ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে কি অনৈতিক ও অসম্মানজনক নয়?
ধর্ষকের সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে কতটা নৈতিক বা কিভাবে বিয়েটা হওয়া সম্ভব, এই আলোচনায় যাওয়ার আগে ভয়াবহ অপরাধটিকে চিন্তা করতে হবে নিজের বা নিজের পরিবারের ক্ষেত্রে ঘটলে কী হতো, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে।
পরিবারের কারো সাথে যদি এই অপরাধ ঘটে থাকে, তাহলে সেই পরিবার কি ধর্ষণের শিকার তার কন্যা বা বোনের সাথে ধর্ষণকারীর বিয়ের রায়কে স্বাগত জানাতে পারবে? যে নারীকে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে, সে কিভাবে ধর্ষণকারীর গলায় মালা পরিয়ে দিয়ে তার সঙ্গে বসবাস করতে পারবে?
খবরে দেখলাম বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার এক নারীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ধর্ষকের। সম্প্রতি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে এই বিয়ে হয়েছে। ধর্ষণের শিকার তরুণীটি গৃহকর্মী ছিলেন। কাজ শুরুর পরে আসামি ওই তরুণীকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। মেয়েটি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর জানতে পারে সে গর্ভবতী। তিনি মামলা করলে পুলিশ গৃহকর্তাকে গ্রেপ্তার করে।
মামলা চলা অবস্থায় ভিকটিম সেন্টারে ছেলেসন্তানের জন্ম দেন বাদী। ছেলের বয়স যখন দুই বছর, তখন আদালতের অনুমতি নিয়ে ধর্ষক ভিকটিমকে বিয়ে করে এবং জামিনে বের হয়ে আসে।
অবশ্য আদালত রায়ে তার পর্যবেক্ষণে বলেন, "এই মামলাটাকে খারিজ করা হচ্ছে না। মামলাটা আমার কাছেই থাকবে। আমি দীর্ঘ একটা সময় নিয়ে মামলাটাকে পর্যবেক্ষণে রাখবো- আসলেই ভিকটিম সুখে আছে কিনা, আসামি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে কিনা, তাকে সুখে রাখছে কিনা," এসব দেখবেন।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শারমিন আক্তার ধর্ষকের সাথে ভিকটিমের বিয়ে প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছেন, বিয়েটাকে 'জামিনের একটা গ্রাউন্ড' হিসেবে ব্যবহার করে অপরাধীরা। বিচারকরা যখন দেখেন যে বিয়ে হয়ে গেছে, কাজেই জামিন দিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু পরে এই মামলাগুলো আর এগিয়ে যায় না। কারণ ঐ আসামীর প্রতি মামলা চালানোর ইচ্ছাটা বাদীর আর থাকে না। কিন্তু মামলা চালু থাকে।
তিনি মনে করেন এর মাধ্যমে সমাজে একটা ভুল বার্তা যায়। কারণ যারা ধর্ষক, তারা মনে করে আমি ধর্ষণ করলাম এবং যাকে ধর্ষণ করলাম, তাকে বিয়ে করার মাধ্যমে মুক্তি পেয়ে গেলাম। সেক্ষেত্রে ধর্ষণের জন্য যে বিচার সেটা আর পেতে হয় না। অর্থাৎ ফলোআপ থাকে না।
ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ে নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তার নীচে যেসব মন্তব্য ছাপা হয়েছে, এরমধ্যে অধিকাংশ মানুষই খুশির মনোভাব জানিয়েছেন। অনেকে বলেছেন ধর্ষকের সাথে বিয়ে না হলে ধর্ষণের শিকার নারীর কী হতো? কোথায় যেতো ধর্ষণের শিকার মেয়েটি? ভাবটা এমন যে অপরাধী ধর্ষণের মতে কাজটা করেছে, সেই মেয়েটিকে উদ্ধার করবে।
মানুষ কিভাবে ধর্ষণের মতো এতবড় একটি অপরাধকে খুব সহজে মেনে নিতে পারছে? কেন একবারও ভাবছে না নিজেদের অবস্থান থেকে। বাংলাদেশে ধর্ষণ এত বেশি হারে হচ্ছে যে শিশু থেকে বয়স্ক নারী, বালক, প্রতিবন্ধী নারী, মানসিক ভারসাম্যহীন নারী কেউ বাদ যাচ্ছে না। ইতর প্রকৃতির লোকজন সুযোগ পেলেই ধর্ষণ, যৌন হয়রানি চালিয়েই যাচ্ছে। এরজন্যে কোনো কারণের দরকার হয় না।
দেশে ২০২২ সালের প্রথম আট মাসে ৫৭৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে এককভাবে ধর্ষিত হয়েছে ৩৬৪ জন, দলবদ্ধভাবে ৮৪ জন। এছাড়া ৪৩ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। 'জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম' এসব তথ্য তুলে ধরেছে। এখানেই শেষ নয়, গত আট মাসে মোট ৭৬ কন্যাশিশু যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এখন আমরা কী করবো? ধর্ষকদের সাথে কি ৫৭৪ জন কন্যাশিশুর বিয়ে দেয়া সম্ভব?
