অ্যাম্বার হার্ডের অনলাইন বিদ্বেষী ট্রল এখন অ্যাঞ্জেলিনা জোলির দিকে
হলিউডের অন্যতম পাওয়ার কাপল ছিলেন ব্র্যাড পিট ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। এই জুটির খ্যাতি এতটাই বেশি ছিল যে দুজনে 'ব্রাঞ্জেলিনা' নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সেসব অনেক বছর আগের কথা, বিচ্ছেদের পরপরই একে অপরের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত হন! সেই থেকে একে অপরের দিকে অভিযোগ তীর ছুঁড়তেই ব্যস্ত, যা সম্প্রতি বেশ গুরুতর রূপ ধারণ করেছে।
গত সপ্তাহে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি তার প্রাক্তন স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন যে ব্র্যাড পিট তার ও তাদের সন্তানদের ওপর নির্যাতন করেছেন, এমনকি পিট সন্তানদের গলা টিপে ধরেছিলেন বলেও অভিযোগ এনেছিলেন তিনি! এ খবর চাউর হবার পরপরই ইন্টারনেট দুনিয়া ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং নিন্দা জানাতে শুরু করে... কিন্তু ব্র্যাড পিট নয়, বরং নিন্দা জানায় অ্যাঞ্জেলিনা জোলির বিরুদ্ধে! সেই সাথে 'ফাইট ক্লাব' অভিনেতার পক্ষ নেওয়ার লোকেরও অভাব হয়নি। জনৈক ইউটিউবার তো দাবি করেই বসেছেন যে- অ্যাঞ্জেলিনা জোলি ব্র্যাড পিটকে ধ্বংস করে দিতে চান এবং তার গায়ে কলঙ্ক লেপন করতে চাইছেন!
পাঠকের কাছে গল্পটা অনেকটা পরিচিত লাগছে কী? চলতি বছরে হলিউডেরই আলোচিত আরেক জুটি জনি ডেপ-অ্যাম্বার হার্ডের মানহানি মামলার সাথে পিট-জোলির গল্পের কিছুটা সাদৃশ্য পাওয়া যায়। অনেকেই অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে 'নতুন অ্যাম্বার হার্ড' তকমা দিয়ে দিতে চাইছেন।
অ্যাম্বার হার্ড যখন জনি ডেপের বিরুদ্ধে গৃহ-সহিংসতা ও তাকে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন, কিন্তু আদালতে তা প্রমাণ করতে পারেননি, বরং তার একের পর এক মিথ্যা ধরা পড়ে গেছে; তখন নেটিজেনরা তাকে মিথ্যাবাদী, অসাধু উপায় অবলম্বনকারীসহ নানা কটূক্তি করেছিল। এমনকি অ্যাম্বার হার্ডের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ এত বেশি ছিল যে তা মামলার রায়কে প্রভাবিত করেছে বলে ধারণা কারো কারো!
টুইটার অ্যানালিটিকস টুল বট সেন্টিনেল জানিয়েছে, একদল টুইটার ব্যবহারকারী কিভাবে ঘৃণা ছড়াতে পারে তার অন্যতম উদাহরণ ছিল ডেপ-হার্ড মামলা। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অ্যাম্বার হার্ডকে টার্গেট করে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে। আর এবার তারা নতুন এক তারকাকে বেছে নিয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে যিনি হলেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি!
বট সেন্টিনেলের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস্টোফার বাউজি এক টুইট বার্তায় লেখেন, "আমি আগেই সতর্ক করেছিলাম যে অ্যাম্বার হার্ডকে যারা টার্গেট করছে, এরা পরবর্তীতে অন্য কারো দিকে নিশানা করবে। এই একই কুটিল কৌশল-ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল তারা অ্যাম্বার হার্ডের সময়ে, এখন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, আর এখন ব্যাপারটা আগের চেয়ে খারাপও হতে পারে!"
একাধিক বিশেষজ্ঞের মতে, ডেপ-হার্ড মামলাকে ঘিরে 'অ্যাকুয়াম্যান' অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো এবং পরিশেষে ডেপের জয়ের ফলে নারীদের বিরুদ্ধে অনলাইনে বিদ্বেষ ছড়ানোর একটি 'প্লেবুক" তৈরি হয়েছে, যা অ্যাঞ্জেলিনা জোলির বিরুদ্ধেও কাজে লাগানো হতে পারে। এমনকি টুইটারে একাধিক একাউন্ট থেকে জোলিকে অ্যাম্বার হার্ডের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এমনকি যুক্তরাজ্যে গার্লফ্রেন্ডকে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত, এক মাতাল পুরুষও নিজের ফোনে প্রেমিকার ডাকনাম রেখেছেন 'অ্যাম্বার হার্ড'!
