বাঘ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে গাই মাউন্টফোর্টকে যেদিন বিস্মিত করে দেন বঙ্গবন্ধু
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার কিছুদিন পর বাংলাদেশ বন বিভাগের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান বন সংরক্ষক আব্দুল হামিদ।
বঙ্গবন্ধু প্রথমেই তাঁদের জিজ্ঞাসা করেন, আমার বনের খবর কী?
সে সময় সিলেট, টাঙ্গাইল, সুন্দরবন অঞ্চল যুদ্ধের ফলে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ছিল। বলতে গেলে দেশের সমস্ত বনাঞ্চলগুলির প্রশাসনিক অবস্থা ভেঙে পড়েছিল। প্রতিনিধিদল সেটাই বঙ্গবন্ধুকে জানালেন।
বঙ্গবন্ধু জানালেন তাঁর সরকার যত দ্রুততায় পারা যায়, ব্যবস্থা নেবে। প্রতিনিধিদল ক্ষয়ক্ষতির একটি খতিয়ান তৈরি করেছিল, সেটা দেখতে দেখতে বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনাদের বনকন্যা, বনরানী লঞ্চগুলো আমার খুব পছন্দের। সম্ভব হলে সুন্দরবনে যাব একবার, লঞ্চগুলোর যত্ন নেবেন।
১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে গাই মাউন্টফোর্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এই মাউন্টফোর্ট ছিলেন ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য, বিখ্যাত পক্ষীবিদ ও বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের (ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড) ট্রাস্টি।
পূর্ব পাকিস্তানের বনের অবস্থা
গত শতাব্দীর ষাটের দশক পর্যন্ত এ দেশে কী কী ধরনের বন্যপ্রাণ আছে তার চেকলিস্ট ছিল না।
১৯৬৭ সালে পাকিস্তান ওয়াইল্ডলাইফ অ্যাপিল গঠিত হলে তারা বন্যপ্রাণী তহবিলের কাছে আবেদন জানায়, যেন তারা পাকিস্তানের বন্যপ্রাণীর হাল-হকিকত জানতে বহুমুখী বিশেষজ্ঞের একটি অভিযান দল পাঠায়। বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল সহায়তা করতে রাজি হয়। মাউন্টফোর্ট সেই দলের নেতা হয়ে আসেন। অন্যান্য সদস্যরা হলেন জর্জ শ্যানন, লর্ড ফুমে, তখনকার বিশ্বের নামকরা বন্যপ্রাণের আলোকচিত্রী এরিক হসকিন্স।
সে সময় পাকিস্তানের পর্যটন দপ্তর পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনে (পিআইডিসি) ন্যস্ত ছিল। অভিযান দলের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের অন্যতম উদ্যোক্তা জি এম এম ই করিম।
দলটি প্রথমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সুন্দরবন, সিলেটের জঙ্গল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃষ্টিপাতের জঙ্গলে অভিযান চালায়। প্রাপ্ত সমস্ত বন্যপ্রাণের তথ্য নথিবদ্ধ করে। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি আমাদের দেশে কত রকমের বন্যপ্রাণ রয়েছে। অভিযানটি নিয়ে মাউন্টফোর্ট চমৎকার একটি বই লিখেছেন, আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন—The Vanishing Jungle: The story of the World Wildlife Fund Expeditions to Pakistan (1969), Collins London.
বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিলের পক্ষ থেকে গাই মাউন্টফোর্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে ভারতবর্ষে বাঘ রক্ষার প্রথম কার্যকরী পদক্ষেপ 'বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প' গ্রহণ করতে রাজি করান। ১৯৭৩ সালের পহেলা এপ্রিল ভারত বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্প চালু করে।
বন্যপ্রাণের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু ও বিশ্বের আগ্রহ
মাউন্টফোর্ট নিজে সুন্দরবনের বাঘের অবস্থা জেনেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঘের অস্তিত্ব টের পেয়েছিলেন। এলাকা দুটোই ভারত সীমানা সংলগ্ন। মাউন্টফোর্ট বুঝেছিলেন দুদেশের সরকারপ্রধানরাই যদি বাঘ প্রকল্পে আগ্রহী হয়, তাহলে উপমহাদেশের অনবদ্য প্রতিবেশ রক্ষা পাবে। এটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। মাউন্টফোর্টের দিকনির্দেশনায় আগেই সুন্দরবনের তিনটি অঞ্চল 'অভয়ারণ্য' হিসেবে বেষ্টিত হয়েছিল। এবার এসেছেন বঙ্গবন্ধুকে বাঘ প্রকল্প হাতে নিতে অনুরোধ করতে। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে মহাব্যস্ততার মধ্যেও বঙ্গবন্ধু মাউন্টফোর্টকে অনেকটা সময় দিয়ে, ধৈর্য ধরে তাঁর কথা শুনলেন। এক বাক্যেই প্রকল্প হাতে নিতে রাজি হলেন—যদি প্রকল্পের ব্যয়ভার বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল বহন করে।
বাঘ রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর আগ্রহ মাউন্টফোর্টকে অবাক ও চমৎকৃত করেছিল। তিনি তাঁর বইতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে উষ্ণ আলোচনা, বঙ্গবন্ধুর আগ্রহের কথা বড় মুখে লিখে গেছেন। আগ্রহী পাঠক মাউন্টফোর্টের Saving The Tiger (1981), Publisher Michael Joseph, London ISBN 0-7181-1991-6 পড়ে দেখতে পারেন।
মাউন্টফোর্টের অবাক হবার সংগত কিছু কারণ আছে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে বিশ্বনেতাদের বন্যপ্রাণ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
একটা উদাহরন দিচ্ছি। ১৯৫০ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় আসার পর চারদিক থেকে যখন খাদ্য পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, সরকার তখন খুব বিপদে পড়ে যায়। চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুং তাঁর 'গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড' নীতির অংশ হিসেবে অকাতরে জঙ্গল ধ্বংস ও বাঘকে অনিষ্টকারী প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেন। সে সময় পৃথিবীর নয় উপপ্রজাতির বাঘের মধ্যে চীন দেশে তিনটি উপজাতির বসবাস ছিল। এরমধ্যে দক্ষিণ চীনের বাঘ (Panthera Tigris Amoyensis) সংখ্যায় ছিল চারশোর মতো। পরের বারো বছরে এই প্রজাতিটি নিশ্চিহ্ন হতে বসে।
অনেক বছর পর চীনা সরকারের টনক নড়ে। ১৯৮৬ সালে চীনের চৌদ্দটি চিড়িয়াখানায় চল্লিশটি নিখাদ দক্ষিণ চীনা বাঘ ছিল। সরকারের সহায়তায় চীনের বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চায়না টাইগার ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাউথ আফ্রিকা ট্রাস্ট ২০০২ সালে বেইজিংয়ে এক অদ্ভুত চুক্তি করে। চুক্তির অংশ হিসেবে এই বাঘগুলোর অনেকগুলোকে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জন্ম নেওয়া বাচ্চাগুলোকে দক্ষিণ আফ্রিকার অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট প্রদেশের সংরক্ষিত এলাকায় শিকারের ট্রেনিং দেওয়া হয়। প্রশিক্ষিত বাঘগুলোকে দক্ষিণ চীনের আটটি অভয়ারণ্যে পুনঃস্থাপন করা হয়। লাওহূ উপত্যকায় এই বাঘগুলি কী করে সেটাই দেখার বিষয়।
এই উদাহরণ টানা হলো এজন্য যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশেও দুর্ভিক্ষ অবস্থা বিরাজ করছিল। এই অবস্থা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু সরকার বনভূমির দিকে হাত বাড়ায়নি।
মাউন্টফোর্টের সঙ্গে আলোচনা সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর মনে ধরেছিল। তিনি লক্ষ করলেন, সেই যুক্তফ্রন্ট আমলে গড়া হাইকোর্টের সীমানায় ঢাকা চিড়িয়াখানাটি বড় পরিসরের মিরপুরে স্থানান্তরিত হলেও এটি একেবারেই অবিন্যস্ত ও জনসাধারণের জন্য নিরাপদ না। তখনও পর্যন্ত বিশ্বের কোনো চিড়িয়াখানায় সুন্দরবনের বাঘের অস্তিত্ব ছিল না। বঙ্গবন্ধু বন বিভাগকে নির্দেশ দিলেন ঢাকা চিড়িয়াখানার জন্য বাঘ সংগ্রহের।
বিখ্যাত শিকারি পচাব্দী গাজী ১৯৭৪ সালে সুন্দরবনের হংরাজ এলাকা থেকে দুটি বাঘের বাচ্চা ধরেন। সুন্দরবনের তখনকার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আলীম সাহেব বাচ্চা দুটি বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন। বঙ্গবন্ধু তখনই বাচ্চা দুটো ঢাকা চিড়িয়াখানাকে দান করেন। একটি বাচ্চা কিছুদিনের মধ্যে মারা যায়, অন্য বাঘটি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত জীবিত থেকে ঢাকা চিড়িয়াখানার একমাত্র সুন্দরবনের প্রতিনিধিত্বকারী বাঘ হিসেবে প্রদর্শনীতে ছিল।
বঙ্গবন্ধুর স্বল্পকালীন শাসনামলে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণীর পক্ষে সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত বাংলাদেশ বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন। ভারত ছাড়া এ ধরনের আইন তখনকার বাংলাদেশের জন্য অভাবনীয় ছিল।
বন আইন
এদেশে ব্রিটিশ আমলে হাতি সংরক্ষণ আইন ১৮৭৯ (হাতিকে বোঝা টানার প্রাণী হিসেবে ব্যবহারের জন্য), পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯১২ ও বাংলার গন্ডার সংরক্ষণ আইন ১৯৩২ কেতাবে ছিল, প্রয়োগ ছিল না। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৯২৭-এ কিছু সংস্কার হলেও শিকার, কৃষিভূমি বৃদ্ধি, বিশেষ করে পাট চাষের জন্য জমি উদ্ধার পর্বে বন্যপ্রাণের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু সরকার রাষ্ট্রপতির আদেশ ২৩ বলে Bangladesh Wild Life (Preservation) Order পাশ করে। এটা ১৯৭৪ সালে সংশোধিত, বর্ধিত, আরও উপযুক্ত করে Bangladesh Wild Life (Preservation) (Amendment) Act, 1974 জারি করা হয়। এ আইন আরো সময়োপযোগী করে ২০১২ সালে সংশোধন করা হয়েছে।
এ আইনের ফলে আইনিভাবে সব ধরনের বন্যপ্রাণী বিশেষ করে বাঘ হত্যা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
আশ্চর্যের বিষয়, বঙ্গবন্ধু বন্যপ্রাণ নিয়ে ভাবনার সময় পেলেন কখন? তিনি এমন একটি সময়ে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন যখন পূর্ববাংলায় মারাত্মক নেতৃত্ব সংকট চলছিল। একে একে শেরে বাংলা ফজলুল হক (২৭ এপ্রিল ১৯৬২), হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী (৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩), খাজা নাজিমুদ্দিন (২২ অক্টোবর ১৯৬৪) মারা গেলে পূর্ব বাংলায় এমন কোনো নেতা রইলেন না যার ইমেজ দেশের বাইরেও আছে। যুক্তফ্রন্টের ধ্বংসস্তূপ থেকে আওয়ামী লীগকে টেনে এনে সামরিক শাসনের সামনে দাঁড় করানো—তাঁর সময়ের অন্যতম সাহসী ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ফলে জেল-জুলুম, মামলা-হামলা হয়ে উঠেছিল তাঁর নিত্যদিনের সহচর। হয়তো জেলে থাকাকালীন অবকাশই তাঁকে তাঁর জনগণ ও দেশের সম্পদ নিয়ে ভাবতে সাহায্য করেছে। তাঁর 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' তারই সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে।
- খসরু চৌধুরী: লেখক ও সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