সেবা পেতে ভোগান্তির মাঝে আশার আলো ভূমি হটলাইন
২০১৯ সালে একটি ফ্ল্যাটের নামজারি করতে ১২ হাজার টাকার বেশি খরচ করতে হয়েছিল যশোরের বাসিন্দা কল্যাণ তরপদারকে। নামজারির কাজটি সম্পন্ন হতে প্রায় তিন মাস লেগে গিয়েছিল।
কিন্তু এখন, দুই মাস আগে এই সেবা নিতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয় কল্যাণের।
'এবার আমি যখন ভূমি সেবার হেল্পলাইন নম্বর ১৬১২২-তে ডায়াল করে নামজারির সেবা নিয়েছি, তখন খরচ হয়েছে মাত্র ১ হাজার ১০০ টাকা। কোনো ভোগান্তিও পোহাতে হয়নি,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি জাতীয় ভূমি সেবা কল সেন্টার চালু হওয়ার ফলে কল্যাণ তরপদারের মতো দেশের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জীবন অনেক সহজ হয়ে গেছে। এই কল সেন্টারে ফোন করে ঘরে বসেই যেকোনো সময় নেওয়া যায় বিভিন্ন সেবা। কল সেন্টার সেবাটির নাম 'নাগরিক ভূমি সেবা ২৪/৭'।
বর্তমানে হটলাইন সেবাটি পরিচালনা করছে ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ডিজিকনের তথ্য বলছে, ভূমি সেবা হটলাইন ১৬১২২-এ ফোন করে এবং ফেসবুক পেজে (www.facebook.com/land.gov.bd) মেসেজ পাঠিয়ে গত আট মাসে কল্যাণের মতোই প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ বিভিন্ন ধরনের সেবা নিয়েছেন এবং তথ্য জেনেছেন।
সেবা গ্রহীতারা বলছেন, এ সেবা চালু হওয়ার পরে ভূমি অফিসে গিয়ে এখন আর ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। তারা এখন হটলাইন ১৬১২২-এর মাধ্যমে ও অন্যান্য ডিজিটাল সেবার মাধ্যমেই ভূমি সেবা পাচ্ছেন। এছাড়া ভূমি অফিস-সংক্রান্ত কাজগুলো শেষ করতেও নির্ধারিত ফি প্রদান করেই সেবা পাচ্ছেন গ্রাহকরা। এতে তাদের আর্থিক খরচ ও ভোগান্তিও কমে গেছে।
ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেড প্রশিক্ষিত প্রায় ৫০ জন কর্মী নিয়ে হটলাইন সেবা দিচ্ছে।
ডিজিকন টেকনোলজিস লিমিটেডের সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (সেবা মান ও প্রশিক্ষণ) রোমেল মাহতাব টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের এখানে যারা হটলাইনে সেবা দিচ্ছেন, তাদেরকে ভূমি-সংক্রান্ত সব বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজস্ব প্রশিক্ষক এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষক দিয়ে তাদেরকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।'
নাগরিক ভূমি সেবা ২৪/৭-এর জনপ্রিয় সেবাগুলোর মধ্যে আছে—বাড়িতে ডাকযোগে অধিকারের রেকর্ড (আরওআর/খতিয়ান/পর্চা) ও জমির ম্যাপ প্রাপ্তি, যেকোনো জায়গা থেকে আরওআর ও নামজারি ফি এবং ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান, নামজারি আবেদন, ভূমি আইন ও প্রবিধান সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর প্রদান এবং বিবিধ অভিযোগ গ্রহণ ইত্যাদি।
নীলফামারীর ডিমলা থেকে হটলাইনে কল করে ভূমি উন্নয়ন কর সেবা নেওয়া জেসমিন আক্তার টিবিএসকে বলেন, 'এক মাস আগে আমার বাবার ভূমি কর দেওয়ার জন্য অনলাইনে বাবার একটি প্রোফাইল করার জন্য সাহায্য চেয়ে হটলাইন নম্বরে কল দিই। ফোন করার পরে ৫ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে তারা প্রোফাইলটি করে দেন। এখন অনলাইনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই ভূমি কর প্রদান করছি।
'আগে ভূমি অফিসে গিয়ে কয়েকদিন ঘুরে ভূমি কর দিতে হতো। আর প্রতিবারেই অফিসের লোককের টাকা দিতে হতো। এখন আর সে ভোগান্তি নেই।'
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখনও এ হটলাইন সেবাটির কথা জানে না বলে এখনও অনেকে ভূমি-সংক্রান্ত সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন। এই পরিস্থিতিতে দেশের মানুষকে হটলাইন সেবাটি সম্পর্কে জানাতে প্রচারণামূলক কর্মসূচি পালনের ওপর জোর দেন তারা।
