সেই যে আমার জ্যাজ, পপ আর রক অ্যান্ড রোলের দিনগুলো
ঊনষাট সালের ফেব্রুয়ারির এক শীত সকালে আমেরিকার পত্রিকাগুলো কেঁদে উঠল। কারণ প্লেন ক্রাশে মারা গেছেন রক অ্যান্ড রোলের তিন নামী শিল্পী – লা বামবাখ্যাত রিচি ভ্যালেন্স, জেপি রিচার্ডসন নামের বিগ বপার এবং বাডি হলি। আর সেই দিনটিকে মনে রেখে প্রায় এক যুগ পরে ১৯৭১ সালে ডন ম্যাকলিন গেয়ে উঠলেন দ্য ডে দ্য মিউজিক ডায়েড। আমেরিকান পাই শিরোনামের গানটিতে ম্যাকলিন ঘোষণা করলেন, ঊনষাটের ওই শীতের পর আর গান বেঁচে নেই।
নয় মিনিট দীর্ঘ গানটির কথা পড়ে-শুনে-বুঝে বিশ্লেষকরা বলছেন, সংগীত দিনে দিনে সুর থেকে অসুরে চলে যাচ্ছে দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন ম্যাকলিন। তার মনে পড়ছিল পিট সিগার, জোয়ান বায়েজ, এলভিস প্রিসলির কথা। বব ডিলান না এলে যে প্রিসলির মুকুট (রূপক অর্থে) চিরতরেই হারিয়ে যেত সে কথাও জানিয়ে দিচ্ছেন। রাজনীতিও ওই সময় সংস্কৃতির টুটি চেপে ধরতে চাইছিল, তাইতো ম্যাকলিন বলতে ছাড়েননি, লেনন (বিটলসের) মার্ক্সের বই পড়ে বলে কেন গায়ে জ্বালা ধরে? আরো বললেন, এখন তো লিভাইস জিনস পড়ে শেভ্রলে চালানো ছাড়া আমাদের আর বেশি কাজ নেই, সো বাই বাই, মিস আমেরিকান পাই।
ওমর ফারুক টিপু আরো যোগ করলেন, 'গানটা যখন করলেন ম্যাকলিন সেই সত্তরের দশকটাকে দেখুন। নেশায়, অস্থিরতায়, উন্মাদনায় উদ্ভ্রান্ত আমেরিকা। যুবা সমাজ চাইছিল মুক্তি। মনটাকে রাখতে চাইছিল নিরিবিলি কোনো কোণে। ম্যাকলিন তখন বললেন, তোমার আত্মাকে গানের মধ্যে দিতে পারতে কিন্তু গানেরই যে মৃত্যু ঘটেছে। আমেরিকান পাই আমাদের মনও ভারাক্রান্ত করে দিয়েছিল। আশির দশকের মাঝামাঝিতে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে উঠেছিল ওয়েস্টার্ন মিউজিক প্রেমীদের আখড়া। তখন দিনে একবার হলেও চক্কর দিতাম ওখানকার গানপাড়ায়। রুমি শাম্মিন প্রকৌশল বিজ্ঞানের ছাত্র। আরিফ এনায়েত নাবিলের মারফত তার সঙ্গে পরিচয় হলো। আর শাম্মিনের সূত্রে সখ্য হলো কাজী জাবেদউল্লাহ সাজু, মোহামেডানের স্ট্রাইকার সাইফুল বারি টিটু এবং ইফতেখার খালিদের সঙ্গে। বিদেশ থেকে আগত চাচা, মামা, বন্ধু ও বড় ভাইরা ছিল গান প্রাপ্তির উৎস তখন। তারা গানপাগল ভাই-ভাতিজাদের কথা ভেবেই দু-চারটা মিউজিক অ্যালবাম নিয়ে আসতেন। কখনো কখনো রোলিং স্টোন, বিলবোর্ড বা কিউ নামের মিউজিক ম্যাগাজিন আনতেন। তাই বন্ধুর দল বড় হলে গানের সংগ্রহও বাড়ত। আরো ছিল রেইনবো, এলিফ্যান্ট রোডের জনপ্রিয় মিউজিক রেকর্ডিং প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুরাদ ভাই তবে পরিচালনা করতেন কবীর ভাই। রেইনবোর কাছে রিদম নামে আরেকটি দোকান ছিলেন।
