রম্য: চা, ডিম আর সবজির জীবন!
জীবনটা এক কাপ চা'য়ের মতো। চা এর স্বাদ তেমনই হবে যেমন করে আপনি বানাবেন! (পুরোনো প্রবাদ)
বাঙালির জীবন আগে নাকি ছিল ভাত আর মাছ নির্ভর। মাঝখানে হয়ে গেল ভাত, ডিম আর চা নির্ভর। অভাব অথবা মূল্যবৃদ্ধি যতই মাথাচাড়া দিক বাঙালি নাকি এই তিন জিনিস খেয়ে দিব্যি বাঁচতে পারে। খুব বিলাসি ভাবনা মাথায় এলে ডিমের সাথে একটু সবজি! ব্যাস। তাই চা, ডিম আর সবজি নিয়ে খানিক আলোচনা হোক।
আগে আড্ডা কিংবা অবসরে চায়ের কাঁপে ঝড় উঠতো। এখন? চা কী আগের মতো আছে? নাকি অনেক বেশি বদলে গেছে খুব জানতে ইচ্ছে করে? তাহলে চা নিয়ে ইদানিংকার কৌতুকটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেটা আলোচনায় এসেছে সেটা তুলে ধরা যায়। চায়ের স্টলে চার বন্ধুর আড্ডা জমেছে। চা'য়ে চুমুক দিয়ে প্রথম বন্ধু হেলাল হাফিজের কবিতার অনুকরনে চা বিক্রেতাকে বললো-'গরম জলে চায়ের পাতির নষ্ট হবার কষ্ট আছে! কষ্ট চা খাবে, কষ্ট চা'?
প্রথম বন্ধুর দেখাদেখি দ্বিতীয় বন্ধু রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অনুকরণে চা'য়ে চুমুক দিয়ে গাইলো-'ভালো আছি ভালো থেকো/ চা'য়ে চিনি বেশি মেখো'! তৃতীয় বন্ধু চা'য়ে চুমুক দিয়ে গেয়ে উঠলো হাল আমলের গান-চিনি দুধ সাদা সাদা/ রঙ জমেছে সাদা কালা/ হইছি আমি চা পাগেলা/ দাম বাড়ার কালে..
চতুর্থ বন্ধু এবার ভয়ে ভয়ে চা'য়ে চুমুক দিয়ে জীবনানন্দীয় ভঙ্গিতে বললো-'কে হায় এমন চা খেয়ে কষ্ট জাগাতে ভালোবাসে'?
আসলে চা'য়ের আড্ডা বিস্বাদ মনে হতে পারে এখন। এর অনেক কারণ আছে। আজিমপুর কবরস্থানের আশে পাশের চা'য়ের দোকানে এমন কথা প্রচলিত ছিল যে এইসব দোকানের চা আসে দাফন করাতে আসা মৃতদেহের সাথে যে চা থাকে সেখান থেকে! রাশিয়ান প্রবাদে আছে-সবকিছু পেট্রোলিয়াম জাত পন্য থেকে উৎপন্ন হয়। তাই তেলের দাম বাড়লে সবকিছুর দাম বাড়ে! তবৃুও মানুষ পুরোনো আরেকটা প্রবাদ শুনে শান্তি পাবে এবং চা পান করবে। 'আপনি হয়তো টাকা দিয়ে সুখ কিনতে পারবেন না কিন্তু এক কাপ চা কিনতে পারবেন। এই চা এর তৃপ্তিই আপনাকে সুখ এনে দেবে'!