আমাদের দেশে সামাজিক অবস্থায় একজন ভিকটিম বা ভিকটিমের পরিবার খুব ট্যাবুর মধ্যে থাকেন ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনার পর। তারা ভাবতে বাধ্য হন মামলা করবেন কিনা, সবার সামনে যাবেন কিনা, বিচারের মুখোমুখি হবেন কিনা, মামলার ব্যয়ভার বহন করতে পারবেন কিনা, আসামী পক্ষ শক্তিশালী কিনা ইত্যাদি। এইসব ভাবনাচিন্তাতেই পার হয়ে যায় বেশ কিছুদিন। এটাই আমাদের কঠিন বাস্তবতা।
যে নারী-কিশোরী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হন, প্রথমেই তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ট্রমায় চলে যান। ধর্ষণের পর বেশিরভাগ ভিকটিমের পরিবার এবং তার আত্মীয়স্বজন ও পারিপার্শ্বিক কারণে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। ঘটনা গোপন করার জন্য বা অপরাধীরা শক্তিশালী হলে পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে বেশিরভাগ ভিকটিমকে দীর্ঘ সময় আটকেও রাখা হয়। তাই ধর্ষণের শিকার নারী-কিশোর বা শিশু সময়মতো মামলা বা অভিযোগ দায়ের করতে পারে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে মামলাটাও থানা নিতে চায় না। অনেক ধর্ষণ মামলা বছরের পর বছর আদালতে চলতে থাকে।
আমরা যারা প্রান্তিক এলাকায় নারী, শিশু নিয়ে কাজ করি, তারা সবসময় এলাকাবাসীকে এই বলে সচেতন করি যে ধর্ষণের ঘটনায় কোন সালিশ হয়না। অথচ দেখতে পারছি ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনা এটাই প্রথম না। ২০২০ সালে ফেনীতে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। আসামিপক্ষ ঐ কিশোরীকে বিয়ে করতে চাইলে আদালত তাদের বিয়ের সিদ্ধান্ত দেয় এবং পরে ঐ লোকের জামিনও হয়ে যায়।
কিশোরী বা তরুণীর সাথে বিয়ে দিয়ে ধর্ষণের অপরাধীকে একভাবে ধর্ষণ মামলার শাস্তি দেয়া হলো। কিন্তু যে লোকগুলো বিবাহিতা নারী, দুগ্ধপোষ্য শিশু, নাবালিকা, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে অথবা বালকদের ধর্ষণ করে, তখন তাদের জন্য কোন শাস্তি প্রযোজ্য হবে?
আইনজীবী শারমিন আক্তারও বলেছেন, বাংলাদেশের আইনে কিছু অপরাধ আছে যেগুলোর কোন আপোস-মীমাংসার সুযোগ নেই। ধর্ষণের ঘটনা তেমনি একটা-যেখানে কোনো আপোসের সুযোগ নেই। যেখানে বাংলাদেশের আইনে বলা হয়েছে ধর্ষণ বা ধর্ষণের পরে হত্যা, ঘটনায় কোন আপোস-মীমাংসার প্রশ্নই আসে না।
আমাদের সমাজে আপোস-মীমাংসার নামে যেটা হয়, সেটা হলো বিভিন্ন মহল থেকে নানা চাপ দেয়া ও টাকার লোভ দেখানো। সেক্ষেত্রে বিয়েটাও একধরণের প্রলোভন। সমাজ মানতেই চায় না যে, একজন ধর্ষকের সাথে জীবন কাটানো কতটা লজ্জার হতে পারে মেয়েটির জন্য? তাকে ধর্ষণ করার বিচার তো হলোই না, উপরন্তু অপরাধীর সঙ্গে সংসার করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে।
ধর্ষণের শিকার মেয়েটির দরিদ্র পরিবার হয়তো ভাবেন বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির একটি হিল্লে হলো বা সমাজে মুখ দেখানোর একটা ব্যবস্থা হলো। তা না হলে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে নিয়ে কোথায় যাবেন তারা, কে বিয়ে করবে তাকে? অথচ এই সমাধান যে একটি মেয়ের জন্য কতটা অপমানজনক ও ভয়ের, তা পরিবার ভাবেই না। ভয়ংকর একজন দানবের সাথে তাকে সহবাস ও বসবাস করতে বাধ্য করা হয়।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন কর্তৃক ২০১৪ সালে প্রকাশিত 'Landmark Judgements on Violence against Women of Bangladesh, India and Pakistan' শীর্ষক বইটিতে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেছিলেন যে, বিচারের সময় একজন রেপ ভিকটিমের মুখের কথাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সেইসাথে গুরুত্ব দিতে হবে পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণাদিকে। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যা শুধু ভিকটিমকে নয়, পুরো সমাজকে আঘাত করে।
কাজেই সেইরকম একটি অপরাধ করে অপরাধী পার পেয়ে যায় কেমন করে? আর কেমন করেইবা যাকে ধর্ষণ করেছে, তাকেই বিয়ে করার অধিকার পায়? এর মানে শুধু অপরাধ বা শাস্তির হাত থেকে বাঁচার জন্যই অপরাধী বিয়েকে 'অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার' করে।
একটি মেয়ে বা নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন সমাজ তাকেই সবচেয়ে আগে দায়ী করে। হয় মেয়েটির পোশাককে, না হয় চলাফেরাকে, চাকরি করাকে, পর্দা মেনে না চলাকে, পরিবেশ-পরিস্থিতিকে, স্বভাব-চরিত্র বা আচার-আচরণ এমনকি চেহারাকেও দায়ী করে। ধর্ষণকারীকে কখনোই দায়ী করা হয় না।
যেমন কিছুদিন আগে চলন্ত বাসে যখন একজন নারী গণধর্ষণের শিকার হলেন, বলা হলো মেয়েটি একা কেন ভ্রমণ করছে, তাই এমন হতেই পারে। এর দুয়েকদিনের ভেতর আরেকজন নারীকে বাসে যখন গণধর্ষণ করা হয়, তখন তার স্বামীকে পাশে বেঁধে রাখা হয়েছিল। এবার তাহলে সেই মানুষগুলো কাকে দায়ী করবে?
