পুতিনের হাইপারসনিক মিসাইল হুমকি ও পশ্চিমাদের ভয় কাটিয়ে ওঠার লড়াই
ব্রিটেনের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের যেকোনো ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরক্ষাব্যবস্থাটির নাম ফ্যালেঙ্কস সিআইডব্লিউএস (ক্লোজ-ইন ওয়েপন সিস্টেম)। এটি একটি বিশেষ কামান যা প্রতি মিনিটে ৪,৫০০ বর্মভেদী (আর্মার-পিয়ার্সিং) রাউন্ড ছুঁড়তে পারে। আগত কোনো মিসাইলকে দ্রুতগতিতে গুলি করে ধ্বংস করাই এ কামানের কাজ। অর্থাৎ সিআইডব্লিউএসকে যদি কোনোভাবে এড়ানো যায়, তাহলে এইচমএমএস কুইন এলিজাবেথ নামক এই ক্যারিয়ারটি মিসাইলের জন্য হয়ে যাবে ৬৫ হাজার টনের একটি ভাসমান টার্গেট।
সম্ভাব্য দৃশ্যপট যখন এমন, তখন সর্বশেষ আবিষ্কৃত হাইপারসনিক অস্ত্রটি নিয়ে পশ্চিমা সেনাধক্ষ্যদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়াটা আশ্চর্যের কিছু নয়।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ ও তাইওয়ান নিয়ে নতুন করে সৃষ্ট সংকটের মাঝে বিশ্ব এখন হাইপারসনিক মিসাইলের যুগে প্রবেশ করছে। এ মিসাইলের দ্রুতি এতই বেশি যে রেডারে এর অস্তিত্ব প্রকাশের প্রথম শব্দ হওয়ার অল্প কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এটি লক্ষ্যস্থলে হামলা করতে সক্ষম। অর্থাৎ রেডারে ধরা পড়ার পরও এ মিসাইলকে প্রচলিত প্রযুক্তি দিয়ে থামানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় কখনো পাওয়া যাবে না।
গত মে মাসে রাশিয়া ইউক্রেনের ওডেসায় তিনটি কিঞ্জাল মাক-১২ হাইপারসনিক মিসাইল নিক্ষেপ করেছিল। এর আগে মার্চ ও এপ্রিল মাসে এ মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছিল রাশিয়া। ওডেসার ওই হামলাই হাইপারসনিক মিসাইলের প্রথম সামরিক ব্যবহার।
এর আগে ২০২১ সালে চীন দাবি করেছিল তারা হাইপারসনিক প্রজেক্টাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে। মে মাসে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ সফলভাবে একটি জিরকন মিসাইল উৎক্ষেপণ করেছিল যা প্রায় ১০০০ মাইল পর্যন্ত দূরত্ব অতিক্রম করতে সক্ষম।
সাধারণ জাতের মিসাইলগুলো মাক ৩ গতিতে চলে। অন্যদিকে হাইপারসনিক মিসাইলগুলোর ন্যূনতম গতি মাক ৫, বা ঘণ্টায় প্রায় ৩,৮০০ মাইল। এ গতি শব্দের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি।
মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেইথিয়ন মিসাইল অ্যান্ড ডিফেন্স-এর প্রেসিডেন্ট ওয়েস ক্রেমারের মতে, হাইপারসনিক মিসাইলের এ প্রযুক্তি আকাশ থেকে আকাশে ক্ষেপণযোগ্য মিসাইল আবিষ্কারের মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাযুক্তিক বিবর্তন।
আর নিজেদের হাইপারসনিক মিসাইল সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা ও সশস্ত্র বাহিনীকে এ মিসাইল থেকে রক্ষা করা- দুটো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছে পশ্চিমা দেশগুলো।
কানেটিক নামক একটি ব্রিটিশ অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী স্টিভ ওয়াডি বলেন, 'সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ইউক্রেনে আমরা যেটা দেখেছি, তা হলো প্রথমবারের মতো হাইপারসনিক মিসাইলের কার্যকরী ব্যবহার। আর এটার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার পাল্টা প্রযুক্তি আগামী এক দশকেই পাওয়া যাবে।'
হাইপারসনিক মিসাইলের গতি একে তো খুব বেশি, তার ওপর এটি কোন পথে উড়ে যাবে (ফ্লাইটপাথ) তাও অনিশ্চিত থাকে। ফলে এটি রেডারে ট্র্যাক করা কঠিন হয়ে পড়ে।
এ ধরনের মিসাইলগুলো দুইভাবে ওড়ানো যায়। একটি পদ্ধতিতে মিসাইলটি স্ক্র্যামজেট নামক দ্রুতগতি উৎপাদন করতে পারে এমন এক ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহার করে। অন্যক্ষেত্রে মিসাইলটিকে কোনো বিমানের মাধ্যমে আকাশে তুলে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর মোটামুটি নিচে নেমে এসে অনিশ্চিত গতিপথ ধরে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়ে লক্ষ্যে আঘাত হানে মিসাইলটি।
হাইপারসনিক প্রতিরক্ষার জন্য কানেটিক কোম্পানি চেষ্টা করছে 'ড্রাগনফায়ার' নামক একধরনের লেজার অস্ত্র তৈরি করতে যা মিসাইলকে ভূপাতিত করবে।
