‘লাগেজ লেফট বিহাইন্ড’-এর ঘটনায় ভোগান্তিতে বিমানযাত্রীরা
বাংলাদেশি-মার্কিন নাগরিক জাকিয়া হাসিন (৫৬) গত ফেব্রুয়ারিতে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসেন।
ঢাকায় আসার সময় তার লাগেজ হারিয়ে যায়। জানা যায়, সেটি দোহায় রয়ে গেছে। ওই লাগেজে তার অতি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ও ওষুধ থাকলেও সফরের কয়েকদিনে তাকে তার লাগেজ ফেরত দেওয়া হয়নি।
এয়ারওয়েজ অবশেষে বাংলাদেশের একটি অস্থায়ী ঠিকানায় ব্যাগটি পৌঁছে দিয়েছিল, কিন্তু ততদিনে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গেছেন জাকিয়া।
এরপর থেকে তিনি তার যুক্তরাষ্ট্রের ঠিকানায় ব্যাগটি ফেরত দেওয়ার জন্য কাতার এয়ারওয়েজের কাস্টমার সার্ভিস সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
"প্রায় ৭ মাস হয়ে গেছে, এয়ারলাইন্সের ঢাকা ও কাতার অফিস এবং গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রের মধ্যে ৬৫টিরও বেশি ই-মেইল আদান-প্রদান হয়েছে, কিন্তু কোনো ফলাফল নেই। গ্রাহক পরিষেবা খুবই আন্তরিক, কিন্তু তাদের ঢাকার অফিস থেকে কোনো উত্তর না আসায় তারা সাহায্য করতে পারছে না," দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ কথা বলেন জাকিয়া।
"কাতার এয়ারওয়েজের দোহাস্থ কাস্টমার সার্ভিসে যোগাযোগ করলে তারা ঢাকা অফিসের একটি ই-মেইল দিয়েছিল। ঢাকায় যতবার ই-মেইল করেছি একবারও তারা স্বতপ্রণোদিত হয়ে উত্তর দেয়নি। এরপর আবারও কাতারে এ বিষয়ে জানানো হলে, সেখান থেকে তাগিদ দেওয়ার পর তারা আমার ই-মেইলের উত্তর দেয়," যোগ করেন তিনি।
এয়ারলাইন্সগুলো দ্বারা লাগেজ নিয়ে হয়রানির শিকার শত শত বাংলাদেশির মতো জাকিয়াও একজন। বছরের পর বছর ধরে বিদেশ থেকে ফেরার সময় লাগেজ হারিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা অহরহই ঘটছে বাংলাদেশিদের সঙ্গে।
গত দুই ঈদে দেশে ফেরার সময় এ ঘটনার শিকার বাংলাদেশিদের সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানায় ঢাকা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
সাধারণত বাজেট (স্বল্প খরচের মাল পরিবহন) এয়ারলাইনগুলোতে 'ব্যাগেজ লেফট বিহাইন্ড' বা লাগেজ ফেলে আসার বা হারিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটনা থাকে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, গত এক মাসে কমলেও এর আগের কয়েক মাসে সব ধরনের এয়ারলাইনের ক্ষেত্রে লাগেজ ফেলে আসার ঘটনা বেড়েছিল মাত্রাতিরিক্ত।
এরমধ্যে এয়ার অ্যারাবিয়া, জাজিরা এয়ারওয়েজ, সালাম এয়ার, কাতার এয়ারওয়েজ, কুয়েত এয়ারওয়েজ, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সসহ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটেই এ ঘটনা বেশি ঘটছিল।
এরমধ্যে সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজ, এয়ার অ্যারাবিয়ার প্রতিটি ফ্লাইটে কমপেক্ষে ২০ থেকে ৫০ জন যাত্রীর ব্যাগ সঙ্গে না নিয়েই চলে আসতো। যাত্রীদের লিখিত কোনো ডকুমেন্ট না দিয়েই ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে বাড়িতে লাগেজ পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতো এয়ারলাইনগুলো।
তবে কোনো কোনো যাত্রীর লাগেজ পেতে পার হতো এক মাসেরও বেশি সময়।
হয়রানির শেষ এখানেই নয়; যাত্রীদেরকে নিজেদের ফোন নম্বর দিলেও কোনো এয়ারলাইনই যাত্রী বিমানবন্দর থেকে চলে যাওয়ার পর উত্তর দিতো না ঠিকমত।
জাকিয়ার লাগেজ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কাতার এয়ারওয়েজের ঢাকা বিমানবন্দর সার্ভিসের এজেন্ট মো. আহসান টিবিএসকে বলেন, "ব্যাগেজ বিষয়ে যাত্রীর পক্ষ থেকে আগে যোগাযোগের ই-মেইল, ডকুমেন্টসহ সব তথ্যাদি নিয়ে তার কোনো প্রতিনিধিকে আমাদের এয়ারপোর্ট অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। তারপর আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে এটি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারি।"
অন্যান্য এয়ারলাইনের গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্র থেকেও একই কথা বলা হয়।
এদিকে, লাগেজ হারানোর ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এ বিষয়ে তারা এয়ারলাইনগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে এবং এ ধরনের ঘটনা গতমাসে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
ঢাকা বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোঃ কামরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার যাত্রী বিমানবন্দর ব্যবহার করেন। সিভিল এভিয়েশন অথরিটির মাধ্যমে ইতোমধ্যে ফ্লাইট ফ্রিকুয়েন্সি কমিয়ে দেওয়া, সিট কাটা, জরিমানাসহ বিভিন্ন শাস্তির পরে লাগেজ রেখে আসার ঘটনা অনেকটাই কমেছে। এখন লেফট-বিহাইন্ডের হার ১ শতাংশেরও কম।"
এভিয়েশন খাতের পরিভাষায়, লাগেজ লেফট বিহাইন্ড হচ্ছে- একটি ফ্লাইটে যাত্রীর সঙ্গে তার লাগেজগুলো নির্ধারিত গন্তব্যে না পৌঁছানোকে বোঝায়।
মূলত যাত্রীকে নিয়ে আসলেও বিভিন্ন কারণে ইচ্ছাকৃতভাবে এয়ারলাইন যাত্রীর লাগেজ নিয়ে আসে না।
জাজিরা এয়ারওয়েজের ঢাকা বিমানবন্দরের ডিউটি ইনচার্জ তৌফিক মান্নান টিবিএসকে বলেন "উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ার ক্ষেত্রে ভার বহনের সক্ষমতা নির্ধারিত। খালি উড়োজাহাজের ওজন, যাত্রীদের ওজন, যাত্রীদের লাগেজের ওজন, জ্বালানি তেলের ওজন- সব সমন্বয় করে আকাশে ওড়ার জন্য নির্ধারিত ওজন ঠিক রেখে ফ্লাইটের প্রস্তুতি নেওয়া হয়।"
লাগেজ রেখে আসার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, "আমাদের এখানে মূলত যাত্রীরা বেশি লাগেজ নিয়ে আসে, যে কারণে কখনো কখনো ফ্লাইটে এয়ারলাইনগুলো লাগেজ কমিয়ে ওজনের সমন্বয় করে ফ্লাইট পরিচালনা করে।"
"আবার কখনো কখনো আবহাওয়া খারাপ থাকলে লাগেজ কমিয়ে জ্বালানি তেল বেশি নেয় এয়ারলাইনগুলো। বিশেষ করে শীতকালে এরকমটি বেশি হয়," যোগ করেন তিনি।
গত ঈদের সময় রাশ থাকায় এমন ঘটনা বেশি হয়েছে স্বীকার করে সালাম এয়ারের এয়ারপোর্ট সার্ভিস এজেন্ট নাজমুল হুদা শামিম বলেন, "অন্যান্য কারণের পাশাপাশি কারিগরি ত্রুটি, মিস হ্যান্ডলিং, ভুল ট্যাগিং, ট্রানজিটে যান্ত্রিক ত্রুটিও লাগেজ লেফট বিহাইন্ড'র জন্য দায়ী। তবে বর্তমানে এটি অনেক কমে এসেছে।"
বিতর্কের একটি বিষয় হল, এয়ারলাইন কর্মীরা ইতোমধ্যেই জানেন কার লাগেজ দেরিতে পৌঁছাবে। তাই তারা যাত্রীদের উদ্বেগ কমাতে এই তথ্য তাদের আগেই জানাতে পারেন।
ক্ষতিপূরণের অকার্যকর পদ্ধতি
কোনো যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছানোর পর লাগেজ না পেলে তাকে 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' বিভাগে গিয়ে লাগেজ হারানোর বিষয়ে 'প্রপার্টি ইরেগুলারিটি রিপোর্ট' (পিআইআর) করতে হয়।
পিআইআর করা হলে যাত্রীর লাগেজ কোথায় আছে তা অনুসন্ধান করা যায়। পিআইআর করার ২১ দিনের মধ্যে লাগেজ দিতে না পারলে এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম রয়েছে।
গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের আওতায় বিমানবন্দরগুলোর লাগেজ হারানো সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর 'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' বিভাগ পরিচালনা করছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স।
কখনো কখনো যাত্রীরা পিআইআর প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করার পরিবর্তে বিমানের কর্মীদের কাছ থেকে শুধু এয়ারলাইন্সের যোগাযোগের নম্বর পান।
পিআইআর ফাইল করতে না পারার কারণে যাত্রীরা ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানায় বিমানবন্দর সূত্র।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং আরও ঝামেলামুক্ত হয়ে উঠেছে, যাত্রীরা তাদের লাগেজ এক ঘণ্টার মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা কঠোরভাবে এই পরিষেবাগুলো পরিচালনা করছি।"