একদিন রিদমে গিয়েছিলাম একটা ক্যাসেট রেকর্ড করাতে কিন্তু যিনি দোকান সামলাচ্ছিলেন, স্বত্বাধিকারীও তিনি, কোনোভাবেই রেকর্ডারকে বাগে আনতে পারছিলেন না, আমি বললাম, একটু কি ট্রাই করে দেখব? তিনি সম্মতি দেওয়ার পর আমি রেকর্ড করতে গিয়ে সফল হলাম। তারপর আমাকে তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমি ভাবলাম, এ তো মেঘ না চাইতেই জল। গান শোনাই আমার প্রাণের চাওয়া, রিদমে তো সেটা পূরণ হবেই, উপরন্তু গানের গুদাম খুলে যাবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম।'
ওমর ফারুক টিপুর বয়স ষাটের আশপাশে। দাদার আমল থেকে ঢাকার ওয়ারিতে বসতি। জগন্নাথ কলেজে (এখন বিশ্ববিদ্যালয়) কমার্স নিয়ে পড়েছেন। গান শোনা, স্কেল মডেল কার ও বিমান সংগ্রহের নেশা তার।
দাদার আমল
টিপুর দাদা আব্দুর রশীদ যুক্তরাজ্যের লিডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট হয়েছিলেন। শিক্ষা বিভাগের জেলা পরিদর্শক ছিলেন। '৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হন। তখন অ্যাসেম্বলি হল ছিল ১৯৮৫ সালে ভেঙে পড়া এখনকার জগন্নাথ হলের হলরুমটি। গানপ্রেমী ছিলেন দাদা। হারমোনিয়াম বাজাতে জানতেন আর সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজও জানতেন ভালো। টিপুর বাবা আব্দুল খালেকও নিজের জামা নিজেই তৈরি করে নিতেন। চীনাদের দোকানে গিয়ে জুতার নকশাও করে দিয়ে আসতেন। ষাটের দশকেও ঢাকার জুতার বাজার চীনাদের দখলে ছিল অনেকটা। তিনি এলভিস প্রিসলির ভক্ত ছিলেন। বাড়িতে গ্রামোফোন রেকর্ড ছিল এলভিসের। টিপুর বড় ভাইয়ের নাম ছিল মারুফ হোসেন খোকন। ১২ বছরের বড় ছিলেন তিনি। একাত্তর সালের ম্যাট্রিক ক্যান্ডিডেট ছিলেন। তিনি বিটলস, ডিন মার্টিন, বাডি হলি, বব ডিলান, বিচ বয়েজ, লেড জ্যাপেলিন, কার্টার ফ্যামিলি, জনি ক্যাশ, রজার মিলারের গান শুনতেন। ষাটের দশকে বায়তুল মোকাররমের দোতলায় ব্রিটিশ মিউজিক কোম্পানী ইএমআইয়ের (ইলেকট্রিক অ্যান্ড মিউজিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ) এজেন্ট ছিল। মারুফ সেখান থেকে ৪৫ আরপিএম (রেভুলেশন পার মিনিট, মিনিটে ৪৫ বার ঘোরে) এর ডিস্ক কিনতেন। দুই পিঠে দুইটি বা চারটি গান থাকত। দাম নিত আড়াই টাকা। শেষ ষাটে টিপুর বয়স ছিল ৬ কি ৭। তখন ডিস্কে হাত দেওয়ারও অনুমতি ছিল না। তবে ভাইয়ার ঘর থেকে গানের সুর ভেসে এলে কান খাড়া হয়ে যেত আপনা আপনি। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার মেয়ে ন্যান্সি সিনাত্রা ও লি হ্যাজেলউডের গাওয়া সামারওয়াইন গানটি শুনেছিলেন তেমনভাবেই।
