যে ছবি দেখে আমরা লজ্জিত হয়েছি
লেখাটা অন্য একটা ইস্যু নিয়ে শুরু করব ভাবছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)-র নির্লজ্জ সংবাদ সম্মেলন দেখে ঘৃণা ধরে গেল। কিছু মানুষ কীভাবে অন্যের অর্জন এভাবে ছিনিয়ে নিতে পারে? তাও আবার সেইসব বীর খেলোয়ারদের যারা দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন।
এই বয়স্ক লোকগুলো কী ভেবেছেন যে মেয়েরা খেলে জয় ছিনিয়ে এনেছে ঠিকই কিন্তু সংবাদ সম্মেলনে কথা বলতে পারবে না? নাকি এদের কথা বলতে দিলে নিজেদের ঢোল বাজানো কম হয়ে যাবে? নাকি ওনারা মেয়েগুলোর জন্য যে অনেক করেছেন, সেই কথা জাতিকে জানানো হবে না? শুধু পদাধিকার বলে সামনের সারিতে বসে চেহারা দেখালেই কি সম্মানিত হওয়া যায়?
জাতি সংবাদ সম্মেলনের ছবির মাধ্যমে যা জানতে পারছে, তাতে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সর্বস্তরে। সামাজিক মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে। লজ্জা দেওয়া হচ্ছে গদীনশীন সাহেবদের। অবশ্য লজ্জা নামের বিষয়টি আমাদের জাতীয় জীবন থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে।
যারা দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে এলো শত প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে, সেই মেয়েদের চেহারা কেন দেখতে পেলাম না আমরা সংবাদ সম্মেলনে? বাফুফে সভাপতি, প্রতিমন্ত্রী, আমলা, কেরানি, নেতা-হাতা সবাই সামনের সারি দখল করে বসেছেন, অথচ অধিনায়ক ও কোচ বসার জায়গা না পেয়ে পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছেন। এই ছবিটা দেখে বিমমিষা জাগল। বিমানবন্দর থেকেই অচেনা নেতা-হাতাদের ছবি দেখছি আমরা দর্শক, পাঠকরা। আর খেলোয়ারদের অবস্থান একদম পেছনের সারিতে।
এরপর এই নবীন খেলোয়াররা ছাদ খোলা বাসে চেপে শহরের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষের যে ভালবাসা পেয়েছেন, তা অনন্য। যারা যেতে পারিনি, তারা টিভিতে দেখেছি এবং গর্বে কেঁদে ফেলেছি। অবশ্য তাদের নেতা কাজী মো. সালাউদ্দিন, যিনি সাফের সভাপতি ও বাফুফেরও সভাপতি, তার উচিত ছিল নেপালে গিয়ে মেয়েদের সাহস দেওয়া। কিন্তু উনি বলেছেন মেয়েরা চাপে পড়তে পারে তাই উনি যাননি। ঢাকাতে বসেই দেখেছেন সাবিনা-কৃষ্ণাদের খেলা। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর খুশিতে তিনি কারও ফোনই নাকি ধরেননি। তার উপস্থিতিতে মেয়েরা বিমানবন্দরে ভাল কাভারেজ পাবে না- এই অজুহাতে তিনি বিমানবন্দরেও গেলেন না। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে কোচ আর অধিনায়কের পাশে বসলে তিনি ম্লান হয়ে যেতে পারেন, এই আশঙ্কায় তাদের পাশেই বসতে দিলেন না।
কিন্তু সেই বিজয়ী মেয়েরা বিমানবন্দরে বা বাফুফেতে কতটুকু ফোকাস পেয়েছেন, সেতো আমরা দেখতেই পেলাম। সাফ চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে বাফুফে'র সংবাদ সম্মেলন অথচ সেখানে দলের কোচ এবং দলের অধিনায়কের বসার জায়গা নেই।
ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো বিভিন্ন মিডিয়ার ছবি দেখে হঠাৎ মনে হলো আজকে আসলে কাদের নিয়ে উৎসব? কারা জয় করে এসেছে? ছাদ খোলা গাড়ির ছবি ছাড়া বাকি ছবিগুলো আমাদের উপলক্ষই ভুলিয়ে দিয়েছিল প্রায়। শিরোপা অর্জনের এই সংবাদ সম্মেলনে সামনের সারিতে বসে থাকা মানুষগুলোর ভূমিকা কী ছিল?
একজন দর্শক বা গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবে আমরা আজ সাবিনার কাছ থেকে জানতে চাই নেতৃত্ব গুণ, কৃষ্ণার কাছে ড্রিবলিঙের রহস্য। সানজিদার কাছে তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসের পেছনের গল্প, রূপনার কাছে গোল আটকানোর টেকনিক শুনতে চাই আমরা। এই জয়ী নারীদের সারিতে একজন পুরুষই আজ বসতে পারেন, কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন। কিন্তু তাকেও তো সামনের সারিতে বসতে দেওয়া হয়নি। সাংবাদিকরা জানালো মন্ত্রী আসার পর দুজনকে চেয়ার ছেড়ে দিতে হয়েছে। তারা কারা জানেন? জয়ী দলের অধিনায়ক আর কোচ।
তবে সামনের সারিতে বসা লোকগুলোর যে কোনো অবদান যে নাই, তা কিন্তু নয়। সংবাদ সম্মেলনে ফিফা কাউন্সিল মেম্বার মাহফুজা আক্তার কিরণ নিজেই বলেছেন, ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যেসব খেলোয়াড়দের নিয়ে ক্যাম্প করা হয়েছিল তাঁর খরচ ব্যক্তিগতভাবে কাজী সালাহউদ্দিন ও আমি বহন করেছি। তিনি বলেছেন, ২০১২ সালে আমরা যে ট্যালেন্ট হান্ট করেছিলাম, আজকের মারিয়া মান্ডা, সানজিদা আক্তার কিংবা কৃষ্ণা রাণি সরকাররা সেই হান্টের ফসল। সেখান থেকে আজকের সাফল্য অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পরে এসেছে।
খুব ভালো কথা। সাফল্যের পর সাফল্যের পেছনের গল্প শোনা যায়। কিন্তু আমরা যতটুকু জেনেছি এই মেয়েগুলোকে তাদের দরিদ্র বাবা মায়েরা নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে, বেসরকারি উদ্যোগেও দেওয়া হয়েছে জুতা, ড্রেস, খাওয়া। আমাদের নেতা-হাতারা কখনো স্বপ্নই দেখেনি যে মেয়েরা ক্রিকেট, ফুটবল খেলে আন্তর্জাতিক সম্মান ছিনিয়ে আনতে পারবে। সেইভাবে সহায়তাও দেওয়া হয়নি।
আমাদের দেশের পুরুষ খেলোয়াররা যখন জয়ী হয়ে ফেরেন, তখন সরকারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কারের বন্যা বয়ে যায়। আর এদের ক্ষেত্রে দেখছি দানের টাকা জড়ো করে ভাগ করে দেয়া হবে। চ্যাম্পিয়নদের জন্য বিসিবি এবং বাফুফের দুই সহসভাপতি ব্যক্তিগতভাবে ৫০ লাখ করে নগদ অর্থ পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তবে যে ফেডারেশনের হয়ে দক্ষিণ এশিয়া জয় করে ফিরছে সাবিনারা, সেই ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে থাকছে না কোনো উপহার।
বাফুফের পক্ষ থেকে চ্যাম্পিয়নদের জন্য কী পুরস্কার থাকছে? সেই প্রশ্নের জবাবে সালাউদ্দিন বলেন, 'বাফুফের কাছে কোনো টাকা নেই।' শুধু এটুকু বলেই চুপ থাকেননি। আগ বাড়িয়ে যা বলেছেন, তা নারী খেলোয়াদের জন্য মর্যাদাহানিকর বলে মনে হয়েছে।
উনি বলেন, 'বাফুফে এই মেয়েগুলোর বাবা-মা, মানে পুরো পরিবার। আমরা ওদের ভোর থেকে রাত পর্যন্ত দেখাশোনা করি। আমরা তাদের এখনও দেখব, ভবিষ্যতেও দেখব। আমরা দেখতেই থাকব। আর ফাইনান্সিয়াল বেনিফিটের যে কথা বলছেন সে ব্যাপারে বলতে চাই যে, আমাদের কাছে কোনো টাকা নেই। কিন্তু আমরা টাকার ব্যবস্থা করব। অন্যরা যে যে টাকা দিবে সব মেয়েদের ভাগ করে দিব।' দেখা যাক মেয়েদের ভাগ্যে দানের টাকা কত করে পড়ে?
আন্তর্জাতিক শিরোপা জয়ে পেশাদার নারী খেলোয়ার খুব একটা পাইনি আমরা বা খুব একটা উঠে আসছে না বাংলাদেশে। এর অনেক কারণ আছে। সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে নারীদের পেশাদার খেলোয়ার হিসেবে উঠে আসার মতো অবকাঠামোই বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের যারা খেলার নেতা তারা শুধু ভেবেছেন পুরুষদের জন্যই ক্রিকেট, ফুটবল খেলা, মেয়েদের জন্য লুডু বা কুতকুত।
যে মেয়েগুলো আজকে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলছে, এরা প্রায় সবাই এসেছে তৃণমূল পর্যায় বা গ্রাম থেকে। তাদের অধিকাংশের পরিবারই দিন এনে দিন খাওয়া মানুষ। এই মেয়েগুলো একবার গ্রামে ফিরে গেলে যেকোনো সময়ে বাল্যবিয়ের শিকার হতে পারে এবং হয়েছেও। ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপে "হ্যাট্রিক কন্যার" খ্যাতি পেয়েছিল যে মেয়েটি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়ারের পদক নিয়েছিল যে মেয়েটি, সেই মেয়েটিও আজ ফুটবল বাদ দিয়ে সংসার সামলাচ্ছে। শুধু সে একা নয়, তার বিদ্যালয়ের ৭ জন কিশোরী ফুটবল খেলোয়াড়ও এখন বল না খেলে, সংসার করছে। কারণ করোনাকালে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। কাজেই এই তারকারাও যে ঝরে যাবে না, তা বলা যায় না।
তাই নারী খেলোয়ারদের জন্য বাড়তি কিছু সাপোর্ট লাগবেই এই ঝরে পড়া ঠেকানোর জন্য। সারাদেশ থেকেই কি নারী খেলোয়ার ট্যালেন্ট হান্ট করা হয়? তাদের গড়ে তোলার জন্য জেলা উপজেলা পর্যায়ে যে ব্যবস্থা থাকা দরকার সেটা কি তৈরি হয়েছে? তাদের আর্থিক নিশ্চয়তাই বা কোথায়? আরো মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করে এই পথে নিয়ে আসতে হবে। ওদের জন্য ভাল প্রশিক্ষণ, মাথাগোঁজার ঠাই, প্রতিদিনের সুষম খাবার, খেলার সরঞ্জাম পাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
মেয়েরা জয়ী হওয়ার পর দেখলাম ভয়াবহ রকম বেতন বৈষম্য রয়েছে নারী ও পুরুষ খেলোয়ারদের মধ্যে। ক্রিকেটে ওয়ানডে ম্যাচে নারীরা পান ৯ হাজার টাকার কম, আর পুরুষরা পান তিন লাখ টাকা। নারী ফুটবলারদের বেতন মাসে ৬ হাজার থেকে ১০ হাজার। আর ক্লাব ফুটবলে একজন শীর্ষ পুরুষ ফুটবলার বছরে পান ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। নারীরা সেখানে পান ৩-৪ লাখ টাকা। আমরা আশা করতেই পারি এইবার মেয়েদের খেলার বিষয়টি নিয়ে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় অন্যভাবে ভাববে। তাদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বেতন-ভাতা বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
প্রতিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন বিজয় উদযাপনের মাধ্যমে যেন মেয়েগুলোর আসল দাবি অর্থাৎ তাদের অবস্থা পরিবর্তনের দাবি যেন আমরা ভুলে না যাই। মেয়েগুলোর প্রাপ্য সম্মানের পাশাপাশি তাদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবিটা যেন বজায় থাকে। খুব ভাল কথা। আমরাও দেখতে চাই মন্ত্রণালয় কী করে।
সানজিদারা 'ছাদ খোলা চ্যাম্পিয়ন বাস' করে মালায় আর পতাকায় শোভিত হয়ে এসেছেন। ভালবাসায় বরণ করেছে বাংলার মানুষ তাদের। সানজিদাও বলেছেন, 'ভাবতে পারিনি ছাদখোলা বাস আসবে। ছাদখোলা বাসে চড়ে আমরা ভবনে আসব। ঢাকা শহর ঘুরেছি। অনেক ভালো লাগছে। আসলে আমি কেন, আমরা কেউ-ই কখনও ভাবতে পারিনি বাংলাদেশের মানুষ এত ভালোবেসে, আমাদের এভাবে বরণ করে নেবে। প্রায় সবারই এটা প্রথম অভিজ্ঞতা। দেখে অনেক ভালো লাগছে।'
সানজিদারা তাদের বেষ্টটা দিয়েছেন, আমাদেরও উচিত তাদেরকে সেরা কিছু দেওয়া। দেশের জন্য যারা সম্মান বয়ে এনেছে, আমাদেরও উচিত তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া। শুধু সরকারের কাছে অনুরোধ মেয়েগুলোর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুগম করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কত ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প হতে নেওয়া হয়, এবারে মানব উন্নয়নের জন্য মাঠ থেকে উঠে আসা এই মেয়েগুলোকে সহায়তা দিন। শুধু নিজেদের প্রশংসায় নিজেরাই পঞ্চমুখ থাকবেন না।
এরচেয়েও বেশি জরুরি জয়ী মেয়েগুলোকে মর্যাদা ও নিরাপত্তা দেয়া এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর জুলুমের হাত থেকে তাদের রক্ষা করা। যারা পেশাক নিয়ে এদের হেনস্থা করার মাধ্যমে গতিরোধ করতে চাইবে, তাদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে আমাদেরই। জয় হোক নারী ফুটবল দলের। তোমাদের অভিবাদন প্রিয় মেয়েরা। আমরা তোমাদের জন্য কিছুই করিনি, কিন্তু তোমরা তোমাদের শ্রেষ্ঠটা দেশকে দিয়েছ।
- লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন