বড় অঙ্কের ভ্যাট প্রদানকারীদের অ্যাকাউন্টিং সফওয়্যারের সার্বক্ষণিক অ্যাক্সেস চায় এনবিআর
রাজস্ব সংগ্রহে স্বচ্ছতা আনতে বড় অঙ্কের ভ্যাট দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যারে সার্বক্ষণিক প্রবেশাধিকার চেয়েছে ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ (এনবিআর)।
এ লক্ষ্যে এনবিআর এর আওতাধীন লার্জ ট্যাক্সপেয়ারর্স ইউনিট অফিস (যা এলটিইউ-ভ্যাট নামে পরিচিত) ১১১ প্রতিষ্ঠানের কাছে রিড-অনলি আইডি এবং পাসওয়ার্ড চেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ভ্যাট ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
গত ৩ আগস্ট জারি করা আদেশে এক সপ্তাহের মধ্যে এই তথ্য না দিলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে।
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর হিসাবপত্রে অনিয়ম রুখতে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে লার্জ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা এমন উদ্যোগে বিস্মিত হয়েছেন। তারা মনে করছেন, এভাবে তাদের সব ধরনের ব্যবসায়িক হিসাব নিকাশের তথ্যের পাসওয়ার্ড দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর গোপনীয়তা রক্ষা করা যাবে না। এমনকি সেসব তথ্য হ্যাক হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।
দেশের ব্যবসায়ীদের অন্যতম প্রভাবশালী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এমন আদেশকে 'অপরিপক্ক' আখ্যা দিয়েছে।
"এ ধরনের আদেশের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যেতে পারে," বলে তারা।
এ বিষয়ে এলটিইউ-ভ্যাট অফিসে গত ১১ আগস্ট চিঠি পাঠিয়েছে তারা। এ কারণে বিদেশী বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
এমসিসিআই এর সভাপতি মো. সাইফুল আলম টিবিএসকে বলেন, "দরকার হলে তারা যে নির্দিষ্ট তথ্য চাইতে পারে কিন্তু আইডি ও পাসওয়ার্ড চাওয়ার কোন যুক্তি নেই।"
"এতে কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হলে দায়দায়িত্ব কে নেবে? এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আমাদের সম্পর্কে বাজে বার্তা দেবে," যোগ করেন তিনি।
ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু টিবিএসকে বলেন, "এভাবে প্রবেশাধিকার থাকলে প্রতিষ্ঠানের অনেক গোপনীয় তথ্য হ্যাক হতে পারে।"
"ভ্যাট কর্মকর্তারা যদি মনে করেন, তাহলে তারা তথ্য চাইতে পারেন বা অ্যাক্সেস নিতে পারেন। কিন্তু এভাবে প্রতিষ্ঠানের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড নিয়ে সার্বক্ষণি অ্যাক্সেস নেওয়ার মত বিষয় বিশ্বের আর কোথাও রয়েছে কিনা, আমাদের জানা নেই।"
তিনি বলেন, "আমরা তো আমাদের সব গোপন তথ্য ওপেন করে দিতে পারি না। যারা কাছ থেকে ভ্যাটের অর্ধেকের বেশি অর্থ আসে, তাদের সাথে এমন আচরণ হলে তা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।"
এ বিষয়ে সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, "আইনি ভিত্তি রয়েছে বলেই হয়তো চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এটি পরিস্কার করা উচিত।"
একইসঙ্গে করদাতাদের আস্থায় নিয়েই যে কোন পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।
২০১৯ সালে এনবিআরের দেওয়া একটি আদেশ অনুযায়ী, যেসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার ৫ কোটি টাকার বেশি, তাদের এনবিআর নির্ধারিত স্পেসিফিকেশনের সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হবে।
এনবিআর নির্ধারিত ভেন্ডরের কাছ থেকে কিংবা, কোন প্রতিষ্ঠান যদি অন্য কোন সফটওয়্যার ব্যবহার করে হিসাবপত্র সংরক্ষণ করতে চায়, তাহলে এনবিআর নির্ধারিত বাধ্যবাধকতা মিটিয়ে অন্য সফটওয়্যারের অনুমোদন নিতে পারতো তারা।
সূত্র জানায়, বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠা নএ সফটওয়্যার ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য এনবিআরকে দেয়নি। ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের ব্যবহার হওয়া কোর সফটওয়্যার এনবিআরকে দেওয়া যাবে না।
এই অফিসে ভ্যাট দেয় ১৭ টি ব্যাংক।
এনবিআরের একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অভিযোগ রয়েছে, কোন কোন প্রতিষ্ঠান একাধিক হিসাব সংরক্ষণ করে। কম বিক্রয়ের তথ্য দেখিয়ে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে।"
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি এ ধরনের তিনটি সিমেন্ট কোম্পানির হিসাব পরীক্ষা করে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে এ অফিস।
তথ্য গোপন করার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগে মামলা করার প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে।
এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের ওই আদেশে বলা হয়, এনবিআরের রিকয়ারমেন্ট এর বাইরে অন্য কোন সফটওয়্যার ব্যবহারের তথ্য পরবর্তীতে উদঘাটন হলে তা কর ফাঁকির অপচেষ্টা হিসেবে গণ্য হবে এবং পরবর্তীতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এলটিইউ-ভ্যাট অফিসে ভ্যাট প্রদানকারী অন্তত চারটি কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তারা সবাই বলেছেন, এমন উদ্যোগে তাদের ব্যবসায়িক গোপনীয় তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে দায়দায়িত্ব কে সে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। তবে তাদের কেউই নাম প্রকাশে রাজি হন নি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির শীর্ষ পর্যাযের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তাদের এ সংক্রান্ত সফটওয়্যারটি জার্মান একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির, যা এসএপি নামে পরিচিত।
এতে কেবল ভ্যাট সংক্রান্ত হিসাব থাকে না, বরং অন্যান্য ব্যবসায়িক তথ্য থাকে, যা কৌশলগতভাবে গোপন রাখতে হয়।
"এটি ওপেন করে দিলে, তা যে লিক হবে না এর নিশ্চয়তা কী?"
তিনি বলেন, "এনবিআরের কোন আইনে বলা নেই, এভাবে কোম্পানির সব ধরনের তথ্য সব সময়ের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।"
"২০১৯ সালে যে আদেশ হয়েছিলো, তাতেও হিসাবের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড দেওয়ার কথা বলা ছিলো না। এভাবে সব তথ্য ওপেন করে দিতে বলা বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক," যোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে কথা বলতে এলটিইউ-ভ্যাট এর কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি।
তবে এলটিইউ-ভ্যাট এর অপর এক সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "এটি আইনগতভাবেই চাওয়া হয়েছে। আর আমাদের যে অ্যাক্সেস থাকবে, সেটি কেবল রিড অনলি।"
তিনি বলেন, "কোম্পানিগুলো সরকারকে (ভ্যাট অফিস) বিশ্বাস না করলে কাকে করবে?"
সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআর ভ্যাট আদায় করেছে ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি, যার মধ্যে এলটিউই-ভ্যাট অফিস থেকে এসেছে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা।