বাংলাদেশের কৃষকদের সেচ পাম্প যেভাবে তাদের অজান্তেই ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চয় রিচার্জ করে চলেছে!
অনাকাঙ্ক্ষিত পানির ধারা ও বন্যা প্রতিরোধের জন্য সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপটির কথা মাথায় আসে তা হলো বাঁধ নির্মাণ। আর বাঁধ নির্মাণ করতে হলে সাধারণত এমন ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য- পর্বত ও উপত্যকা থাকা দরকার, যাতে জলাধারে পানি সংরক্ষণও করা যায়।
কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই সমতল প্লাবনভূমি এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র কয়েক ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় এখানে বাঁধ নির্মাণের ধারণা ততটা কার্যকর হয়ে ওঠে না।
তবে বাঁধের পরিবর্তে, বাংলাদেশের শুষ্ক ও আর্দ্র মৌসুমি জলবায়ুর সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের লাখো কৃষক নিজেদের অজান্তেই একটি বন্যা প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছেন। আর তা হলো জমিতে সেচ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত পানির পাম্প।
শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা পাম্পের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে ব্যবহার করায় ভূগর্ভে যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়, বর্ষাকালে বন্যার পানি সেখানে জায়গা করে নেয় বলে জানিয়েছেন হাইড্রোজিওলজিস্টরা।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর 'সায়েন্স' জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বাংলাদেশি কৃষকদের ব্যবহৃত এ প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেন গবেষকরা।
গবেষণার লেখকদের একজন, ইউনিভার্সিটি কলেজ অভ লন্ডনের জিওসায়েন্টিস্ট মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা বলেন, 'কেউ আসলে ভাবতেই পারেনি যে এমনটা হবে, কারণ কৃষকরা যখন পাম্প ব্যবহার করে পানি ওঠাতে শুরু করে তখন তাদের এ বিষয়ে জ্ঞান ছিল না।'
বাংলাদেশ হলো পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ, যেখানে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এদেশের মাটি এতটাই উর্বর যে তা দেশের ১৬ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে অবদান রাখতে সক্ষম।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের জলবায়ুও বর্ষাকালকে ঘিরে আবর্তিত হয়। বর্ষা ঋতুতে যে বৃষ্টি হয় তা দেশের মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় তো বটেই, দেশের কৃষিকাজের জন্যও এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একই সাথে, ভারী বৃষ্টিপাত বাংলাদেশে প্রলয়ংকরী বন্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা এ বছরের জুনেই দেশের উত্তরাঞ্চলে দেখা গেছে।
কিন্তু তবুও উষ্ণ জলবায়ুর কারণে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের ফসল, বিশেষ করে ধান উৎপাদনের জন্য উপযোগী। তাই শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভ থেকে পানি উঠিয়ে জমিতে সেচ দিয়ে থাকেন।
নব্বইয়ের দশকে যখন বাংলাদেশ সরকার বিদেশ থেকে ডিজেলচালিত পাম্প আমদানিবিষয়ক নীতিমালা শিথিল করে, সে সময় হাতেগোনা কিছু কৃষক পাম্পের মাধ্যমে জমিতে সেচ দিতেন।
কিন্তু নতুন এ গবেষণার লেখকেরা বুঝতে চেয়েছিলেন, পাম্প ব্যবহার করে পানি ওঠানোর ফলে মাটির নিচে পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে কি না। কারণ সেটা খুব ভালো কিছু নয়...এতে পানির সরবরাহ কমে যায় এবং মাটি দেবে যায়। এজন্য সারা বাংলাদেশে সেচ ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের কাজে নিয়োজিত ৪৬৫টি সরকারি স্টেশন থেকে ডেটা সংগ্রহ করেছিলেন গবেষকরা।
কিন্তু দেখা গেছে, দেশের অনেক অঞ্চলেই সেচের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি কমছে না। আর সেজন্য বাংলাদেশের অসংখ্য নদী-নালাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়।
গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র সুদূর হিমালয় থেকে পলিমাটি বহন করে আনে। সেই পলিমাটি জমা হয় নদীর তলদেশে। এসব পলিমাটিই বাংলাদেশের জমিগুলোকে উর্বর করে তুলতে সাহায্য করে।
এর পাশাপাশি পলিমাটি জমা হওয়ার ফলে মাটিতে অগণিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্র তৈরি হয়। যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখন বৃষ্টির পানি সমুদ্রে চলে যাওয়া বা বন্যার পানি বৃদ্ধি করার পরিবর্তে মাটিই অনেকটা পানি শুষে নেয়, যা পরে কৃষকেরা ব্যবহার করতে পারেন।
বাঁধের মধ্যে পানি সংরক্ষণ ব্যবস্থা যেমন অনেকটা বালতির মতো, সেখানে বাংলাদেশের মাটি অনেকটা স্পঞ্জের মতো। শুষ্ক মৌসুমে কৃষকেরা সেই 'স্পঞ্জ', অর্থাৎ মাটির নিচ থেকেই পানি বের করে আনেন। ফলে ভূগর্ভে আরও জায়গা তৈরি হয় এবং বর্ষাকালে মাটি আরও পানি শুষে নিতে পারে। অর্থাৎ, এটি নিজে থেকেই একটি টেকসই চক্র রূপে দাঁড়িয়ে গেছে। গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন 'বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন'।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের হাইড্রোজিওলজিস্ট ও গবেষণার আরেক লেখক রিচার্ড টেইলর বলেন, 'বেঙ্গল ওয়াটার মেশিনের এই উপযোগিতার বিষয়টি আমাদের গবেষণার সময় অল্প কয়েকজন হাইড্রোজিওলজিস্ট অনুমান করেছিলেন, কিন্তু আমাদের গবেষণা প্রকাশের আগে এটা অজানাই ছিল।'
গবেষণার আরেকজন লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোজিওলজিস্ট কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'যদি পাম্পিংয়ের কাজ না চলত, তাহলে এসবের কিছুই ঘটত না।'
তিনি জানান, বাঁধের পরিবর্তে মাটির নিচেই পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থার কিছু সুবিধা রয়েছে। এই ব্যবস্থার ফলে ভূপৃষ্ঠের তরল অপ্রয়োজনীয় বাষ্পে পরিণত হবার ঝুঁকি কম থাকে। এটি এ অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে বদলে দেবে না ঠিকই, কিন্তু কৃষকরা সেচের লাইনের মাধ্যমে আনা পানির চাইতে বরং নিজ জমি থেকেই পানি তুলতে পারবেন।
কিন্তু বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন সম্পর্কে যে সংশয়মূলক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো: জলবায়ু পরিবর্তন বদ্বীপকে নতুন আকার দিলে তখন কী হবে? তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ক্রমশ উষ্ণতর হতে থাকা জলবায়ু বর্ষাকালকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে এবং এতে বৃষ্টিপাতের স্থান পরিবর্তন হতে পারে। শামসুদ্দোহার ভাষ্যে, 'এ বিষয়টির দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।'
এছাড়াও বেঙ্গল ওয়াটার মেশিনকে আরও কিছু তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। ২০১৯ সালে অতিরিক্ত পাম্পিং প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকার কৃষকদের পাম্প বসানোর ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ পুনঃপ্রবর্তন করে, যার ফলে মাটির নিচ থেকে পানি তোলার সুযোগ কমে এসেছে।
উপরন্তু, অনেক কৃষক অপরিচ্ছন্ন ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার করে। (যদিও সরকার এখন কৃষকদের সৌরবিদ্যুতে চালিত পাম্প ব্যবহার করতে উৎসাহিত করছে)।
সেই সাথে বাংলাদেশের এসব পাম্পিং মেশিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চাইলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার সীমিতই রাখতে হবে।
দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণত পূর্বাঞ্চলের চাইতে বৃষ্টি কম হয় এবং গবেষণার ফলাফলেও তা-ই দেখা গেছে। অর্থাৎ পশ্চিমাঞ্চলের এলাকাগুলোতে পাম্পিং এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানি কমে গেছে, কিন্তু দেশের পূর্বাঞ্চলে তা ঘটেনি।
মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'সবকিছুরই সীমা আছে। বিষয়টি আমাদের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হবে।'
- সূত্র: পপুলার সায়েন্স