ফুপুর বাড়িটা ছিল গানরাজ্য
টিপুর ফুপু জোবাইদা খাতুন ছিলেন ইডেন কলেজে ইংরেজী বিভাগের প্রধান আর ফুপা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাদের বড় ছেলে শামসুর রহমান কলকাতা গেলেই রেকর্ড নিয়ে আসতেন। ফুপুর বাড়িতে বলতে গেলে সারাদিনই গান বাজত। ওদের গ্রামোফোন রেকর্ডের বড় ভান্ডার ছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রেকর্ডগুলো চিলেকোঠায় স্তুপ করে রাখা হয়েছিল, চিলেকোঠার ছাদ ছিল টিনের, সব গলে গিয়েছিল। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে গ্রামোফোন ডিস্কের আদর কমতে থাকে, জায়গা নিতে থাকে ক্যাসেট টেপ। ফুপুর বাড়িতে ক্যাসেট প্লেয়ার ও রেকর্ডার ছিল। ফুপাতো ভাইদের প্রবাসী কাজিনরা দেশে ফেরার সময় গানের ক্যাসেট নিয়ে আসত। রবিবার ছিল তখন ছুটির দিন। ওয়ারি থেকে সাইকেল চালিয়ে ধানমন্ডিতে চলে যেত টিপু, গান শুনে ছুটির দিনটা পার করত।
তারপর একাশি সালে বড় ফুপাতো ভাই ফজলুর রহমান জলযান হিজবুল বাহারে করে গেলেন মালয়েশিয়ার পেনাং। ১৯৫৩ সালে ফ্রান্সে তৈরি ৫৩১ ফুট দীর্ঘ ওই জলযান কেনা হয়েছিল হজ্বযাত্রা সহজ করার জন্য। পেনাং থেকে ফেরার সময় ফজলুর রহমান জাপানি স্যানসুই কোম্পানীর হাই-ফাই (হাই ফিডেলিটি) অডিও ক্যাসেট প্লেয়ার, রেকর্ডার, স্পিকার সব নিয়ে এসেছিলেন। তাতে টিপুদের গান শোনার সুযোগ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। তখন কারোর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলেন টিপু, ফার্মগেটে এক কাপড়ের দোকানে ওয়েস্টার্ন মিউজিকের ক্যাসেট বিক্রি হয়। গ্রিন সুপার মার্কেটে গেলেন টিপু। দোতলায় তখন ছিল ডাক্তারদের চেম্বার। নীচতলায় আলাউদ্দিন সুইটমিটের একটি শোরুম ছিল আর একপাশে ওই কাপড়ের দোকান। নাম দেখলেন, ক্যাটস আই। সেখানে সামনের দিকে জামা কাপড় সাজানো ছিল আর ভিতরদিকে ছিল মিউজিক স্টোর। এর স্বত্বাধিকারী সাঈদ সিদ্দিকী রুমি এবং আশরাফুন সিদ্দিকী ডোরা। রুমির গানের সংগ্রহ ছিল উল্লেখ করার মতো, তিনি শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদের বন্ধু আর ডোরা ফেরদৌস ওয়াহিদের বোন। টিপু প্রথমবার সেখান থেকে কী সংগ্রহ করেছিলেন, এখন আর মনে নেই তবে মাঝেমধ্যে সেখানে যেতেন।
বেহালা বেঁধে দিল গ্রন্থি
