স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এবার পানির কলের বৈশ্বিক বাজারে নজর আকিজের
সম্প্রতি ইউরোপিয়ান টেকনোলজিতে দেশে ফসেট পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে আকিজ গ্রুপ। ফসেট ও স্যানিটারি ওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে এটি দেশের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
আকিজ গ্রুপের ফসেটে বিনিয়োগ এবং স্যানিটারি ওয়্যার ব্যবসা নিয়ে দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টিবিএস এর এক্সিকিউটিভ এডিটর শাহরিয়ার খান। সঙ্গে ছিলেন সিনিয়র রিপোর্টার আব্বাস উদ্দিন নয়ন।
আকিজ গ্রুপ বাথওয়্যার এবং টেবিলওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিতে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে?
দেশে ভালো পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ভালো প্রোডাক্টের জন্য আমাদেরকে বিদেশি পণ্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। আকিজ সব সময় কোয়ালিটি পণ্য উৎপাদন করে মানুষের সেবা করতে চায়। এ জন্যই আমাদের এ ইন্ডাস্ট্রিতে আসা। মানুষের হাতে ভালো মানের ফসেট পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছি আমরা।
কেমন কোয়ালিটির পণ্য উৎপাদন করছেন?
ট্রেডিশনালি আকিজ কোয়ালিটি নিয়েই বেশি কাজ করে। আমরা সবক্ষেত্রেই কোয়ালিটি মেনটেইন করে প্রোডাক্ট নিয়ে আসি। এ প্রোডাক্টটি বাজারে নিয়ে আসার আগেও আমরা দেড় বছর ধরে গবেষণা করেছি।
বাংলাদেশের আবহাওয়া, মানুষের রুচি, চাহিদা এসব গবেষণা করে ফসেট তৈরি করেছি। বাংলাদেশের পানির গুণাগুণ বোঝার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা প্রতিষ্ঠানের একজনকে আমরা প্রায় দেড় বছর ধরে কাজে লাগিয়েছি। বাংলাদেশের পরিবেশ বিশেষ করে উপকূল অঞ্চলে স্যালাইনিটি একটা সমস্যা। এ বিষয়গুলো আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি। এজন্য দেড় বছর সময় নিয়েছি। দেড় বছর পর কার্যকারিতায় রূপান্তর ঘটিয়েছি। প্রকল্পটি উন্নয়নে প্রায় দুই থেকে আড়াই বছর সময় নিয়েছি আমরা।
এটি তৈরি করতে গিয়ে আমরা থিকনেস, কোয়ালিটি, মেটারিয়ালসসহ সব কিছুতে মানুষের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছি। ফসেটের মূল দুটি উপাদান এরেটর (aerator) এবং কারট্রিজ (cartridge)। এই দুটো জিনিসই আমরা বিশ্বের সবচেয়ে ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করছি। এরেটরটা সুন্দর ও সাশ্রয়ী পরিমাণে পানি সাপ্লাই দিতে পারে। আর কার্টিজটা পানির কলকে স্মুথ করবে।
আমাদের দেশের বর্তমান পণ্যগুলোর সঙ্গে আকিজ ফসেটের টেকনিক্যাল পার্থক্যটা কী?
আমাদের প্রোডাক্টের কাস্টিং এবং পলিশিংটা মসৃণ এবং স্টাইলিস। এর থিকনেসও যেকোনো পণ্যের চেয়ে ভালো। ট্রেডিশনালি সাধারণ পণ্যের কাস্টিং প্রসেসটা হলো একটা মোল্ডের মধ্যে মান্ডা করে ডাই এর মধ্যে দিয়ে ফার্নেস করা। এর ফলে ফিনিশিংটা ভালোভাবে হয় না।
অন্যদিকে আমাদের ফার্নেস এবং কাস্টিং মেশিনটা সম্পূর্ণ আধুনিক। আমরা মোল্ডটা প্রেসারাইজড কন্ডিশনে একটা ছাঁচে ফেলি। ফলে অটোমেটেড পলিশড হয়ে বের হয়। এখানে কোনো কলোসিং থাকছে না। কোনো একজন অপারেটরের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজটা হয় না। এটা একটা ইন্টেগ্রেটেড সিস্টেম হওয়ায় আনপলিশড কিছু বের হয় না। এ প্রযুক্তিটা উপ মহাদেশে আমরাই প্রথম এনেছি।
পণ্যটাকে ওয়ার্ল্ড ক্লাস করার জন্য আমরা ডিজাইনকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। এ জন্য কিছু ইন্টার্নাল প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হয়েছে। এগুলো পলিশ করার জন্য আমরা ভালো প্রযুক্তি ব্যবহার করেছি। প্রত্যেকটা পিস যেনো ইউনিক হয় সে জন্য পলিসিং সিস্টেমটা রোবেটিক করেছি।এত হাই কোয়ালিটি প্রোডাক্টটা করার চিন্তা কোথা থেকে এলো?আমরা যেকোনো যেকোনো প্রকল্প করার ক্ষেত্রে চিন্তা করি- প্রকল্প নয় প্রোডাক্ট সেল করবো। তাই পণ্যটি সর্বোচ্চ মানের করার চেষ্টা করি। প্রতিদিন আমার কাস্টমার পণ্যটি ব্যবহার করবেন। তিনি প্রতিদিনই আমাকে দেখবেন। তাই সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটি এনশিওর করি।
আমাদের ফসেটটি যদি দেখেন তবে আপনি দেখতে পাবেন, নান্দনিকতায় এটি সেরা। এটিতে আপনি সেরা মানটিও পাবেন। আমরা প্রকল্প নেওয়ার সময় চিন্তা করি মার্কেটে কোন পণ্যগুলো রয়েছে, তাদের দাম এবং মান কেমন।
ফসেটে আপনাদের কেমন ইনভেস্টমেন্ট? কেমন প্রোস্পেক্ট দেখছেন?