গত ৩১ আগস্ট প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে দেশের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নেওয়ার সময় ৭১ শতাংশ সেবাপ্রার্থী দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
'করাপশন ইন দ্য সার্ভিস সেক্টরস, ন্যাশনাল হাউসহোল্ড সার্ভে ২০২১' শীর্ষক সমীক্ষায়, ৪৬.৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন যে তারা ভূমি সেবা নেওয়ার সময় 'দুর্নীতির শিকার' হয়েছেন।
হটলাইন ও অনলাইনের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ বাড়লে অসাধু সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসবে বলে মত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, নামজারি আবেদনের অনুমোদনের পর নামজারি ব্যবস্থায় আবেদন প্রক্রিয়া, ফি প্রদান ও প্রয়োজনীয় নথিও—যেমন ডিসিআর (ডুপ্লিকেট কার্বন রিসিপ্ট) ও আরওআর—এখন সম্পূর্ণ ডিজিটাল ডিজিটাল উপায়ে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া ২০২২ সালের ১ অক্টোবর থেকে ই-নামজারি ব্যবস্থায় ম্যানুয়ালি বা নগদে কোনো ফি নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আবদুল্লাহ আল নাহিয়ান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা আগামী এক বা দুই মাসের মধ্যে এই সেবার পরিধি বাড়াব। হটলাইন সেবার সমস্ত কার্যক্রম এরপর ভূমি ভবন থেকে পরিচালিত হবে।'
মন্ত্রণালয় সেবাটি প্রচারের জন্যও কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমরা চাই সবাই অনলাইনে ভূমি সেবা গ্রহণ করুক।'
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, 'যাদের কাছে নথিপত্র আছে তারাই জমির মালিক', এই ধারণা থেকে তার মন্ত্রণালয় 'ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইনের খসড়া তৈরির কাজ করছে'।
তিনি বলেন, 'যত বছরই কেউ জোরপূর্বক জমি দখল করে থাকুক না কেন, সঠিক কাগজপত্র ছাড়া অবৈধ দখলদারের মালিকানা এই আইনে কখনোই স্বীকৃত হবে না।'
আইনটি প্রণয়ন হলে জমি দখল-সংক্রান্ত হয়রানি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মন্ত্রী।
তিনি বলেন, খসড়া আইনটি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে এবং তারপর তা প্রণয়নের জন্য সংসদে পাঠানো হবে।
২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ছোট পরিসরে 'ভূমি সেবা হটলাইন ১৬১২২' উদ্বোধন করেন। হটলাইনটিতে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ কলদাতাকে সেবা দেওয়া হয়।
২৮ দিনে ই-নামজারি সম্পন্ন করতে ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা
ভূমিসেবায় ই-নামজারি ২৮ দিনের মধ্যেই সম্পন্ন করতে উদ্যোগ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়।
ওই চিঠিতে ই-নামজারি সংশ্লিষ্ট অবমুক্ত তথ্যের বরাতে ই-নামজারির গড় নিষ্পত্তির সময় নিয়মিত মনিটরিং করার কথা বলা হয়েছে। ২৮ দিনের বেশি অনিষ্পন্ন ই-নামজারি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে চিঠিতে।
এছাড়া একই চিঠিতে আগের সিস্টেমের কারণে যেসব আবেদন 'মিথ্যা-নেতিবাচক' অনিষ্পন্ন বা পেন্ডিং দেখাচ্ছে, সেসব সমাধান করার উপায়ও জানানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সামগ্রিকভাবে ই-নামজারি নিষ্পত্তিতে অত্যধিক সময় ব্যয় করার জন্য অন্যান্য সমস্ত কারণ জানাতেও বলেছে।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের ই-মিউটেশন মনিটরিং ড্যাশবোর্ডের তথ্যমতে, আগস্ট মাসে দেশের সব বিভাগেই ই-নামজারি মামলা নিষ্পত্তির গড় সময় বেশি লেগেছে। যেখানে সর্বোচ্চ গড় সময় লেগেছে চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৬ দিন এবং সর্বনিম্ন সময় লেগেছে ঢাকা বিভাগে ৩৭ দিন।
ই-নামজারি নিষ্পত্তিতে অত্যধিক সময় লাগা জেলাগুলোর সময় মধ্যে গড় হিসাব অনুযায়ী সর্বোচ্চ সময় ৭২ দিন লেগেছে গাজীপুরে এবং সর্বনিম্ন ৫২ দিন সময় লেগেছে কক্সবাজার, খুলনা, গাইবান্ধা ও দিনাজপুরে।