সেসময়ে আরেকটি ঘটনা টিপুর মনে থাকবে আজীবন। একদিন ফুপুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিলেন শংকরের দিকে। হঠাৎ একটা সুর তার গতি রোধ করল। তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ শুনলেন আর খেয়াল করলেন কোন বাড়ি থেকে ভেসে আসছে। পরের দিন ৯০ মিনিটের একটা সনি ক্যাসেট কিনে তিনি ওই বাড়িটার দ্বিতীয় তলার দরজায় টোকা দিলেন। এক ভদ্রলোক দরজা খুলে জানতে চাইলেন, কি চাই? টিপু এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন, 'গতকাল এতটার সময় এখানে একটি মিউজিক বাজানো হচ্ছিল, আমি একটি ক্যাসেট নিয়ে এসেছি, আপনি যদি একটু রেকর্ড করে দেন অথবা আমাকে যদি ক্যাসেটটা দেন তবে ফুপুর বাসা ওই ৮ নম্বর রোডে, আমি সেখান থেকেও রেকর্ড করিয়ে আনতে পারি।'
সব শুনে ভদ্রলোক বললেন, 'ধুর এভাবে হয় নাকি! প্লিজ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি।' টিপু কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলেন। পরের তিন মাস সপ্তাহে দুই দিন করে পকেটে ক্যাসেট নিয়ে ওই বাড়ির নীচতলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। ভদ্রলোক হয়তো ব্যাপারটি খেয়াল করে থাকবেন। একদিন ডেকে নিলেন দোতলায়, একটি ক্যাসেট যার প্রচ্ছদে দুটি ভায়োলিন মুখোমুখি, শিরোনাম কনভারসেশন, বাজিয়ে শোনালেন টিপুকে। টিপু বলল, 'হ্যা এটাই আমি শুনেছিলাম সেদিন।' ভারতীয় এল সুব্রামনিয়াম আর ফরাসী স্টিফেন গ্রাপেলির ভায়োলিন কনসার্টের ক্যাসেট ছিল সেটি। ভদ্রলোক টিপুর ক্যাসেটে পুরোটাই রেকর্ড করিয়ে দিয়েছিলেন। আর তারপর থেকে দুজনের দারুণ সখ্য তৈরি হয়েছিল। প্রায়ই সংগীত বিনিময় করতে তারা। টিপুর দুঃখ, তিনি ভদ্রলোকের নাম ভুলে গেছেন।
বিটিভি ও বেতারের দুটি অনুষ্ঠান
আশির দশকে বিটিভিতে সপ্তাহে একদিন একটি পশ্চিমা গানের অনুষ্ঠান হতো, নাম সলিড গোল্ড। অনুষ্ঠানটি নির্মিত হতো মার্কিন মুল্লুকে, সেখান থেকে এনে প্রচার করত বিটিভি। অনুষ্ঠানটি প্রচার হওয়ার দিন টিপু খাতা-কলম নিয়ে বসতেন, গানের কথা ও শিল্পীর নাম লিখে রাখতেন। চার ভাইয়ের গড়া অস্ট্রেলীয় সংগীত দল বিজিসের অ্যান্ডি গিবও উপস্থাপন করেছেন অনুষ্ঠানটি। বাংলাদেশ বেতারে দুটি অনুষ্ঠান হতো প্রতিদিন। রাতে আধঘণ্টা হতো মিউজিক অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড আর দিনে পৌনে এক ঘণ্টা হতো ওয়ার্ল্ড মিউজিক। নোয়েল মামুন, মুনমুন রহমান, খালিদ রেজা প্রমুখ অনুষ্ঠানগুলো উপস্থাপন করতেন। টিপু ভাই প্রথম নিজের একটি প্লেয়ার পেয়েছিলেন ফুপাতো ভাইয়ের স্ত্রীর কাছ থেকে। তারা আমেরিকায় যাবেন বলে টোফেল পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
ক্যাসেটে তখন টিউটোরিয়াল পাওয়া যেত। যখন পরীক্ষায় পাশ করে তারা সব কিছু গুছিয়ে আনলেন তখন প্লেয়ারটি দিয়ে দিলেন টিপুকে। প্লেয়ারটি চলত আমেরিকান স্টাইল ১১০ ভোল্টে অথচ বাংলাদেশ চলে ২২০ ভোল্টে। টিপু তাই গেলেন ধোলাইখালে। অনেক খুঁজে পেতে একটি স্টেপডাউন যোগাড় করলেন যা দিয়ে ভোল্টেজ কনভার্ট করা যায় আর তাতে ফল পেলেন এবং নিজের মতো করে আরামে গান শুনতে থাকলেন। টিপু শুনতেন এরিক ক্ল্যাপটন, বি বি কিং, ইনগ্রাম ওয়াশিংটন, লেনার্ড কোহেন, ম্যারিলিয়ন, উইশবোন অ্যাশ, ঈগলস, ডন হ্যানলি, জর্জ হ্যারিসন, হট চকোলেট, বব ডিলান, লেড জ্যাপেলিন, পিংক ফ্লয়েড ইত্যাদি। টিপু বলছিলেন,' হার্ডরক বেশি শুনিনি আমি। মেলডি আমার পছন্দ। বলতে পারেন আমি হলাম জ্যাজ, রক অ্যান্ড রোল, পপ আর ব্লজের লোক।'
রিদমের আমল
সাতাশি সালে রিদমে যোগ দেন ওমর ফারুক টিপু। গানের বিরাট ভুবন একে একে ধরা দিতে থাকল। সংগীত সাময়িকী রোলিং স্টোন, কিউ ইত্যাদিও পেতে থাকলেন বেশি বেশি। ওয়ার্ল্ড মিউজিকের উপস্থাপকেরাও আসত গান রেকর্ড করাতে। একবার যদি কিছু মনে না করেন এর উপস্থাপক ফজলে লোহানীর এক সহকারী এসে তাড়া দিয়ে বলছিলেন, এই ক্যাসেটটা কি আজকেই রেকর্ড করে দিতে পারবেন? তার হাবভাব টিপুর পছন্দ হয়নি। তাই উত্তর দিয়েছিলেন, রেকর্ড করতে পারব তবে এক সপ্তাহ সময় দিতে হবে। সহকারী খুব বিরক্ত হয়ে চলে যাওয়ার সময় বলেছিলেন, 'আপনি মনে হয় টিভি দেখেন না, তাই আমাকে চিনতে পারলেন না, চিনলে এ কথা বলতেন না।'
টিপু তাকে ঠিকই চিনেছিলেন কিন্তু তার অস্থিরতা দেখে বিরক্ত হয়েছিলেন। তখন কেউ বিদেশে গেলে আগে থেকে বলতেন, কিছু লাগলে বলো টিপু। অরিজিনাল রেকর্ড ছাড়া শুনতেন না টিপু কারণ তিনি মনে করেন, সব দিয়ে থুয়ে হয়তো শিল্পী প্রতি রেকর্ড থেকে এক দেড় ডলার পায়, সেটা তাকে না দিয়ে গান শোনা অন্যায়। তাই কেউ বিদেশে গেলে রেকর্ডের তালিকা তৈরি করে টাকাও দিয়ে দিতেন। টিপু টানা তিন-চার ঘণ্টা চোখ বুজে গান শুনে কাটিয়ে দিতে পারেন। রুমি, টিটু, সাজু, ইফতেখার মিলে তাদের পাঁচজনের যে দল তৈরি হয়েছিল তারা গান নিয়ে গল্প করে রাত পার করে ফেলতেন। একপর্যায়ে বন্ধুদের বন্ধু শাহেদ সিনহা, নিলক, সোহেল, শিশির, সামি রহমান, সামি রাজ্জাকের সঙ্গেও সখ্য গড়ে ওঠে। রুমিদের বাড়িতে তাদের আলাদা টুথব্রাশ, গামছা ছিল। সে বাড়ির চিলেকোঠায় তারা অনেক সময় পার করেছেন। একবার নব্বই সালে এরশাদ শাহী রাতে কারফিউ জারি করেছিল, রিদমে বসে বসে গান রেকর্ড করছিল টিপু, জানতও না ঢাকা খালি হয়ে গেছে, রুমি কোত্থেকে এসে মেইন সুইচ অফ করে দিল। টিপু তো অবাক, দেখে রুমি বলল, আমি বুঝতে পেরেছিলাম শহরের অবস্থা আপনার জানা নেই, তাড়াতাড়ি চলেন, রিকশা দাঁড়ানো। এ গলি সে গলি হয়ে রিকশা গিয়ে থেমেছিল রুমিদের কলাবাগানের বাড়িতে।
টিপু বলেন, 'গান আমাকে এতো ভালো ভালো বন্ধু দিয়েছে যে বলার নয়। একজন যেমন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের ব্যাচমেট। পাকিস্তান আমলে তারা একসঙ্গে সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সপ্তাহে দু'তিনবার আমরা গান নিয়ে গল্প করি। তিনি অবশ্য ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যালের (চাইকোভস্কি, বিটোভেন, মোৎসার্ট) ভক্ত, তবু আমাদের গল্প চালিয়ে যেতে অসুবিধা হয় না।'
সিডি নিল ক্যাসেটের জায়গা
নব্বইয়ের মাঝামাঝি থেকে কমপ্যাক্ট ডিস্কের (সিডি) রাজত্ব বিস্তৃত হলো বহুগুণে। লং প্লে তো যাই যাই করছিল, এবার ক্যাসেটও সে তালিকায় নাম ওঠাতে প্রস্তুত হলো। টিপু যেহেতু অরিজিনাল রেকর্ড ছাড়া শোনেন না তাই ক্যাসেটের আমলের মতোই সিডি আমলেও গান সংগ্রহে ধরাধরি করতে থাকলেন বিদেশযাত্রীদের। এছাড়া যারা প্রবাসে থাকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন ভালোভাবে।
গোড়ার দিকে একটা অরিজিনাল সিডি সংগ্রহে খরচ পড়ত সাড়ে ৩ থেকে চার হাজার টাকা। টিপুর ওয়ারির বাসায় এখনো আটটি বাক্স সিডিতে ভর্তি। অনুমতি নিয়ে কয়েকটির ঢাকনা খুলে ফেললাম। ভিতর থেকে বের করে অ্যালবামগুলো একটা একটা করে দেখতে থাকলাম। প্রথমে দেখলাম ডিপ পার্পলের মেশিন হেড। স্মোক অন দ্য ওয়াটার, স্পেস ট্রাকিং, পিকচার্স অব হোম, হাইওয়ে স্টার, লেজিসহ এতে সাতটি গান রয়েছে।
প্রায় ৩৮ মিনিটের অ্যালবামটি মুক্তি দেওয়া হয়েছিল ১৯৭২ সালে। রোলিং স্টোনস মোবাইল স্টুডিও ভাড়া করে সুইস আলপসের গা ঘেঁষা গ্রান্ড হোটেলে এর রেকর্ডিং হয়েছিল। অ্যালবামের শুরুর গান হাইওয়ে স্টার লেখা হয়েছিল ব্যান্ডটির ইউকে ট্যুরের সময় একাত্তর সালের ১৩ সেপ্টেম্বর। ট্যুর ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী যে কোচে করে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল তাতে কয়েকজন সাংবাদিকও ছিলেন। তাদের একজন ব্ল্যাকমোরকে (রিচি ব্ল্যাকমোর, গিটারিস্ট এবং সংগীত লেখক, ডিপ পার্পল প্রতিষ্ঠাতাদের একজন) জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিভাবে গান লেখেন? রিচি উত্তরে গিটারটা হাতে তুলে নিয়ে গাইতে থাকলেন, নোবডি গনা টেক মাই কার, আই অ্যাম এ হাইওয়ে স্টার…।