দাম বাড়ার পর চায়ের স্বাদ বা সুখ কী আগের মতো আছে? অলিগলিতে বা রাস্তার টং ঘরে পাঁচ টাকা দিয়ে যে রং চা পাওয়া যেত সেটা এখন দশ টাকা! তবুও নাকি সেই চা'য়ে পাওয়া যায় না পুরোনো পরিচিত চা-পাতির ঘ্রাণ! এক কাপ চা পান করে যদি আপনার দিন শুরু করতে হয় এবং এক কাপ চা'য়ের দাম যদি পাঁচ টাকা করে বাড়ে তাহলে এক মাসে ১৫০ টাকা খরচ বাড়লো। আচ্ছা চা না খেয়ে কী বাঁচা যায় না? অবশ্য চা এর সাথে দুধ বা চিনি মেশানোর হ্যাপা এখন অনেক।
তাতে এক কাপ চায়ের মূল্য আরও বাড়বে। চিনির দামও বেড়েছে। তাই চিনির নাম দিন সাদা বিষ বা হোয়াইট পয়জন! এটা খেলে ডায়াবেটিস রোগ হতে পারে। সাধারনত অলিগলি বা রাস্তার দোকানে যে দুধ মেশানো হয় চায়ের সাথে সেটা আসলে কনডেন্সড মিল্ক! কনডেন্সড মিল্ক আসলে ভেজিটেবল ফ্যাট। তাই চায়ের সাথে এই কনডেন্সড মিল্ক মেশানো চা পান না করে দুধ চিনি ছাড়া চা পান করতে শিখুন। এমন চা'কে কেউ কেউ বলেন র'টি। কেউ কেউ বলেন 'ডিরেক্ট লিকার'! কারো কারো ভাষায় 'লাল চা'। আচ্ছা গরম জলের সাথে চায়ের পাতি একটু কম মেশালে কেমন হয়? চা না খেলে কী মানুষ বাঁচে না?
অবশ্য চায়ের মূল্য একেক জায়গায় একেক রকম। ফুটপাতের দোকানে হয়তো এটা দশ থেকে বিশ টাকা। কোথাও কোথাও আশি থেকে একশ টাকা। ফাইভস্টার হোটেলে পাঁচশ টাকার বেশি। তাই কৌতুকও ছড়িয়ে পরে এমন: এক ইঞ্জিনিয়ার এসেছে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে চা খেতে। দোকানে বিস্কিট, চিপসের সাথে কলা ঝোলানো আছে। ইঞ্জিনিয়ার জানতে চাইলে কলার দাম কতো? দোকানি বললো কোথায় ব্যবহার করবেন তার উপর নির্ভর করে দাম।
ইঞ্জিনিয়ারের অবাক হওয়া দেখে দোকানি বললো- কোনো মিলাদ বা ধর্মীয় কাজে নিলে দুই টাকা, হাসপাতালের রোগির জন্য নিলে তিন টাকা আর নিজের জন্য নিলে পাঁচ টাকা। ইঞ্জিনিয়ার খানিকটা রেগে জানতে চাইলো-একই জিনিসের দাম তিন জায়গায় তিনরকম হবে কেন? দোকানি উত্তর দিলো-আমার বাসায় বিদ্যুতের দাম যা এই মুদি দোকানে তার চেয়ে বেশি। কমার্শিয়াল প্লেস বা অফিসে নাকি আরও বেশি। কারখানায় নাকি তারও বেশি। বিদ্যুৎের দাম যদি তিন চার জায়গায় তিন চার রকম হয় তাহলে কলার দাম তিন চার রকম হইলে দোষ কোথায়? এটা সত্যিমিথ্যা যাইহোক দোকানির কথায় যুক্তি আছে।
প্রশ্ন উঠেছে এখন গরীবের প্রোটিন খ্যাত ডিম নিয়ে! প্রিয় পাঠক আপনাদের একটা ঘটনা মনে করিয়ে দেই। ১৯৯৬ সালের অক্টোবর থেকে সারাবিশে 'ডিমদিবস' পালন শুরু হয়। পৃথিবীর ৬০টি দেশে অক্টোবরের দ্বিতীয় শুক্রবার এই দিবস পালিত হয়। ২০১৭ সালের ডিম দিবসে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল ও প্রানীসম্পদ অধিদপ্তর ফার্মগেট খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে মাত্র তিন টাকায় ডিম বিক্রির ঘোষণা দেয়। সারা ঢাকা শহর যেন এদিন ভেঙ্গে পরে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে। এক লাখ ডিমের ভেতর আশি লাখ ডিম নাকি কয়েক মিনিটেই ব্রিক্রি হয়ে যায়।
এরপর শুরু হয় হুড়োহুড়ি, পুলিশের লাঠিচার্জ এবং শেষমেষ ডিম বিক্রি বন্ধের ঘোষণা আসে। বিক্রির জন্য স্টলে রাখা কিছু ডিম ভেঙ্গে পরে, ডিম না পাওয়া মানুষ খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে ফিরে আসে। শ্লোগানের ভাষা-ডিম নিয়া ডিমাডিমি চলবে না, চলবে না।
কিন্তু ডিম নিয়ে এখনও ডিমাডিমি চলছে। এখন ডিমের হালি ৫৫ টাকা (আগস্ট ২০২২) পাঁচ বছর আগে তিন টাকায় ডিম বিক্রির ঘোষণা দেয়া হয়েছিল আর এখন একটা ডিমের দাম চৌদ্দ টাকা! ডিম না খেলে কী হয়?