প্রাথমিকভাবে আমরা ১২৫-১৫০ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করছি। এটা ধীরে ধীরে তিনগুণে উন্নীত করার চিন্তা করছি।
দেশে ফসেটের মার্কেট সাইজ দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকা। ম্যাক্রো লেভেলে এটা খুব বড় মার্কেট নয়। তবে আমাদের টার্গেট শুধু লোকাল মার্কেট নয়। আমরা শুধু ভার্টিকালি চিন্তা করছি না। হরাইজ্যান্টাল মার্কেট গ্রোথ নিয়ে ভাবছি। এটিই আমাদের বড় বিনিয়োগ জাস্টিফাই করে।
আকিজের ফসেটের দাম কি মানুষের হাতের নাগালে থাকবে?
আমাদের নতুন প্রোডাক্টটি কোয়ালিটিতে হাই। তবে আমরা এগুলোর মূল্য কোয়ালিটির তুলনায় কমই রাখছি,কমপেয়ার্ড টু বিদেশি পণ্য। আমাদের এই ফসেটগুলো মিডল ক্লাস এবং আপার ক্লাস অ্যাফোর্ট করতে পারবে।
মার্কেটে হিট করার আগেই এক্সপ্যানশনের ঘোষণা দিয়েছেন। এর পেছনে কী ভূমিকা রেখেছে?
দেখুন, আমরা গত বছর আকিজ টেবিলওয়্যার শুরু করেছি। সেখানে এমন সাড়া পেয়েছি যে সাপ্লাই দিয়ে শেষ করতে পারছি না। স্যানিটারি ওয়্যারের ক্ষেত্রেও তাই। সিরামিকস ও স্যানিটারি ওয়্যারে প্রোডাক্টশন ক্যাপাসিটি তিনগুণ বাড়িয়েছি। আরো বাড়াচ্ছি। ফসেটে আমাদের প্রোডাক্ট নিয়ে এখনই যে সাড়া পেয়েছি তাতে এক্সপ্যানশনের টার্গেট করতেই পারি।
বিদেশে এক্সপোর্টের চিন্তা করছেন নিশ্চয়ই…
আমাদের দেশে ফসেটের মার্কেট দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার। খুবই ছোট মার্কেট বাংলাদেশে। ফলে আমাদের এক্সপোর্টের চিন্তা করতেই হচ্ছে। ইংল্যান্ডের একজন রিটেইলার আমাদের স্যানিটারি ওয়্যারের ক্রেতা। তারা এরই মধ্যে আমাদের ফসেট কারখানা পরিদর্শন করে প্রোডাক্ট দেখে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। শিগগিরই রপ্তানি শুরু করতে পারবো। আমরা তাদের জন্য কিছু স্পেশাল প্রোডাক্ট রেডিও করেছি।
যদি আগামী ১০ বছরের কথা বলি, তবে এই ইন্ডাস্ট্রি এবং আকিজের ফসেটের মার্কেট কেমন অবস্থানে দেখতে চান?
এর উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন। আমরা গত বছরই টেবিল ওয়্যার রপ্তানি শুরু করেছি। আশা করছি আগামী এক দুই বছরের মধ্যে আমরা বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানিকারক হতে পারবো। আমরা প্রচুর আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ রিফিউজ করছি। স্যানিটারি ওয়্যারের ক্ষেত্রেও তাই। এটা মূলত জ্বালানি সংকটের কারণে হয়েছে। তাছাড়া আমি স্থানীয় বাজারকে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছি। আমি চাই লোকাল মার্কেটে বেশি স্ট্রং হই।
অন্যদিকে ফসেট মার্কেটের প্রটেনশিয়াল যদি বলতে হয়, তবে এর ভ্যালু চেইন বিচার করলে বিপুল সম্ভাবনা দেখছি। বৈশ্বিক বিলিয়ন ডলারের মার্কেটে আমাদের জন্যও বিপুল সুযোগ রয়েছে।
ইংল্যান্ডের বাহিরে আর কোনো দেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পুরো ইউরোপেই আমাদের জন্য সম্ভাবনা রয়েছে। মিডল ইস্ট, আমাদের প্রতিবেশি ভারতেও মার্কেটেও বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
কোভিডের পর ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, এনার্জি ক্রাইসিস- এসব মিলিয়ে ব্যবসায় প্রেসার কেমন দেখছেন?
কোভিডের প্রভাব বিশ্বের সব দেশে পড়েছে। তবে ওই সমস্যাটায় সেন্ট্রাল ব্যাংক ভালো সাপোর্ট দিয়েছে। ওই সময় টাকা ছিল, ডিমান্ড কমেছে। প্রচুর পণ্য স্টক জমেছে। তবে এখন ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট সংকটটা ভিন্ন। এখন ইনফ্লেশন দেখা দিচ্ছে। ওয়েস্টের মানুষরা ইনফ্লেশনের সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নয়। তারাও এটা ফেস করছে। আমরা ইনফ্লেশনের সঙ্গে জ্বালানি ক্রাইসিস ফেস করছি। এতে ফুড সিকিউরিটির একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ধীরে ধীরে হাই ইনফ্লেশনারি প্রেসারের দিকেই যাচ্ছি আমরা।