রাজার রাজ্যে তামিমরা যেন প্রজা, সিরিজ জিতলো জিম্বাবুয়ে
আগের ম্যাচে ইনোসেন্ট কাইয়াকে নিয়ে সিকান্দার রাজার শাসন। একইভাবে তা জারি রাখলেন দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও। এবার অধিনায়ক রেজিস চাকাভাকে নিয়ে কাণ্ডারীর ভূমিকায় ছুটলেন রাজা। যেখানে জিম্বাবুয়ের বিজয়ের গল্প, সেখানেই যেন রূপকথার রাজকুমার রাজা। টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকে রানের ফোয়ারা বইয়ে আসা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের ব্যাট যেন খোলা এক তরবারি, আর সেই তরবারির শাসনে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা সোজা প্রজার কাতারে। এবার চাকাভার সঙ্গে রেকর্ড জুটি গড়ে দলকে ঐতিহাসিক এক জয় এনে দিলেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের ত্রাতা হয়ে ওঠা রাজা।
রোববার হারারে স্পোর্টস ক্লাবে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৫ উইকেটে হেরে গেছে বাংলাদেশ। এই হারে এক ম্যাচ আগেই সিরিজ হারলো তামিম ইকবালের দল, জিম্বাবুয়ে মাতলো জয়ের উল্লাসে। যে বাংলাদেশের বিপক্ষে গত কয়েক বছর ধরে কেবল হেরে আসতে হয়েছে, সেই বাংলাদেশের বিপক্ষেই বিজয় নিশান উড়ালো তারা। ৯ বছর পর বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জিতলো আফ্রিকার দেশটি। সর্বশেষ ২০১৩ সালে জিতেছিল তারা।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশ উড়ন্ত সূচনাই পায়। কিন্তু সেই পথে থাকা হয়নি। বড় সংগ্রহ গড়ার পথ পেয়েও মাঝে পথচ্যুত হওয়া ও ধীর গতির ব্যাটিংয়ে তা হয়নি। পরে আফিফ হোসেন ধ্রুব ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটে ৯ উইকেট ২৯০ রান তোলে বাংলাদেশ। জবাবে আগের ম্যাচের মতোই দুঃস্বপ্নের শুরুর পরও দলকে পথ হারাতে দেননি ম্যাচসেরা রাজা। পরে তার সঙ্গে যোগ দেন চাকাভা। পঞ্চম উইকেটে তাদের রেকর্ড জুটিতে ১৫ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটের জয় তুলে নেয় জিম্বাবুয়ে। শেষ দিকে নেমে ঝড় তোলেন অভিষিক্ত অলরাউন্ডার টনি মুনইয়োঙ্গা।
সিকান্দার রাজা যেমন আগের ম্যাচের মতো করেই নিজের ও দলের গল্পটা লিখেছেন, বাংলাদেশের বেলাতেও তাই। আগের ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও কম রান করার আক্ষেপ সঙ্গী হয় বাংলাদেশের। কোনো ব্যাটসম্যানই ওয়ানডেসুলভ ব্যাটিং করতে পারেননি। পরে ফিল্ডিংয়ে আবার দুর্দশা অবস্থা দেখা যায় সফরকারীদের। এ ম্যাচে সেভাবে ক্যাচ মিস না হলেও ফিল্ডিংয়ে হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে বেশ কিছু রান। বল হাতে শুরুটা ভালো হলেও পরে আর ধার ছিল না বাংলাদেশের বোলিংয়ে।