দেহ বিক্রি করাই যার পেশা, অর্থাৎ যৌনকর্মী, তাকেও ধর্ষণ করার অধিকার কারো নেই। যারা যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন কোনো খদ্দের যদি কোনো যৌনকর্মীকে জোর-জবরদস্তি করে, তবে সেই খদ্দেরকে সবাই মিলে প্রতিহত করে। কারণ যৌনকর্মীরও অধিকার আছে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোন কিছু না করার। যদিও তারা পয়সার বিনিময়ে শরীর বিক্রি করেন। কাজেই একজন যৌনকর্মীও যদি অভিযোগ করেন যে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পুলিশকে সেটাও তদন্ত করতে হবে।
কেন ধর্ষণ মামলার বিচারের দেরি হয় বা বিচার ঝুলে যায়, এই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায় বেশিরভাগ সাক্ষী হাজির না হওয়াতে ধর্ষণ মামলার তারিখ পিছিয়ে গেছে। অভিভাবকরা হতাশ হয়ে আর কোর্টে যেতে চাইছেন না। দরিদ্র অভিভাবকরা আর্থিক অসুবিধার জন্য মামলা চালাতে নারাজ। অভিভাবকদের এই দারিদ্রের সুবিধা নেয় আসামিপক্ষ।
আর যেহেতু সমাজ এবং মাঝেমধ্যে বিচার ব্যবস্থাও মনে করেন যে ধর্ষণ মামলার কোন কোন আসামি 'নিরপরাধ' বা হঠাৎ করে ধর্ষণ করেছে, তখন স্বভাবতই ভুক্তভোগীরা অপরাধী প্রমাণিত হয়ে যায়। কারণ ভিকটিম এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন যাতে ধর্ষণ সংঘটিত হয়।
আমরা দেখেছি ধর্ষকের পক্ষে প্রচলিত ধারণা বা কুযুক্তি বা মিথগুলো হচ্ছে, নারীরা সবসময় ধর্ষণ নিয়ে মিথ্যাচার করে। কারণ তারা যৌনক্রিয়া করে অপরাধবোধে ভোগে বা তারা আলোচিত হতে চায়। তাছাড়া কেউ যদি চিৎকার না করে বা আক্রমণকারীকে আঘাত না করে বা তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি না করে তবে এটা ধর্ষণ হবে না।
কিন্তু আমরা জানি যে যৌনক্রিয়ার ক্ষেত্রে সব সময় অবশ্যই সঙ্গীর সম্মতি লাগবে। যে কোনোধরণের সম্পর্কে থাকা অবস্থাতেও ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন অপরাধ। এমনকি বৈবাহিক জীবনে স্বামীর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়াও একজন নারীর কাছে খুবই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
একজন ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে হলে সেই মেয়েটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। এমনও দেখা গেছে বিয়ে করার পর ধর্ষকের জামিন হয়ে গেলে, সে মেয়েটিকে তালাক দিয়ে দেয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে পড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে, নির্যাতিত নারীকেই 'ভোগ করা'র কী চমৎকার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। মেয়েটি নিঃসন্দেহে তার বিবাহিত জীবনেও এভাবেই ধর্ষণের শিকার হতে থাকবে। অন্যদিকে অপরাধীরাও ভাবে ধর্ষণ করলে বিচারের পরিবর্তে বিয়ের পথ তো খোলা থাকলোই।
বাংলাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি 'মৃত্যুদণ্ড' করবে কিনা জানিনা। আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের যে সাজা আছে, সেটারই প্রয়োগ নিশ্চিত হোক। অন্তত ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে যেন ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া না হয়। কারণ যখন কোন নারী অপরিচিত কোন পুরুষ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তখন তিনি খুব ভীতিজনক একটি স্মৃতি নিয়ে বাঁচেন। পরে যখন বাধ্য হয়ে সেই লোকটিকে তাকে বিয়ে করতে হয়, তখন মেয়েটির মনে হবেই যে তিনি একজন ধর্ষকের সাথে ঘুমাচ্ছেন।