বিশ্বের ডিজেল সরবরাহ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে
দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক বিকাশ দুর্বল হওয়ার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে দিকে দিকে; তবুও ডিজেলের আঞ্চলিক বাজারগুলিতে সরবরাহ রয়েছে টান টান অবস্থায়। এই বছরের শীতকালেই আবার রাশিয়ার পরিশোধিত ও অপরিশোধিত (ক্রুড) তেল আমদানিতে কার্যকর হওয়ার কথা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা– ইউরোপের বাজারে তখন চাহিদার তুলনায় ডিজেল ঘাটতি আরও বাজে রূপ নিতে পারে।
এরমধ্যেই পরিশোধিত জ্বালানির তেলের মজুদ নিম্ন অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে। চলতি গ্রীষ্মেও আমেরিকায় মজুদ বাড়েনি। এমনকী জুলাইয়ে ৩২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নামে এ মজুদ।
রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাচ্ছে ইউরোপ। চলছে শিল্প উৎপাদন ও পরিবহন খাতে তেল পণ্য (যেমন- ডিজেল, পেট্রোল) ব্যবহারের চেষ্টা। এতে ইউরোপের জ্বালানি বাজার আরও আঁটসাঁট অবস্থায় থাকবে।
শীত নামলেই ঘর উষ্ণ রাখতে জ্বালানির চাহিদা বাড়ে ইউরোপে, ইউক্রেন যুদ্ধের আগে তা নিয়ে ছিল না ভাবনা। সস্তায় কেনা রাশিয়ান গ্যাস দিয়ে নির্ভাবনায় হিমেল শীত মৌসুম পাড়ি দিত ইইউ দেশগুলি। এখন ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ায় ইইউতে সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে মস্কো। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যখন ইউরোপে শীতকাল নামবে– তখন গ্যাসের বিকল্প হিসেবে জ্বালানি তেলের থাকবে আরও বেশি চাহিদা। ফলে সরবরাহ ঘাটতিও চরম হবে।
২০২৩ সালের শুরুতেই আবার সমুদ্রপথে আমদানি করা রাশিয়ান তেলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে ইইউ। শীতের দৈত্য তখনও থাকবে। নিষেধাজ্ঞাটি এসময় কার্যকর হলে বিকল্প হিসেবে তেলের চাহিদা উঠবে তুঙ্গে।
এদিকে ইউরোপের রুশ জ্বালানি বর্জনের চেষ্টায়—পোয়াবারো আমেরিকার। আটলান্টিকের অপর পাড় থেকে মার্কিনীরা ডিজেলের বিপুল চালান পাঠাচ্ছে, ইউরোপে এ রপ্তানির পরিমাণও ক্রমে বাড়ছে। কিন্তু, এই সরবরাহ আরও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই কম; কারণ খোদ মার্কিন মুল্লুকেই ডিজেলের মজুদ এই মৌসুমে গড়ে যে পরিমাণ থাকে- তার চেয়ে কম রয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টাও তথৈবচ। ক্রুড পরিশোধনে এরমধ্যেই পূর্ণ সক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছেছে আমেরিকান রিফাইনারি শিল্প।
গত ২৯ জুলাই নাগাদ আমেরিকায় সব ধরনের পরিশোধিত জ্বালানির মজুদ ২৪ লাখ ব্যারেল কমে; যা বছরের এই সময়ে থাকা গড় মজুদের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম বলে জানাচ্ছে মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন (ইআইএ)-র তথ্য।
২৯ জুলাই পর্যন্ত ডিজেল, হিটিং অয়েলসহ অন্যান্য পরিশোধিত তেলের মজুদও ১৯৯৬ সালের পর সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসে। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের জ্বালানি বাজার বিশ্লেষক জন কেম্প এ প্রাক্কলনের কথা তুলে ধরেন।
সাধারণত গ্রীষ্মকালে ঊর্ধ্বমুখী থাকে আমেরিকার পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ভাণ্ডার। কারণ এ সময়ের বাড়তি চাহিদা মেটাতে ক্রুড প্রক্রিয়াজাত করে গ্যাসোলিন উৎপাদনও হয় বেশি। চলতি বছরে হয় তার ব্যতিক্রম। জুলাইয়ে পরিশোধিত জ্বালানি মজুদ কমেছে ৩০ লাখ ব্যারেল; কেম্প উল্লেখ করেন, ১৯৯০ এর দশকের পর মৌসুমি মজুদের এটি সবচেয়ে বড় পতন।
