিংওয়ের আবক্ষ ধাতব ভাস্কর্য।
এই ধীবরপল্লীটি বড় প্রিয় ছিল হেমিংওয়ের, সুযোগ পেলেই থাকতে যেতেন সেখানে, মিশতেন সাধারণ জেলেদের সাথে। মাছ শিকারে যেয়ে যেমন প্রায়ই সফল হতেন দৈত্যাকৃতী মাছ বড়শিতে বিঁধাতে, তেমনি জেলেদের কাছ থেকে শুনতেন তাদের সংগ্রামময় জীবনের ঘটনাবলী। তাদের জীবন থেকেই ধারণা নিয়ে লিখেছিলেন জগৎ কাঁপানো সাহিত্যকীর্তি দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সী । যে বইটি তাকে পুলিৎজার পুরস্কারের সাথে সাথে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়। নোবেল পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত সমস্ত অর্থই হেমিংওয়ে এই গ্রামের জেলেদের জীবন উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর কোহিমারের জেলেরা নিজ নিজ নৌকার প্রপেলার থেকে সীসা কুঁদে বের করে এই ভাস্কর্যটি গড়ে অম্লান করে রেখেছে তাদের চিরবন্ধুর স্মৃতি। তাদের কাছে হেমিংওয়ের নাম ছিল পাপা।
বেজায় গরম পড়েছে, আগস্ট কিউবার উষ্ণতম মাস। কোহিমারের সমস্ত অধিবাসী ব্যস্ত সাগর তীরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়াতে, না হয় সাগর সঙ্গমে সাঁতারে। তাদেরই একজনের কাছে পেলাম এই গ্রামের হেমিংওয়ের প্রিয় পানশালা ল্য তেরেজার হদিশ।
সাগর কোল ঘেঁষেই তৈরি এই পানশালাটিতে হেমিংওয়ে কোহিমারে আসলে যেতেনই প্রতিদিন। এখন সেই পাব-রেস্তোরাটির সব দেয়ালেই লেখকের স্মৃতি বিজড়িত ছবি, চিত্রকর্ম বা ভাস্কর্যের অবস্থান। এক কোণে দেখি তার পায়ের একজোড়া ছাপ সযত্নে সংরক্ষিত।পানীয় রসিকদের জন্য পানশালাটির তালিকায় আছে পাপা ডোবলে- রাম, লেমোনেড, বরফের সমন্বয়ে তৈরি হেমিংওয়ের প্রিয় পানীয়। জানা গেল বেশ চড়া দামে বিকোই তা।
ল্য তেরেজার সাগরপারের জানালাটি দিয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত ঘন ফেনিল সমুদ্র দেখা যায়, চোখে পড়ল বড় পানকৌড়িদের বিশাল ঝাঁক আর বিশালকায় বাদামি পেলিক্যানের মাছ ধরার চেষ্টা। এমন স্মৃতি ফ্রেমবন্দি করার আশায় জানালার কাছে যেতেই দেখা এক বুড়ো জেলের সাথে, রীতিমতো জাল ঝাঁকিয়ে মৎস্য শিকাররত। প্রথমেই মনে হল এও হয়ত পর্যটকদের মনোরঞ্জনের এক ফন্দি, পরে শুনি এইখানে অনেকেই চেষ্টা করে জোয়ারের জলে সমুদ্রগর্ভ থেকে রুপালি ফসল তুলে নিতে।
রেস্তোঁরার দেয়ালে অসংখ্য সাদা কালো আলোকচিত্রের মাঝে গুটিকয়েক পেইন্টিংও উঁকি দিচ্ছে, তাদের একটা হেমিংওয়ের ব্যক্তিগত নৌকার পিলারের ২০ বছরেরও বেশি ফার্স্ট মেটের দায়িত্ব পালন করা ক্যাপ্টেন গ্রেগরি ফুয়েন্তসের।
অনেকের মতেই হেমিংওয়ের দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সীর সেই ওল্ড ম্যান সান্তিয়াগো আসলে এই ক্যাপ্টেনই। সারা জীবন দেদারসে সিগার ফুঁকেও ১০৪ বছর দিব্যি সুস্থ অবস্থায় এই কোহিমারে অতিবাহিত করার পরে ২০০২ সালে এই ভুবনের মায়া ত্যাগ করেন। সেই সময় পর্যন্ত কোহিমারের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিলেন আজব বুড়ো, হেমিংওয়ের ব্যক্তিগত জগৎ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা মানুষ। যদিও তিনি কোনদিনই দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি পড়েননি, এই ব্যপারে তার নির্লিপ্ত মন্তব্য ছিল – আমি তো এদের মাঝেই থাকি, সেই গল্পের অভিজ্ঞতার মাঝেই আমাদের জীবন, নতুন করে আর পড়ার কী আছে! ফেরার পথে সেই ক্যাপ্টেনের বাড়ির দরজায় থামা হল কিছুক্ষণ।
যদিও হেমিংওয়ে কোনো সময়ই বলেননি যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের ঘটনা নিয়ে তিনি সেই অমর বুড়ো জেলের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, তারপরও হেমিংওয়ে বোদ্ধাদের মতে ক্যাপ্টেন ফুয়েন্তেস নন, সেই আজব বুড়ো সান্তিয়াগোর মূল ঘটনা নায়ক ছিলেন পিলারের প্রথম ফার্স্ট মেট কার্লোস গুতিয়েরেস।
এর বেশি আর কিছু জানা যায় না কিন্তু দীর্ঘ জীবনের কারণেই হয়ত পর্যটকরা মনে করতে চাইতেন ক্যাপ্টেন গ্রেগরীও ফুয়েন্তেসই সেই সান্তিয়াগো, মনে আত্নপ্রসাদ নিয়ে ফিরতেন জীবন সংগ্রামে নুয়ে না পড়া প্রিয় উপন্যাসের চরিত্র এক আশাবাদী চিরতরুণকে চর্মচক্ষে দেখে।
এরপরের গন্তব্য ছিল ওল্ড হাভানার এককোনায় বিখ্যাত হোটেল অ্যাম্বোস মুন্ডোস। হোটেলটি আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত কারণ এই হোটেলেরই ৫১১ নম্বর কক্ষে ৭টি বছর ছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে! ৫ তলার এই কক্ষটি বেছে নেবার মূল কারণ ছিল সেখান থেকে পুরনো হাভানা চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে। জমজমাট হোটেলের লবিতে দেয়ালজুড়ে রয়েছে কিংবদন্তি লেখকের নানা আলোকচিত্র। ৫১১ নম্বর কক্ষটি আজ জাদুঘর। তালাবদ্ধ থাকে তা, কেবল মাত্র হেমিংওয়ে তীর্থ যাত্রীদের দর্শনের জন্য খুলে দেওয়া হয়। আসবাবপত্র তেমনটাই রাখা আছে যেমন ছিল হেমিংওয়ের সময়ে।
এক আলমারিতে বিশ্বের নানা ভাষায় অনুদিত তার বইগুলি। কোণায় বিছানার উপরে তার উপরে ছাপা নানা পত্রিকার সমারোহ, পাশে আদ্যিকালের টেলিফোন। দেয়ালে মুষ্টিযুদ্ধ ও নিসর্গের চিত্রকর্মের সাথে সাথে নানা স্মৃতিময় আলোকচিত্র। এক পাশে আফ্রিকা থেকে আনা নানারকম বল্লমের সংগ্রহ, সেই সাথে অবশ্যম্ভাবীভাবে মাছ ধরার বড়শিরও।
ঘরের মূল আকর্ষণ এর ঠিক মাঝখানে, তারই ব্যবহৃত চেয়ার-টেবিলের উপর রাখা টাইপ রাইটার, যা দিয়ে এই হোটেল কক্ষে বসেই তিনি রচনা শুরু করেছিলেন স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ নিয়ে তার অমর ক্ল্যাসিক ফর হুম দ্য বেল টোলস। টাইপরাইটারের সাথে তার হাতে লেখা উপন্যাসটির একটি পাতাও আছে, নানা যাচাই-বাছাইয়ের নকশায় ভরা। জানালায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ল ওল্ড হাভানার জীবন ও দৃশ্য, যার প্রেমে পড়ে কালজয়ী লেখক এক মাঝারি আকৃতির ঘরেই কাটিয়ে ছিলেন এতগুলো বছর।
এর পরপরই তার জীবনের আবার সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো আসে নব রমণীর প্রেম, মার্থা গেলহর্ন নামের আমেরিকান সাংবাদিকের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন হেমিংওয়ে (মার্থা ছিলেন তার ৩য় স্ত্রী)। মার্থা জানায় এই হোটেলঘরে সংসার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়, খুঁজতে হবে নতুন আশ্রয়। তবে তাই হোক!