ওপার বাংলার সুবোধ সরকারের একটা বিখ্যাত কবিতা আছে ডাক্তার ও ডিম নিয়ে। সুবোধ সরকার তার সন্তানের শরীর খারাপ নিয়ে দারুণ চিন্তিত ছিলেন। প্রথম ডাক্তার তাকে বলেছিল ডিম খুব সুন্দর করে ফেটিয়ে তারপর কড়া করে ভেজে ছেলেকে খাওয়াতে হবে। দ্বিতীয় ডাক্তার বলেছিলেন সেদ্ধ করে খাওয়াবার কথা। আরেক ডাক্তার বলেছিল আধা কাচা করে ভাজলেও চলবে। একজন বলেছিলেন জলের ওমে পোচ করে খেতে! বুঝুন অবস্থা! কবিতার শেষে ডাক্তারদের নিয়ে সুবোধ সরকার কতটা কড়া মন্তব্য করতে পারেন সহজেই অনুমেয়।
ছেলে হোক কিংবা মেয়ে, ডিম খাওয়াতে কেউই পিছিয়ে নেই। হাওয়ার্ড হেমলার ও সোনিয়া টমাসের নাম আছে গ্রিনেজ রেকর্ডে। হেমলার ৩০মিনিটে ৪২৭টি ডিম ভাজি করতে পেরেছিলেন আর সোনিয়া ৬ মিনিট ৪০ সেকেন্ডে ৮৫টি ডিম খেয়েছিলেন!
ডিমের সবচেয়ে ভালো দিক নাকি এই যে ডিমে কোন কার্বন বা চিনিময় উপাদান নেই। ডিম সাদা হবে নাকি লাল হবে তা নির্ভর করে মুরগীর খ্যাদ্যাভ্যাসের উপর। তবে চাইলেও আপনি কালো বা সোনালি ডিম পাবেন না। সেসব ডিম নাকি শুধু রূপকথাতেই পাওয়া যায়! ক্রিকেটেও ডিম আছে অন্যভাবে। আগে কোন ক্রিকেটার জিরো রানে আউট হলে বলা হতো ডাকস এগ মেরেছে। এখন বলা হয় ডাক মেরেছে। সবচেয়ে বেশি 'আন্ডা' রানে আউট হবার রেকর্ড নাকি শহীদ আফ্রিদী ও মুরালীধরনের। চায়ের মতো ডিমের দাম কী কমার সম্ভাবনা আছে? পাকিস্তান ও ইন্ডিয়াতে ২০২২ এর আগস্টে ডিমের দাম বাংলাদেশের চেয়ে অর্ধেক।
আর আছে সবজি! যারা মাছ মাংস খান না, যাদের বলা হচ্ছে ভেজিটেরিয়ান তারাও বিপাকে পড়েছেন। সবজিও সম্ভবত প্রেট্রোলিয়াম জাত পন্য। কারণ সেচের কাজ হয় ডিজেল দিয়ে। বীজ পরিরবহনে ডিজেল লাগে। চাষাবাদের পরে শস্য পরিবহনে ডিজেল লাগে। বাজারে আসার পরে এইসব শস্য তাই বেশি দামে কিনতেই হয়। কিন্তু ভাতের সাথে কী সবজি না হলে চলে? কয়েকভাবে চলতে পারে..
এক. ভাঙারির যেমন দোকান আছে শাক সবজিরও তেমন দোকান আছে। শাক বিক্রির পর যদি কিছু ডালপালা অবশিষ্ট থাকে তাহলে সেসব খুবই কম দামে কিনতে পারেন।
দুই. কচু শাকের মতো আম পাতা জাম পাতা কাঠালের বিচির মতো কাঠাল পাতা দিয়ে ভিন্ন ধরনের কোন রান্না আবিষ্কার করতে পারেন।
তিন. কলার মোচার মতো কলা গাছের কান্ড বা থোর আর কলার ছোলা দিয়ে নতুন ধরনের রেসিপি বানাতে পারেন। খুব সামান্য খরচ পড়বে।
চার. আলু, পটল, ঢেড়স, কুমড়া পেপে যেসব নষ্ট হবার আগে ফেলা দেয়া হয় সেসব কিনে আনুন। যতটুকু পচেছে সেটুকু ফেলে দিয়ে ভালোটুকু রান্না করে খান। তৃপ্তি পাবেন।
পাঁচ. ডিমের দাম বেড়েছে বলে ডিম চুষে চুষে খান। কামড় দেবেন না, সহসা গিলবেন না। তিনবেলা এক ডিম দিয়ে পার করুন, আগের মতো তৃপ্তি নিন।
সুতরাং দাম বাড়লেই যে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে, আপনি হতাশ হয়ে যাবেন সেটা কিন্তু ঠিক না। আপনি বরং বিকল্প পথ তৈরি করুন। সকালে একটা রুটি, অর্ধেক ভাজি আর ডিম চুষে খান। তিন গ্লাস জল খান। পেট ভরবেই ভরবে। অফিসে এসে আধা কাপ চা খেয়ে বাকিটা রেখে দিন। দুপুরে সকালের অর্ধেক ভাজি আর ডিমের অর্ধেকটা চুষে ও চিবিয়ে খান। সাথে এক প্লেট ভাত। পরে সকালের রাখা চা গরম করে খান। রাতে অর্ধেক ডিম, ডাল মেশানো জল, কম দামের সবজির লাবড়া ও বাকি অর্ধেক ডিম খান। ভালো থাকুন, সবজি খেতে না চাইলে ভেজেটেরিয়ান নামটা বদলে ফেলুন আর অনেক পুরোনো ও পরিচিত গল্প শুনে ঘুমুতে যান।
একটু হাস্যরস
এক. একবার বিমানে চড়ে বিহার থেকে দিল্লী যাচ্ছেন লালুপ্রাসাদ যাদব। বিমানবালা এসে জানতে চাইলো-স্যার আর ইউ ভেজেটেরিয়ান? লালু প্রাসাদ যাদব খানিক ভেবে বললেন-নো নো। আই অ্যাম পার্লামেন্টেরিয়ান!
দুই. এক লোক দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো-ডিমের হালি কত? দোকানি বললো পঞ্চান্ন টাকা! লোকটা ফিরে এসে তার পোষা মুরগীকে আদেশ করলো-এই ডিম দে। তাড়াতাড়ি। মুরগী বললো-ডিম দিলে যদি আমার ফিগার নষ্ট হয় তখন? লোকটা বললো আগে আমি স্লিম ফিগার পছন্দ করতাম এখন মোটাসোটা পছন্দ করি। এই দুনিয়ার সবাই জানুক আসল ধর্ম পেট! তাড়াতাড়ি ডিম দে!
কিছু কিছু জিনিসের দাম বাড়া দোষের না বরং কিছু জিনিসের দাম বাড়লে নাকি ভালো লাগে বা দেশ উপকৃত হয়! যেমন প্রতিবছর সিগারেট আর মদের দাম বাড়ে। এসবের দাম বাড়লে কেউ সমালোচনা করে না বরং কেউ কেউ বলে থাকেন সরকার আগের চেয়ে বেশি রাজস্ব পাবে। বেতন বাড়লেও ভালো লাগে সবার। কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। বাংলাদেশে একবার দাম বাড়লে আর নাকি কমে না। হ ও জল শুধু নিম্নগামী। মূল্যবৃদ্ধি সবসময় আকাশ ছোঁয়া।
শুধু সবকালে সাধারণ মানুষ বা আম জনতার দাম সবচেয়ে কম।
আহসান কবির: রম্যলেখক