রাশিয়ান ক্রুড ও পরিশোধিত জ্বালানি পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে সেখানকার আমদানিকারকরা ভিন্ন উৎস থেকে ডিজেল কেনা বাড়াচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র তেমনই একটি উৎস। জুলাইয়ে প্রতিদিন ১৪ লাখ ব্যারেল ডিজেল রপ্তানি করেছে আমেরিকা, যা পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রপ্তানি বৃদ্ধিতে সিংহভাগ অবদান ছিল ইউরোপের ডিজেল তৃষ্ণার।
তার মানে অবশ্য এই নয় যে রাশিয়ার ডিজেল কেনা কমেছে ইউরোপের। উল্টো জুলাইয়ে তা লক্ষ্যণীয় হারে বাড়ার তথ্য এ সপ্তাহে জানিয়েছে জ্বালানি পণ্যের লেনদেন অনুসরণকারী সংস্থা- ভরটেক্সা।
গত মাসে (জুলাইয়ে) ইউরোপের দেশগুলির রাশিয়ান উৎসের ডিজেল আমদানি ১৩ শতাংশ বেড়েছে (মাসিক হিসাবে)। দৈনিক আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেলের মতো উচ্চ মাত্রায়। এমনকী রাশিয়ান ডিজেল আমদানি- অন্য উৎসের ডিজেল আমদানির চেয়ে বেশি হয়েছে দৈনিক প্রায় ২ লাখ ব্যারেল।
ভরটেক্সার প্রধান অর্থনীতিবিদ ডেভিড ওয়েচ লিখেছেন, 'ইউরোপ ডিজেল আমদানি নিষিদ্ধের যে ঘোষণা দিয়েছে–সম্পূর্ণরূপে তা অনুসরণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। গত পাঁচ মাস ধরে ইউরোপীয় বাজারে ডিজেলের দামে রেকর্ড হয়েছে। রাশিয়ান ডিজেলের ওপর তাদের নির্ভরতা কমার বদলে বরং বাড়তেই দেখা যাচ্ছে। বৈশ্বিক রিফাইনারি শিল্পের উৎপাদন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতাও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তার ওপর আবার ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের শূন্যস্থান পূরণে এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে ডিজেলের ব্যবহারও বাড়ছে। এসব ঘটনা ইউরোপের রাজনীতিবিদদের দৃঢ়তায় চিড় ধরাবে'।
ওয়েচ প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেন, ইউরোপে উচ্চ মুনাফায় ডিজেল বিক্রির হাতছানি মার্কিন রিফাইনারিগুলিকে উৎপাদন বৃদ্ধির উৎসাহ যোগায় কিনা– নিকট ভবিষ্যতে সেদিকটাও গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
তবে মার্কিন পরিশোধনাগার শিল্প জানাচ্ছে, ইউরোপে ডিজেল রপ্তানি বর্তমান মাত্রার চেয়ে বাড়ানোর সক্ষমতা কমই আছে তাদের।
আমেরিকার টেক্সাস-ভিত্তিক বৃহৎ পরিশোধানাগার কোম্পানি- ভ্যালেরো এনার্জি। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী সহ-সভাপতি গ্যারি সিমন্স গত সপ্তাহে বলেছেন, 'ইউরোপে আরও বেশি ডিজেল রপ্তানি করাটাই এখন আমাদের জন্য সত্যিকার চ্যালেঞ্জ'।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ডিজেল মজুদ কম থাকায়–গ্যারি জানান, 'রিফাইনারি শিল্প সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে; এই অবস্থায় ইউরোপে আরও রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনা দেখি না'।
এদিকে ইউরোপে চলছে চরম তাপপ্রবাহ। এতে শুকিয়ে গেছে প্রধান প্রধান অনেক নদীর পানি। জ্বালানি পরিবহনের একটি প্রধান করিডর হচ্ছে- রাইন নদী। তীব্র পানি স্বল্পতার কারণে নদীটিতে নাব্যতা সংকট দেখা দিয়েছে, ইউরোপের অভ্যন্তরে জ্বালানি পরিবহন এতে আরও ব্যাহত হচ্ছে। অস্ট্রিয়া ভিত্তিক বহুজাতিক তেল,গ্যাস ও পেট্রোকেমিক্যাল কোম্পানি- ওএমভি'র জার্মান ইউনিট জানিয়েছে, তাদের ডিজেল ও হিটিং অয়েল পরিবহন এতে চাপের মুখে পড়েছে।
ইউরোপের অর্থনীতিগুলো গতি হারাচ্ছে। জ্বালানি চাহিদা তাই কমারই কথা। কিন্তু, তার মধ্যে ঘটছে গ্যাস থেকে সরে এসে তেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার এই ঘটনা; এর সঙ্গে আগামী শীতের জন্য পরিশোধিত জ্বালানির যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, তা খুব সম্ভবত ইউরোপে ডিজেলের বাজারের সরবরাহকে টান টান অবস্থাতেই রাখবে। এবং তাতে দামও থাকবে চড়া। এতে করে, ইউরোপে বিশ্বের অন্য উৎস থেকে ডিজেল রপ্তানি বাড়তে থাকলে- উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলির ঘাড়ে আমদানি ব্যয়ের চাপ আরও বাড়বে।
- সূত্র: অয়েলপ্রাইস ডটকম