এদিকে, 'ওয়েস্টওয়ার্ল্ড' অভিনেত্রী র্যাচেল উড তার প্রাক্তন সঙ্গী মেরিলিন ম্যানসনের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে আসার পর মেরিলিন তার বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন এবং এরপর থেকে র্যাচেলও অনলাইন বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন। ডেপ-হার্ড মামলার রায় ঘোষণার কিছুদিন পরেই মেরিলিন ম্যানসনের এক ভক্ত টুইটারে লিখেছেন- "আরও একজন বিখ্যাত নারী যিনি 'মিথ্যাবাদী' হিসেবে পরিচিত হতে পারেন ভেবে তারা চিন্তিত।" এই একাউন্ট থেকেও র্যাচেলকে 'অ্যাম্বার হার্ড ২.০' নাম দেওয়া হয়েছে।
অনেকেই মনে করছেন, 'হ্যাশট্যাগ মি টু' আন্দোলনের পর অনেক খ্যাতনামা পুরুষদের যে মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিল, তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়াতে বর্তমানে অনলাইনে নারী-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে।
ক্যালগরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও জেন্ডার জাস্টিস বিশেষজ্ঞ মানডি গ্রে বলেন, 'সেই পেন্ডুলাম উপমিতি এখানে চলে এসেছে। জেন্ডার সমতা বা অন্য কোনো সাম্যের ক্ষেত্রে একটু একটু করে যতই উন্নতি হবে, পেন্ডুলামও অন্যদিকে সরে যাবে!"
মিডিয়া ওয়াচডগ মিডিয়া ম্যাটারস লক্ষ্য করেছে যে মামলায় ডেপের জয়ে পর কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম সাইট 'মি টু যুগের সমাপ্তি' বলে ঘোষণা করেছে!
আইনজীবী ফারাহ খান ভাইস নিউজকে বলেন, নারীদেরকে অনলাইনে হেনস্থা এবং তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর পেছনে লুকিয়ে আছে কিছু পুরুষ, যারা পুরো বিষয়টাকে একটা ফ্রেমের মধ্যে ফেলে সাজিয়েছে। পুরুষদের প্রতি সমানুভূতি দেখানোর প্রবণতা এ সমস্যাকে তীব্রতর করে। ডেপ ও পিটের মত ইস্যুগুলো দেখিয়ে মানুষ নির্যাতনের বিষয়টিতে যৌক্তিকতা আনতে চায়।
অনেক সংবাদমাধ্যম থেকেই ব্র্যাড পিটের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে খবরের শিরোনাম করা হয়েছে, জোলির সাথে বিচ্ছেদের পর তার 'দুর্দশার অন্ত নেই' বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গ্রে আরও বলেন, যখন কেউ মামলা এবং অনলাইনে নিন্দার সম্মুখীন হয়, তখন তাদেরকে হয় নীরব থাকা বা একটা দর্শনীয় বস্তু হয়ে ওঠার মতো অসম্ভব সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হয়।
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, র্যাচেল উড, অ্যাম্বার হার্ড... সব অভিনেত্রী ব্যক্তিগত জীবনে একই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তারা প্রাক্তন সঙ্গীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন বলে তাদের প্রাক্তনরা তাদের বিরুদ্ধে আবার মানহানি মামলা করেছেন। এরই মধ্যে ব্র্যাড পিটের বিরুদ্ধে এই অভিযোগও এসেছে যে তিনি অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে দিয়ে জোর করে 'নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট'- এ স্বাক্ষর করাতে চেয়েছিলেন, অর্থাৎ জোলি যেন পিটের বিরুদ্ধে জনসমক্ষে কিছু না বলেন। জোলির ভাষ্যে, ব্র্যাড পিট তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন।
এদিকে ফারাহ খান মনে করেন, অনলাইনে বিদ্বেষ ছড়ানোর ফলে শুধু যে তারকাদের ক্ষতি হয় তা নয়। নারী-বিদ্বেষীদের বিপক্ষে কথা বলে এমন আইনজীবী, সাংবাদিক বা সাধারণ মানুষদেরও টার্গেট করা হয়ে থাকে।
যদিও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, অ্যাম্বার হার্ড এবং র্যাচেল উডের মতো অভিনেত্রীরা নিজেদের আকর্ষণীয় লুক, তারকাখ্যাতি বা অর্থবিত্তের কারণে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে চলে আসেন, কিন্তু অন্যসব ভুক্তভোগীদের ক্ষেত্রে তা হয় না। তাই আইনজীবীরা মনে করেন, অনলাইনে নারীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর ফলে নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেকে নীরব থাকবেন, কারণ তারা ভয় পাবেন যে অভিযোগ করার পর তাদেরকেও এই নিন্দার মুখোমুখি হতে হবে!
গ্রে আরও মনে করেন, মানহানি মামলায় ডেপের বিজয় থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধেই একটা মানহানি মামলা ঠুকে দেয়াকে কার্যকরী উপায় ভাবতে পারেন, যাতে করে যৌন সহিংসতা সম্পর্কিত সকল আলোচনার দ্বার বন্ধ করে দেওয়া যায়। এরকম ভুক্তভোগী যারা অভিযোগ করবেন বলে ভাবছিলেন, তাদের কাছে অনলাইন জগত একটা প্রতিকূল পরিবেশ বলে গণ্য হবে এবং তারা নির্যাতন সহ্য করেও মুখ বন্ধ করেই রাখবেন।
সূত্র: ভাইস নিউজ