খাদ্য নিরাপত্তায় আমদানি-উৎপাদন দু’দিকই সমান গুরুত্ব পাচ্ছে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতির সরবরাহ সংকটের মধ্যেই আগামী বছরে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি ও উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে বাড়তি খাদ্য মজুদ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাই সরকারি-বেসরকারিভাবে ২৬.২২ লাখ টন চাল ও গম আমদানি করে বাড়তি খাদ্য নিরাপত্তা তৈরির কাজ করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশেও যাতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানো যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা ও গবেষণা করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমিতে বাড়তি আমন চাষ হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও ভারত থেকে মোট ৫.৩০ লাখ টন আমদানির জিটুজি চুক্তি করা হয়। এই চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ৩৮ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে এবং এ মাসেই দেশটি থেকে আরও ২০ হাজার টন, ভিয়েতনাম থেকে ২৫ হাজার টন এবং মিয়ানমার থেকে ২০ হাজার টন চাল দেশে আসবে।
অন্যদিকে, রাশিয়া থেকে ৫ লাখ টন ও বুলগেরিয়া থেকে ১ লাখ টন সহ মোট ৬ লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করা হয়। এ চুক্তির বিপরীতে ইতোমধ্যেই বুলগেরিয়া থেকে ১ লাখ টন গম দেশে এসেছে। যুদ্ধের কারণে গম আমদানি বন্ধ হওয়ার সাড়ে আট মাস পর রাশিয়া থেকে ৫০ হাজার টনের একটি চালানও এসেছে এবং আরও ৫০ হাজার টনের একটি চালান এ মাসের মধ্যেই দেশে আসার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজারে সরবরাহ বাড়ানোর জন্য কয়েক দফায় বেসরকারি পর্যায়ে মোট ১৪.৯২ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২ লাখ ৯ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি হয়েছে, বাকিগুলো আমদানির জন্য ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় রয়েছে।
এদিকে, সরকার দুই ধাপে চাল আমদানিতে শুল্ক ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫.৫ শতাংশ করেছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (এক্সটার্নাল প্রকিউরমেন্ট) মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বাড়তি খাদ্য নিরাপত্তা তৈরির জন্য আমরা ফুড গ্রেইন আমদানিতেও গুরুত্ব দিচ্ছি। ইতোমধ্যেই আমরা যেসব চুক্তি করেছি তার আওতায় চাল গম আসতে শুরু করেছে।"
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, চলমান বৈশ্বিক মহামারি, সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, ক্রমবর্ধমান পণ্য মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতাসহ একধিক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে এ বছরের বিশ্ব খাদ্য দিবস-২০২২। বাংলাদেশে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- 'কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়; ভালো উৎপাদন, উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন' (লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড; বেটার প্রোডাকশন, বেটার নিউট্রিশন, আ বেটার এনভাইরোনমেন্ট অ্যান্ড আ বেটার লাইফ)।
এমন সময়ে এ দিবসটি পালন করা হচ্ছে, যখন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা থেকে বারবার সতর্কবার্তা দেওয়া হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এরইমধ্যে আবার ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় বাংলাদেশের অবস্থানের আট ধাপ অবনতি হয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (জিএইচআই) এ বছর ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ থেকে ৮৪তম স্থানে নেমে এসেছে। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড ও জার্মানভিত্তিক ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফের যৌথভাবে প্রকাশিত বিশ্ব ক্ষুধা সূচক-২০২২ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
সামগ্রিক এই পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুর্ভিক্ষের শঙ্কার কথা বারবার তুলে ধরে যার যেটুকু জমি রয়েছে, সবটুকুই চাষাবাদের আওতায় এনে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির পরামর্শ দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পরিস্থিতে দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানি করে খাদ্য মজুদ গড়ার বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। কারণ গত বোরো মৌসুমে চালের উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে বাড়তি দামে চাল কেনার চাপে রয়েছেন ভোক্তারা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, "খরার যে সমস্যায় আমনের আবাদ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছিল সেটি এখন আর নেই। সারাদেশে সেচযন্ত্র চালু করে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা হয়েছে এবং উৎপাদনও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।"
বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য উচ্চফলনশীল জাতের উৎপাদনে জোর দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারিভাবে বীজের সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। চরাঞ্চলের পতিত জমিগুলোকে চাষের আওতায় আনা, শস্য বিন্যাস ও স্বল্পমেয়াদী জাত ব্যবহার করে অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সব ধরনের কর্মপরিকল্পনা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, এ বছর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ লাখ হেক্টর, যা পুরোপুরি অর্জন হয়েছে। আমনে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ কোটি ৬৩ লাখ মেট্রিক টন চাল। ২০২১-২২ সালে আবাদ হয়েছিল ৫৭ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে, আর উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৫০ লাখ টন চাল।
কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এক অনুষ্ঠানে জানান, আমন উৎপাদনে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। আর কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আমনে উৎপাদন গতবছরের তুলনায় বেশি হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
এদিকে, বোরো মৌসুমের ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ সহ আমন ও আউশ চাষের প্রচলিত জাতগুলোর প্রতিস্থাপন করে উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের চাষ বাড়িয়ে ২০২৪-২৫ সালের মধ্যে ধানের উৎপাদন প্রায় ৩২ লাখ টন বাড়ানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানি ও গবেষকরা। এছাড়া, প্রচলিত শস্যবিন্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে পতিত জমিতে তেলফসলের চাষ করে এই সময়ের মধ্যে তেলফসলের উৎপাদন ২৪ লাখ টন বাড়ানো সম্ভব, যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)।
কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক জানান, "আমরা ভোজ্যতেল আমদানিতে প্রতি বছর ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করছি, যেখানে দেশে আবাদ থেকে যোগান আসছে মাত্র ১০ ভাগ। ভোজ্যতেলের স্থানীয় উৎপাদনকে আমরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগে নিয়ে যেতে চাই, বিজ্ঞানীরা যে নতুন প্রযুক্তি আনছেন এসব ব্যবহার করলে আমরা এটি অর্জন করতে পারবো।"
তিনি জানান, "বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে আমরা ভাল অবস্থায় আছি। কিন্তু নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ভবিষ্যতে এই খাদ্য নিরাপত্তা ধরে রাখতে হবে।"
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, "কৃষির উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষককে নানান ধরনের প্রণোদনা দিতে হবে। সারের ভর্তুকি ধরে রেখে নগদ সহায়তা, বিনামূল্যে বীজ-সার বিতরণসহ বিভিন্নভাবেই এই প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। এতে করে উৎপাদনে বড় গতি আসবে। বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে উৎপাদন বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।"
বর্তমানে সরকারিভাবে খাদ্যের মজুদও বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। ১২ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারের কাছে মোট ১৬.৬৯ লাখ টন চাল ও গমের মজুদ রয়েছে, যেখানে শুধু গম রয়েছে ১.৭৩ লাখ টন।