তবে হারের নেপথ্যে যেমন নিজেদের ভুল ছিল বাংলাদেশের, তেমনি ছিল রাজার বীরত্বগাঁথা। ধংসস্তূপ থেকে কীভাবে ফিনিক্স পাখির মতো উড়াল দিয়ে বীরদর্পে সাফল্যের গল্প লিখতে হয়, সেটা যেন তিনিই সবচেয়ে ভালো করে জানেন। প্রথম ওয়ানডেতেও অগোছালো শুরুর পর কাইয়াকে নিয়ে চতুর্থ উইকেটে বিশাল জুটি গড়ে দলকে জেতান সেঞ্চুরিয়ান রাজা। এ ম্যাচে সেটারই পুনরাবৃত্তি, শুধু বদলেছে তার সঙ্গী। এই সিরিজের আগে ৩টি সেঞ্চুরি ছিল ৯ বছর ধরে ওয়ানডে খেলা রাজার। দুই ম্যাচ পরই সংখ্যাটা হয়ে গেল ৫। যে দুই ম্যাচে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার ছুঁয়ে, ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পুরো জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটকেই আলোকিত করে তুললেন তিনি।
অথচ কী চাপের বোঝা মাথায় নিয়ে এই দুই ম্যাচে খেলতে হয়েছে রাজাকে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ২৯১ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নামা জিম্বাবুয়েকে শুরুতেই পথ ভুলিয়ে দেন হাসান মাহমুদ। গতিময় বোলিংয়ে ইনিংসের প্রথম ওভারেই টাকুডওয়ানশে কাইটানো ও তৃতীয় ওভারে ইনোসেন্ট কাইয়াকে ফিরিয়ে দেন বাংলাদেশের তরুণ এই পেসার। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই জিম্বাবুয়ের ইনিংসে আঘাত হানেন মেহেদী হাসান মিরাজ, ফেরান ওয়েসলে মাধেভেরেকে। শুরু থেকে ধরে খেলা টাডিওয়ানাশে মারুমানিকে তাইজুল ইসলাম আউট করলে মাঝ দরিয়ায় পড়ে যায় জিম্বাবুয়ে।
৩০০ ছুঁইছুঁই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে ৪৯ রানেই নেই ৪ উইকেট, তখন হয়তো চোখের সামনে হারের ছবিই দেখতে পাচ্ছিল জিম্বাবুয়ে। কিন্তু সেই ছবি বদলে দিতে সময়ই নেননি রাজা ও অধিনায়ক চাকাভা। দুর্বার এক জুটি গড়ার পথে প্রথম অংশটা তারা সাজান ধৈর্যর দেয়াল তুলে। এরপর ক্রমেই রান তাড়ায় ব্যাট চালাতে থাকেন দ্রুত গতিতে, যা চলে ৪২তম ওভার পর্যন্ত। মাঝের এই সময়টায় কেবল তাদের শাসনই হজম করে যান বাংলাদেশের বোলাররা।
দলের দুঃসময়ে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে কীভাবে পথ পাড়ি দিতে হয়, সেটার গল্প লিখে রাজা ও চাকাভা গড়েন ১৬৯ বলে ২০১ রানের জুটি। যা পঞ্চম উইকেটে জিম্বাবুয়ের সর্বোচ্চ রানের জুটি। জুটিটি হারারে স্পোর্টস ক্লাবেও ষষ্ঠ উইকেটে সেরা এবং যেকোনো উইকেটে জিম্বাবুয়ের তৃতীয় সেরা। এই জুটিতে ২৫০ রানে পৌঁছে যায় স্বাগতিকরা। নেতার দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামা চাকাভা ৭৫ বলে ১০টি চার ও ২টি ছক্কায় ১০২ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলে আউট হন। এর আগে ৭৩ বলে ১০০ ছুঁয়ে হয়ে যান জিম্বাবুয়ের ওয়ানডে ইতিহাসের দ্রুততম সেঞ্চুরিয়ান। এটাই তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি ও সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
চাকাভার বিদায়ের পর রাজাকে খুব বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়নি। অভিষেক ওয়ানডে খেলতে নামা মুনইয়োঙ্গা উইকেটে গিয়েই ঝড় তোলেন। রাজাকে অন্য প্রান্তে রেখে তাণ্ডব চালান তিনি। ডানাহাতি এই অলরাউন্ডার ১৬ বলে ২টি করে চার ও ছক্কায় ৩২ রান করে নিমেষেই জয়ের কাজটি সারেন। এ সময় কিছুটা ভারহীনই থেকেছেন চোক ধাঁধানো ব্যাটিংয়ে পুরো ইনিংস টেনে নিয়ে আসা রাজা। ১২৭ বলে ৮টি চার ও ৪টি ছক্কায় ১১৭ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। বাংলাদেশের হয়ে হাসান ও মিরাজ ২টি করে উইকেট নেন। একটি উইকেট পান তাইজুল।
