পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ আমার গান বেশি শোনে: কবীর সুমন
ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৪টা বেজে ৪৩ মিনিট। নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার ঠিক ১৩ মিনিট পর শূন্য মঞ্চে হঠাৎই উপস্থিত হন সঙ্গীতজ্ঞ কবীর সুমন। নিস্তব্ধ হল ঘরটিতে আগতরা উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন। জলপাই রঙা ফতুয়া, সাদা ধুতি পরে মঞ্চের ঠিক মাঝ বরাবর এসে দুই হাত তুলে শ্রোতাদের উদ্দেশে অভিবাদন জানান তিনি।
গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটের মিলনায়তন ছিল শ্রোতার উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ। ঢাকায় কবীর সুমনের তিনটি শো এর দ্বিতীয় শো ছিল কাল।
তিনি মঞ্চে আসার পর একে এক প্রবেশ করেন তার গানে সঙ্গতকারী তবলাবাদ ইন্দ্রজীৎ প্রধান, তানপুরা বাদক রাকা ভট্টাচার্য ও বেইস গিটার বাদক ধ্রুব বসু রায়।
সুমন এসে যেখানটায় বসলেন ঠিক দুই পাশে দুই বিখ্যাত সংগীতজ্ঞের ছবির ব্যানার স্থাপন করা ছিল। তার হাতের ডান দিকে ছিল ভারতের কলকাতার ওস্তাদ সত্য কিংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাম দিকে বাংলাদেশের কিংবদন্তি ওস্তাদ আজাদ রহমানের ছবি। এই দুই সংগীত মহারথীর সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত কবীর সুমন। তাই তাদেও স্মরণে রেখেই ঢাকার মঞ্চে প্রথম খেয়াল গানের আসর শুরু করলেন তিনি।
খেয়াল গান সম্পর্কে নানাবিধ তথ্য, এর উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে একটি বিশদ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন সুমন। মঞ্চে ওঠার পর প্রায় আধাঘণ্টার বেশি সময় তিনি বাংলা খেয়ালের বিভিন্ন রূপ, ঢঙ এবং এর বহুমাত্রিক প্রয়োগের দিকগুলো শ্রোতাদের শোনান। তার এই কথোপকথনে মনে হচ্ছিল সেটি কোনো গানের আসর নয়, বরং খেয়াল সংগীতের একটি ক্লাস।
কবীর সুমন যে শুধু গানে নয়, কথা বলেও মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষিত করতে পারেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল ১৮ অক্টোবরের গানের আসরে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত থেকেও তার গান শোনার জন্য আসেন শ্রোতারা এসেছিলেন।
গান নিয়ে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন ধরনের গল্প বলে হাস্যরসও তৈরি করছিলেন সুমন। বলেন, 'আমার গান মোটেও বেশী লোক শুনেনা।' আবার পরক্ষণেই বলেন, 'বৃদ্ধদের বিনোদনশিল্পে স্থান কম। তবে সংগীতশিল্পীদের বৃদ্ধ হলে কাজের জায়গা সঙ্কুচিত হয়না।'
এসব কথার একপর্যায়ে তিনি তার গানের শ্রোতাদের তুলনা করে বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশে আমার গানের শ্রোতা বেশি। তাইতো আমি এই অসুস্থ অবস্থাতেও এখানে এসেছি।'
এরপর আবার ফিরে যান বাংলা খেয়াল গান সম্পর্কিত আলাপ আলোচনায়। বিশ্বপুর ঘরানার ওস্তাদ আজাদ রহমানকে নিয়ে তিনি অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বেশ কিছ বাংলা খেয়াল রচনা করে ওস্তাদ আজাদ যে গানের এই ধ্রুপদী ধারাকে সুসংহত করেছেন, তা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেন সুমন।
তিনি বলেন, 'আমি বড়ই দুর্ভাগা। এবার বাংলাদেশে আসার পর আর আজাদ রহমানের সঙ্গে কথা বলা হলোনা। তিনি আমাদের থেকে অনেক দুরে চলে গেছেন। খেয়াল নিয়ে তার যে কি আগ্রহ ছিল তা অনেকেই হয়ত জানে না। এমন গুণী মানুষ সবসময় জন্মায় না।'
আজাদ রহমানের প্রসঙ্গ শেষ করে কবীর সুমন আবারও নিজের মধ্যে ফিরে আসেন। বাংলা গানকে তিনি যে সাধনার মাধ্যমে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কবীর সুমন অল্প বয়স থেকেই এই সংগীত সাধনার কাজটি করে যাচ্ছেন। তাই নিজেই নিজের কাজ সম্পর্কে স্তুতি গাইলেন। বলেন, 'বাংলা গানকে যদি নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়, তাহলে সুমন একটা ঘাট।'
এরপর তিনি পরিবেশন করেন 'এ মোহ আবরণ খুলে দাও' গানটি। সময় সেনের কবিতা থেকে রচিত গানটি গাওয়ার পর শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, 'কারও কারও মুখের হাসি দেখছি। এটার জন্যই আমি বেঁচে আছি।'
এ গানটির পর ত্রিতালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের 'দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে' এবং 'সেই যে ছোঁয়া, সন্ধ্যেও বাঁকে' গান দুটি পরিবেশনের পর তিনি কিছুটা দম নেন।
আয়োজনের এ পর্যায়ে কবীর সুমন বাংলাদেশের আজাদ রহমানের খেয়াল সাধনা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন। আলোচনার পর আবারো ফিরে যান গানে। 'অস্তাচলে শেষ হয়ে যার শুরু পূর্ব রাগে', 'বনের চামেলী ফিরে আয়' ও 'নাচে সখীগন কুঞ্জে' গানগুলো গেয়ে আবারও বিরতি নেন তিনি।
শারিরীক নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অনেকটা মনের জোরেই তিনি মঞ্চে গান গাইতে এসেছেন, এটি যেকোন সংগীত অনুরাগীর জন্যই অনুকরণীয় বিষয়। বিরতির পর তিনি 'কিছু নেই তবে আছে, একা নীল তারায়' গানটি গেয়ে শোনান।
খেয়াল শিক্ষার ওপর গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আবেদনও জানান কবীর সুমন। বাংলা খেয়ালের আরেক কিংবদন্তি পান্না লাল ঘোষ রচিত চন্দ্রমৌলি রাগে 'রাতের ওপারে রাত ছায়াপথ জেগে থাকে' এবং 'ডেকেছি কত সাড়া দিলেনা' গান দুটি শুনিয়ে মনোমুগ্ধকর এক সংগীত আসরের সমাপ্তি টানেন তিনি।