হাভানার ১৫ মাইল দূরে ফিনকা ভিগিয়া নামের এক খামার বাড়ি ভাড়া করলেন নতুন সংসার পাতবার আশায়, ১৯৩৯ সালে। পরের বছর বাড়িটি এতটাই ভাল লাগল মিয়া-বিবির যে কিনেই নিলেন সারা জীবনের জন্য। ১৯৪৫ সালে তাদের ডিভোর্স হয়ে গেলেও জীবনের ২১টি বছর এখানে কাটান লেখক, ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। কিউবান সরকার অনেক আগেই জাদুঘরে পরিণত করেছে ফিনকা ভিগিয়াকে। সেটিই এবারের হেমিংওয়ে পরিক্রমায় আমাদের শেষ গন্তব্য।
হাভানায় চলমান অ্যান্টিক গাড়ির অভাব নেই, এখনে রাস্তায় যেগুলো বহাল তবিয়তে চলছে তা অনায়াসে অন্য যেকোনো দেশের কালেক্টরস আইটেম হতে পারে। অধিকাংশই পঞ্চাশের দশকের বিশালাকায় চার চক্রযান। এমন একটায় চেপে পৌঁছানো গেল ফিনকা ভিগিয়া। চমৎকার সবুজ বাগানের মাঝে সফেদ স্নিগ্ধ স্থাপনা, সুরকি বিছানো পথ চলে গেছে পেছনের বারান্দা পর্যন্ত, আরেকটা পিচ ঢালা পথ গেছে মূল ফটক দিয়ে খানিকটা ঘুরে সিংহ দরজা পর্যন্ত। বিশাল এলাকাজুড়ে নানা গাছের সমাহার, বাঁশ ঝাড় থেকে শুরু করে অর্কিড কী নেই সেখানে। বাগানের এক প্রান্তে আলাদা করে রাখা আছে লেখকের বিখ্যাত নৌকা পিলার।
পিলারের ইতিহাসও কম রোমাঞ্চ জাগানিয়া নয়, ১৯৩৪ সালে এই নৌকাটি কেনেন আজীবন মাছ শিকারের ভক্ত হেমিংওয়ে। ক্যারিবিয়ার নানা অঞ্চলে বিশালাকার মাছ শিকার করেন এর সাহায্যে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে কিউবার জলসীমানায় জার্মান সাবমেরিন চিহ্নিত করার কাজ চালায় পিলার। অধিকাংশ সময়েই এর ক্যাপ্টেন ছিলেন গ্রেগ্ররী ফুয়েন্তেস। উইলে পিলারকে ফুয়েন্তেসের কাছেই সমর্পণ করে যান হেমিংওয়ে। জানা যায় হেমিংওয়ের মৃত্যুর পর অনেকেই পিলারে চেপে মাছ ধরতে যাবার জন্য মোটা টাকা সাধতে থাকে ফুয়েন্তেসকে, কিন্তু তার মন সায় দেয় না এতে। শেষে ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কাছে ধর্না দেন তিনি, জানান সবচেয়ে খুশি হবেন পিলারকে হেমিংওয়ের বাড়িতে নিয়ে গেলেই।
ফিদেলের সঙ্গে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল হেমিংওয়ের (সিয়েরা মায়েস্ত্রে পর্বতে গেরিলা অভিযান চলাকালীন সময়ে ফিদেলের বেড টাইম পড়ার বই ছিল ফর হুম দ্য বেল টোলস), বন্ধুর স্মৃতি রক্ষার্থে ফিদেলের তত্ত্বাবধানে পিলারের শেষ আবাসস্থান হয় ফিনকা ভিগিয়া যা লেখক দিয়ে গিয়েছিলেন কিউবার জনগণকে।
মজবুত নৌকাটি আছে যথাযথ অবস্থায়, যেখানে কোনো অবস্থাতেই জুতো পায়ে উঠতেন না হেমিংওয়ে। চোখে পড়ে ক্যাপ্টেনের হুইল আর মাছ শিকারির বসার চেয়ার। কিউবাতে বলা হত, সকালে হেমিংওয়ে টাইপ রাইটারের সাথে যুদ্ধ করেন আর বিকেলে পিলারে চেপে সমুদ্রের মাছদের সাথে!
পিলারের পাশেই এক ছোট কবরস্থান, যেখানে আছে তাদের পোষা চারটি কুকুরের নামসহ সমাধি ফলক (বেড়াল পোষারও সাংঘাতিক বাতিক ছিল হেমিংওয়ের, এই বাড়িতে ক্রস ব্রিডিং-এর মাধ্যমে নতুন প্রজাতির বেড়াল সৃষ্টিরও চেষ্টা চালান তিনি, এক পর্যায়ে তো এখানে ৫৭টি বেড়াল ছিল)।
পাশেই বিখ্যাত সুইমিং পুল যেখানে একদা ভুবন কাঁপানো হলিউড অভিনেত্রী আভা গার্ডনার জন্মদিনের পোশাকে সাঁতার কেটেছিলেন, এখানে আরো জড়িয়ে আছে ক্যারি গ্রান্টসহ হেমিংওয়ের আরো কজন মহারথী চিত্রতারকা বন্ধুর স্মৃতি। জানা গেল ৫টি ভাষায় খুব ভালো দখল ছিল তার, অনর্গল বলতে পারতেন স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, জার্মান, ফরাসী আর মাতৃভাষা ইংরেজি!
ফিনকা ভিগিয়ার সংগ্রহ এতই মূল্যবান আর ব্যপক যে খোয়া যাবারও ক্ষতি হবার ভয়ে সেই বাড়ির ভিতরে কোনো দর্শনার্থীর প্রবেশাধিকার নেই! তাদের অধিকার কেবলমাত্র বিশালকার দরজা ও জানালাগুলো দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবেশির ন্যায় উঁকি মেরে দেখবার, অবশ্য তাতেই পুরোটা দেখা হয়ে যায় (সেই কারণেই বৃষ্টির দিনে বা সময়ে এটি খোলা হয় না !)। বাড়িটি ঠিক তেমনি সাজানো আছে যেমনটা ছিল ১৯৬০ সালে যখন হেমিংওয়ে কিউবা ত্যাগ করেন।
অনেকগুলো ঘর। আলোবাতাস খেলছে সর্বদাই। বিশাল প্রশস্ত বসার ঘরের এক পাশে শোবার ঘর, আছে অতিথি কক্ষ, খাবার ঘর। প্রতিটি ঘরে আছে বই ! হাজার হাজার বই। সেই সাথে ম্যাগাজিন। জানা গেল কম পক্ষে নয় হাজার বই আছে এই বাড়িতে। আর সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিটি ঘরের দেয়ালেই আছে শিকারি হেমিংওয়ের আফ্রিকার থেকে আনা নিজস্ব শিকারের নিদর্শন- নানা জাতের হরিণ, অ্যান্টিলোপ, বুনো মহিষ, চিতা, সিংহ কী নেই সেখানে! সেই সাথে ষাঁড়ের লড়াইয়ের নানা স্মারক, বিশালাকার বিজ্ঞাপন। আছে ফরমালিনে সংরক্ষিত কিছু জীব। আর তাঁর পছন্দের পানীয়গুলোর বোতল।
বাড়ির বাথরুমটিও কম আকর্ষণীয় নয়, এখানেও আছে তিন তাক বই। তবে দর্শনার্থীরা খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করেন কমোডের পাশেই দেয়ালে হেমিংওয়ের নিজে হাতে লেখা এমন কিছু যা পৃথিবীর কোনো পত্রিকায় লেখা হিসেবে ছাপা হয়নি- এটি তার কয়েক বছর ধরে প্রতিদিনকার ওজন !
কী এমন আকর্ষণ ব্যক্তি হেমিংওয়ের যা প্রতিদিন আকৃষ্ট করে লাখো লাখো মানুষকে? এর উত্তর মনে হয় লুকিয়ে আছে তার সাহিত্যকর্মের ভিতরেই। তার রচিত চরিত্রগুলোর মতোই ছিলেন তিনি একরোখা, লড়াকু, উল্লাসপ্রিয়, জীবনের সবকটি রঙ আদুল গায়ে মেখে নিতে চাওয়া এক মানুষ যার মন্ত্র ছিল- শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল ছেড় না। শারীরিক ও মানসিকভাবে বারংবার নানা কারণে ভেঙ্গে পড়া মানুষটি ফিরে এসেছেন বারবার প্রবল বিক্রমে, মেতে উঠেছেন নব সৃষ্টির উম্মাদনায়। তার ব্যক্তিজীবন আর সাহিত্যকর্ম যৌথভাবে মিলেই না তৈরি হয়েছে হেমিংওয়ে নামের কিংবদন্তীর। হয়ত পাঠকেরা সেই অতিমানবের জীবন কেমন ছিল এই কৌতুহল থেকেই যান এই সব হেমিংওয়ে তীর্থ দর্শনে।
বাড়ির পাশেই আলাদা বেশ উঁচু একটা টাওয়ার, যার উপরে হেমিংওয়ের একান্ত ব্যক্তিগত চিলেকোঠা। হয়ত একান্ত চিন্তা-ভাবনা ও লেখার সময় সেখানে কাটাতেন তিনি, অথবা খুব গরমের সময়ে, সেই চিলেকোঠা থেকে দেখা যায় সুনীল সাগর আর দূরের মোহময়ী হাভানা শহর। সেইখানেও বেশ কিছু বই আর সদ্য বধকৃত চিতার সাথে শিকারি-লেখকের এক পেইন্টিং। ছোট্ট ঘরে একটাই টেবিল, উপরে তার ব্যবহৃত রয়্যাল টাইপ রাইটার। বারান্দা থেকে সবুজ পাহাড় আর নীল সমুদ্রের মাঝের হাভানা দেখা যাচ্ছে।
ভাবছি, কিউবা ছেড়ে হেমিংওয়ে আমেরিকা চলে যান ১৯৬০ সালে, পরেই বছরেই নানা হতাশায় আত্নহনন করেন। কে জানে, হয়ত এই আলোকময় দ্বীপে যেখানে জীবনের অধিকাংশ সময় ভালোবেসে কাটিয়েছিলেন হয়ত এখানে থাকলে আরো অনেক বছর সংগ্রামময় জীবন কাটিয়েই আমাদের দিতেন অমর সব সাহিত্যমালা।