এর আগে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের শুরুটা হয় দারুণ। ১১ ওভারে স্কোরকার্ডে ৭১ রান যোগ করেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল ও এনামুল হক বিজয়। এ সময় বিজয় ধীর গতিতে ব্যাট চালালেও তামিম ছিলেন মারকুটে মেজাজে। যদিও ১১ বলে চার ও ছক্কায় ৪৬ রান করা বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তার খেলঅ বাকি বলগুলো সেভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। বাকি ৩৪ বল থেকে মাত্র ৪ রান তোলেন তিনি।
অফ সাইডে ছয়জন ফিল্ডারের মাঝ দিয়ে জায়গা খুঁজে নিয়ে চারের ফুলঝুরি সাজানো তামিম ৪৫ বলে ৫০ রান করে আউট হন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫৫তম হাফ সেঞ্চুরিটি ১০টি চার ও একটি ছক্কায় সাজান অভিজ্ঞ এই ওপেনার। দলীয় ৭১ রানে তামিমকে হারানো বাংলাদেশ দ্বিতীয় উইকেট হারায় একটু পরই।
ধীর শুরুর পর হাত খুলে খেলা শুরু করা বিজয় নিজের দোষে আউট হয়ে বিদায় নেন। টানাকা শিভাঙ্গার করা ১৩তম ওভারের তৃতীয় বলে নাজমুল হোসেন শান্ত স্ট্রেইট ড্রাইভ খেলেন। স্টাম্প বরার বল থাকায় তাতে হাত ছুঁয়ে দেন শিভাঙ্গা। এ সময় পপিং ক্রিজের বাইরে থাকা বিজয় চেয়ে চেয়ে তা দেখছিলেন। স্টাম্পে বল লাগার পরে ব্যাট ভেতরে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। ২৫ ববেল ৩টি চারে ২০ রান করে বিদায় নেন ডানহাতি এই ওপেনার।
দ্রুত দুই উইকেট হারানোর চাপ কাটিয়ে তোলে শান্ত ও মুশফিকুর রহিম। তৃতীয় উইকেটে ৫০ রানের জুটি গড়ে তোলেন তারা। তবে তারা কেউই শুরুর ধারায় থেকে রান বাড়িয়ে নিতে পারেননি। দুজনই ধীর গতির ব্যাটিং করেন। ৩১ বলে একটি চারে ২৫ রান করা মুশফিকের বিদায়ে ভাঙে এই জুটি। এরপর শান্তও বেশি সময় টিকতে পারেননি। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান দলীয় ১৪৮ রানে সাজঘরে ফেরেন। এর আগে ৫৫ বলে ৫টি চারে ৩৮ রান করেন তিনি।
এরপর ইনিংসের সবচেয়ে বড় জুটিটি পায় বাংলাদেশ। পঞ্চম উইকেটে ৮২ বলে ৮১ রানের জুটি গড়েন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও আফিফ হোসেন ধ্রুব। আফিফ ৪১ বলে ৪টি চারে ৪১ রান করে ফিরলেও মাহমুদউল্লাহ লড়েন শেষ পর্যন্ত। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২৬তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেওয়ার দিনে অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যান ৮৪ বলে ৩টি করে চার ও ছক্কায় হার না মানা ৮০ রান করেন। প্রায় দেড় বছর আর ১১ ইনিংস পর ওয়ানডেতে হাফ সেঞ্চুরি করলেন তিনি। মেহেদ হাসান মিরাজ ১২ বলে ২টি চারে ১৫ রান করেন।
এই সিরিজে ব্যাটে-বলে বাংলাদেশের জন্য যমদূত হয়ে ওঠা সিকান্দার রাজা তার স্পিন ভেল্কিও দেখিয়েছেন। ব্যাট হাতে রাজত্ব কায়েম করার আগে ডানহাতি এই অফ স্পিনার জিম্বাবুয়ের হয়ে সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট নেন। ২টি উইকেট পান ওয়েসলে মাধেভেরে। এ ছাড়া একটি করে উইকেট শিকার করেন ভিক্টর নিয়াউচি ও টানাকা শিভাঙ্গা।