পরের অ্যালবামটিও ডিপ পার্পলের, নাম নাউ হোয়াট? ২০১৩ সালের এপ্রিলে এটি মুক্তি পেয়েছিল। এটি ছিল ডিপ পার্পলের ১৯তম স্টুডিও অ্যালবাম। মুক্তি পাওয়ার পর প্রথম সপ্তাহেই এর ৪০০০ কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল আমেরিকায়। ছয় মাস পরে এটি জার্মানী থেকে গোল্ড সার্টিফিকেট পায় কারণ এক লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। দুটি এডিশন বেড়িয়েছিল এর স্ট্যান্ডার্ড ও ডিলাক্স। ডিলাক্স এডিশনটিই সংগ্রহ করেছিলেন টিপু কারণ এতে বোনাস ট্র্যাক মিলিয়ে গান সংখ্যা ১২টি। সিডির সঙ্গে আয়ান গিলানের (ডিপ পার্পলের লিড সিঙ্গার ও সংগীত রচয়িতা) লেখা ভূমিকা এবং ব্যাকস্টেজ ফটোসহ একটি ৮ পাতার বুকলেট রয়েছে। ডিপ পার্পল অ্যান্ড ফ্রেন্ডসের পার্পল অ্যান্ড আদার কালারসহ ডিপ পার্পলের এক ডজন অ্যালবাম আছে টিপুর কাছে। পরের অ্যালবামটির নাম হোলি ডিও: এ ট্রিবিউট টু রনি জেমস ডিও। রেইনবো, ব্ল্যাক সাবাথের এবং নিজের দল ডিওর সঙ্গে গাওয়া ১৪টি গান নিয়ে ডিওর এ অ্যালবাম। এর গানগুলো হলো দ্য লাস্ট ইন লাইন, লং লিভ রক এন রোল, চিল্ড্রেন অব দ্য সি, কিল দ্য কিং, হেভেন অ্যান্ড হেল ইত্যাদি। হেভিমেটাল ঘরানার ৭৫ মিনিটের অ্যালবামটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। উল্লেখ্য আমেরিকান শিল্পী ডিওর জন্ম ১৯৪২ সালে। মেটাল গুরু, বেস্ট মেটাল সিঙ্গার ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। ফোরফিঙ্গার এবং লিটল ফিঙ্গার উচিয়ে ডেভিল হর্নস দেখানোর রীতি তিনিই জনপ্রিয় করেছেন। সেক্রেড হার্ট এবং ডিও ম্যাজিকা নামের অ্যালবাম দুটির ডিলাক্স এডিশনও আছে এই বাক্সে। ২০১০ সালে মারা গেছেন ডিও।
গ্রোভার ওয়াশিংটন জুনিয়রের (১৯৪৩-১৯৯৯) দি বেস্ট অব অ্যালবামটি পেলাম এরপর। ওয়াশিংটন ছিলেন স্যাক্সোফনিস্ট। সত্তর ও আশির দশকে তার বাজানো মাস্টার ম্যাজিক, ব্ল্যাক ফরেস্ট, ইনার সিটি ব্লুজ এবং লেট ইট ফ্লো মিউজিক পিসগুলো আলোড়ন তুলেছিল সারা বিশ্বেই। ঈগলসের ভোকাল এবং ড্রামার ডন হেনলির স্টুডিও অ্যালবাম আই ক্যান্ট স্ট্যান্ড স্টিল দেখলাম এরপর। ১৯৮২ সালে অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়। বিলবোর্ড ২০০ এর মধ্যে ২৪ নম্বরে জায়গা করে নেয় অ্যালবামটি। ৪২ মি. দীর্ঘ এ রেকর্ডে গান আছে ১১টি যার মধ্যে ডার্টি লন্ড্রি এবং জনি কান্ট রিড বিপুল শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল। এরপর টিনের বাক্সে আয়রন মেইডেনের একটি অ্যালবাম দেখলাম, নাম ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার। টিপু বলছিলেন, 'এটা ছিল স্পেশাল এডিশন, সীমিত সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়েছিল। সিডিগুলো সাধারণত প্লাস্টিক বা জুয়েল কেসে থাকে, কিন্তু এটা টিনের কেসে করা হয়েছে, কালেক্টরস এডিশন এগুলো।
হঠাৎই জানতে চাইলাম, অ্যালবামগুলোর প্রচ্ছদ এতো অন্যরকম হয় কেন? ভয়ংকরও বলা যায় মানে খুব হল্লাচিল্লা দেখি।
টিপু: সাইকাডেলিক, হার্ডরক বা এসিড রক ব্যান্ডগুলোকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী বলে অনেকে। মানে এরা ভাঙার দল। এদের অ্যালবামের প্রচ্ছদে তার প্রকাশ থাকে। অ্যালান পারসনস প্রজেক্ট বলে একটা ব্রিটিশ রক ব্যান্ড ছিল। দলনেতা অ্যালান পারসন লুসিফারের ভক্ত যদিও, গান খুব শ্রুতিমধুর। পারসনের খ্যাতি ছিল সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসাবেও। তিনি পিংক ফ্লয়েডের ডার্ক সাইড অব দ্য মুন এবং বিটলসের অ্যাবি রোডের মতো অ্যালবামের রেকর্ডিস্ট। অ্যালান পারসন প্রজেক্টের পিরামিড, আই রোবট, ইভ, ভালচার কালচার নামকরা অ্যালবাম।
পরের অ্যালবামটি ব্লু'জ ঘরানার, নাম দ্য বেস্ট অব বাডি গাই। জর্জ বাডি গাই (জন্ম ১৯৩৬) একজন আমেরিকান গিটারিস্ট এবং গায়ক। এরিক ক্ল্যাপটন, জিমি হেন্ড্রিক্স, জন মেয়ারের মতো গিটারিস্টদের তিনি প্রভাবিত করেছেন। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় দ্য বেস্ট অব বাডি গাই। ৬৫ মিনিট দীর্ঘ অ্যালবামটিতে ১৪টি ট্র্যাক আছে যেগুলোর নাম এমন- ফাইভ লং ইয়ারস, রিমেম্বারিং স্টিভি, সি ইজ এ সুপারস্টার, আ স্মেল ট্রাবল ইত্যাদি। তারপর কান্ট্রি মিউজিকের শিল্পী এলান টেইলারের অ্যালবাম আর তারপরেই আছে এয়ার সাপ্লাইয়ের অ্যালবাম।
টিপু অ্যালবাম ক্যাটালগিং করেছেন বর্ণানুক্রমে। যেমন 'এ' দিয়ে যেসব শিল্পী বা সংগীত দলের নাম তাদের অ্যালবাম আছে পরপর। তারপর থাকছে 'বি' দিয়ে যাদের নাম তাদের অ্যালবাম। ফিশ নামের এক শিল্পীর অ্যালবাম পেয়ে অবাক হলাম। টিপু বললেন, এ শিল্পীর আসল নাম ডেরেক উইলিয়াম ডিক (জন্ম: ১৯৫৮)। তিনি বিশ্রাম নেন বাথটাবে, কখনো কখনো দুই-তিন ঘণ্টা টানা। তাই তার নাম হয়েছে ফিশ। প্রোগ্রেসিভ রক ব্যান্ড ম্যারিলিয়নের তিনি লিড সিঙ্গার ছিলেন। তার প্রথম একক অ্যালবাম বের হয়েছে ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে। তার নিজের গড়া দলের নামও ফিশ। সমুদ্রবিজ্ঞানে তার আগ্রহ ব্যাপক।
গান প্রথম, গানই শেষ
ভাত না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু গান না শুনে থাকতে পারে না টিপু- বন্ধুরা এমনই ভাবেন। গান হলো টিপুর অক্সিজেন। কাব্য করে অনেকে বলেন, গানই টিপুর প্রাণ। গান ছাড়া তার চলে না। তবে খুব বেশি বাজনা আর চিৎকারের গান তার ভালো লাগে না। সুরেলা সংগীত তাকে টানে। ভাবেন, সুরে সুরে যদি ভরে যেত পৃথিবীটা, কতই না ভালো হতো।