হাইপারসনিক মিসাইলের তীব্র দ্রুতির ভালো ও খারাপ দুটো দিকই রয়েছে। গতি যত বেশি, এটি প্রতিহত করাও তত কঠিন। কিন্তু তাতে মিসাইল নিয়ন্ত্রণ করাটাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে চলমান লক্ষ্যে এ মিসাইল দিয়ে হামলা করা একধরনের চ্যালেঞ্জ।
শব্দের চেয়ে অনেক গুণ বেশি গতিতে চলার মানে এ মিসাইল প্রচুর তাপ উৎপাদন করে। আর এ তাপ মিসাইলের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ব্যবস্থাকে বাধাগ্রস্ত করে পারে। তাই মিসাইলের তাপ নিয়ন্ত্রণ করাও বেশ কসরতের বলে জানান এরোস্পেস গবেষণার প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রেনফিল্ডের হাইপারসনিক অ্যারোডায়নামিক্স বিশেষজ্ঞ সাইমন প্রিন্স।
তিনি জানান, হাইপারসনিক মিসাইল দিয়ে বড় ও ধীরগতির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা সবচেয়ে কার্যকরী। এর ফলে এ মিসাইলের কাছে অসহায় ভবন ও বিমানবাহী রণতরীগুলো।
কানেটিকের তৈরি লেজার অস্ত্র হাইপারসনিক মিসাইল প্রতিরক্ষায় কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে।
প্রিন্স জানান, 'দ্রুতি বেশি মানে প্রতিক্রিয়ার সময় কমে যাওয়া। কোনো কিছু ফায়ার করার পর তা হাইপারসনিক মিসাইলের কাছে পৌঁছাতে সময় লাগবে। কিন্তু তার বদলে যদি সুইচ টেপার মাধ্যমে কোনো একটা লেজার বিম চালু করা যায়, তাহলে তার সাফল্য হবে বেশি।'
রেইথিয়নের ক্রেমার জানিয়েছেন, হাইপারসনিক মিসাইল ধ্বংসের মোটামুটি তিনটি উপায় রয়েছে।
প্রথমত, এগুলো সরাসরি আঘাত করা সম্ভব। কিন্তু এ মিসাইলের তীব্রগতির কারণে এটি সবচেয়ে বেশি কঠিন পদ্ধতি। দ্বিতীয়ত এগুলোর আশেপাশে মিসাইলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এগুলোকে ধ্বংস করা যায়। কিন্তু এতে আরও বেশি ধ্বংসযজ্ঞের ঝুঁকি থাকে। আর সর্বশেষ উপায়টি হলো কোনো ধরনের এনার্জি ওয়েপন ব্যবহার করা। এ পদ্ধতিতে তাত্ত্বিকভাবে হাইপারসনিক মিসাইলের ইলেকট্রনিক্সে ভজকট পাকিয়ে মিসাইলকে ব্যর্থ করা যায়।
হাইপারসনিক মিসাইলের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে হলে প্রথমে বড় একটি অঞ্চলে মনিটরিং ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে এগুলোকে সহজে চিহ্নিত ও ইন্টারসেপ্ট করা যায়। এরকম প্রযুক্তি হতে পারে আকাশ থেকে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে মিসাইল চিহ্নিত করার ব্যবস্থা তৈরি করা।
ইউরোপের অগ্রিম সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় হয়তো যুক্তরাজ্যের মতো দেশ হাইপারসনিক মিসাইল প্রতিহত করতে পারবে বলে মনে করেন সাইমন প্রিন্স। 'যদি পুরো ইউরোপ একসঙ্গে এ ধরনের মিসাইল প্রতিরক্ষায় কাজ করে, তাহলে হাইপারসনিক মিসাইলকে ধ্বংস করা সম্ভব।'
কিন্তু এতে করে সমুদ্রে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজগুলো বিশেষ সুবিধা পাবে না। প্রিন্স দাবি করেন, যুক্তরাজ্য চেষ্টা করলে বাকি পরাশক্তিগুলোর মতোই হাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করতে পারবে। 'তাত্ত্বিক দিকগুলো সমাধানে আমাদের বিশেষজ্ঞ রয়েছে, কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের যথেষ্ট পরীক্ষামূলক দক্ষতা নেই,' বলেন প্রিন্স।
হাইপারসনিক প্রবাহ পরীক্ষা করার জন্য একধরনের টানেলের প্রয়োজন হয়। যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে এ ধরনের টানেল থাকলেও মিসাইল নিয়ে গবেষণার মতো বড় আকৃতির কোনো টানেল নেই।
প্রিন্স বলেন, 'কয়েক বছর আগে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় রাশিয়া ও চীন হাইপারসনিক মিসাইল প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করলেও যুক্তরাজ্য করছিল না। তাই এখন যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই এ প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়েছে।'
শীঘ্রই কোনো সাফল্য না দেখলে মাঝসমুদ্রে শত্রুপক্ষের নতুন প্রজন্মের এ মিসাইলগুলোর কাছে নখদন্তহীন বাঘই হয়ে থাকবে পশ্চিমা নৌবাহিনীর জাহাজগুলো।
সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ
অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত