রান্নার ইউটিউব চ্যানেল: সবই সজীব, টাটকা, গাছ কি নদীর কিংবা খেতের!
বাড়ির আঙিনায় লাগানো মরিচ গাছ থেকে ছেঁড়া হচ্ছে ছোট ছোট ঝাঁঝালো মরিচ। তারপর সেগুলোকে মাটির হাঁড়িতে পোড়ানো হচ্ছে—আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলা হয় 'মরিচ টালা'। পোড়া মরিচ মাখিয়ে বানানো হবে ঝাল ঝাল টাকি মাছের ভর্তা—এইজন্যেই এতো আয়োজন। পাশেই রাখা তরতাজা টাকি মাছ তেলে ভেজে নেওয়া হয়েছে। মাছের কাঁটা বেছে মরিচ, পেঁয়াজের সাথে শিলপাটায় পিষে বানানো হচ্ছে ভর্তা। বাড়ির উঠোনে পাতা হয়েছে পাটি। রান্না শেষে সেখানেই আয়েশ করে মাটির বাসনকাসনে চলবে ভাতের সাথে ভর্তা ও অন্য তরকারি যোগে বন্ধুদের খাওয়াদাওয়া।
এটি কোনো চড়ুইভাতির দৃশ্য বা আয়োজন না। 'বাংলাদেশি ভিলেজ ফুড' নামক ফেসবুক পেজে হরহামেশাই এমন গ্রামীণ রান্নার ভিডিও আপলোড করা হয়।
আপাতদৃষ্টিতে কুকিং ভ্লগ মনে হলেও কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ভিডিওর মধ্যে ব্যবহার করা হয় না বাহ্যিক কোনোপ্রকার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। এমনকি ভয়েস ওভার বা রান্নার একঘেয়ে বর্ণনা দেওয়ার বিষয়টিও অনুপস্থিত। প্রকৃতির নিজস্ব শব্দ, পাখির ডাক, পানির শব্দ, কড়াই-খুন্তির ঝনঝন আওয়াজ যেন ভিন্নমাত্রা যোগ করে ভিডিওগুলোতে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, দেশীয় রান্নার ভিডিওতে নারী রাঁধুনিদের আধিপত্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু 'বাংলাদেশী ভিলেজ ফুড' পেইজের ভিডিওতে নেই নারীর উপস্থিতি। মাছ কাটাকুটি থেকে মসলা বাটা ও রান্নার যাবতীয় কাজ করেন পুরুষ। ঘরের কাজ পুরুষ-নারীভেদে সকলের জন্যে তা এখানে যেন আরও স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাইতো ভিডিওর কমেন্টে বহু নারীকে দেখা যায় তাদের পুরুষসঙ্গী, ভাই ও বন্ধুদের মেনশন করতে। যেখানে ছেলেদের উদ্দেশে লেখা থাকে—"দেখো দেখে শিখো কিছু", "তুমিও রান্না করে খাওয়াবা", বা "ছেলেরাও কতো ভালো রান্না করতে পারে দেখো" এমন নানান মন্তব্য।
রান্নার ভিডিও ধারণ থেকে শুরু করে নির্দেশনা ও অন্যান্য দায়িত্বে থাকেন সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া রুবেল। রান্না শেষ হওয়ার পরের ধাপে রুবেল ও গ্রামের অন্য বন্ধুদের সাথে মিলে চলে তৃপ্তি করে খাওয়ার পর্ব। ইতিমধ্যে 'বাংলাদেশী ভিলেজ ফুড' ফেসবুক পেজটির ফলোয়ারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৪ হাজারে। তাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সে তুলনায় নবীন, সর্বশেষ সাবস্ক্রাইবার সংখ্যাটা প্রায় ১৮শ।
২০২১ সালের জানুয়ারির ১ তারিখে সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া রুবেল ফেসবুকে পেজ খুলে গ্রামীণ রান্নার ভিডিও ধারণ করে আপলোড করা শুরু করেন। তার অবশ্য অনেকদিনের শখ ছিলো ভিডিও কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করার। ব্যস্ত জীবনে সে সুযোগ ও সময় হয়ে উঠেনি। করোনাকালীন স্থবিরতায় তার ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো যাচ্ছিলো না। তাই বেশ ক'বার চিন্তার পর অনেকদিনের শখ পূরণের উদ্যোগ নিলেন।
প্রায় ১২ বছর ধরে তিনি পড়াশোনা ও পেশাগত কাজে ঢাকায় বসবাসরত ছিলেন। ২০১৮ সালে ব্যবসায়িক কাজে রুবেল নিজ গ্রামে বাড়ি ফিরে যান। কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষণপাড়া থানার বড়ধুশিয়া গ্রামের এই তরুণ-ছোটবেলার সেই চিরচেনা আঙিনায় ফিরে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন।
সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া রুবেল বলেন, "আমার শৈশব গ্রামে কেটেছে। কাজের সূত্রে দূরে থাকলেও গ্রামের পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়া, পুরনো স্মৃতিগুলো ভীষণ মনে পড়তো। আমার ছোট-খাটো একটা ব্যবসা ছিলো। করোনার সময় ওটার হালচাল ভালো যাচ্ছিলো না। ভিডিও কন্টেন্ট নিয়ে অনেক আগ থেকেই আগ্রহ কাজ করতো। গ্রামের বাড়ি এসে সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রামীণ খাবারদাবারকে ভিডিওর মাধ্যমে তুলে ধরবো। কারণ আমার মনে হয়েছিল- শহরে থাকলেও গ্রামের খাবার ও পরিবেশ সবকিছুর প্রতি মানুষের আলাদা টান সবসময় কাজ করে। রান্না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমার ছোটবেলার বন্ধু জুয়েল ভূঁইয়ার নাম প্রথমেই মাথায় আসে। রান্নাবান্নার প্রতি সবসময় ওর তীব্র আগ্রহবোধ কাজ করতো এবং এককথায় ভালো রাঁধুনি বলা চলে। জুয়েলের মা অসুস্থ থাকায় ছোটবেলা থেকেই রান্নার কাজে সে তার মাকে সাহায্য করতো। সেখান থেকেই জুয়েলের রান্নার হাতেখড়ি। ছোটবেলায় বন্ধুরা মিলে পিকনিকের আয়োজন করলে জুয়েল থাকতো রান্নাবান্নার দায়িত্বে। জুয়েল প্রায় ২ বছর সৌদি ছিলো। সেখানে থাকাকালীন সে নিত্যদিন রান্না করতো। তাই রান্নার ক্ষেত্রে ওর আগ্রহ ও অভিজ্ঞতা দুটোই পাকা ছিলো।"
"রান্না করার কথা জানাতেই জুয়েল রাজি হয়ে যায়। দু'জনের শখের জায়গা থেকেই শুরু করা হয়েছিল আমাদের পেজটি। ক্যামেরার সামনে এসে রান্না করার কাজটি জুয়েল করে। নির্দেশনা ও অন্যান্য যাবতীয় কাজ আমাকে করতে হয়। কী রান্না করা হবে? ভিডিওর ধরন কেমন হবে? কীভাবে শট নিলে ভিডিওর জন্য ভালো হবে- সবকিছু আমি ঠিক করে দেই। তারপর সবকিছু পরিকল্পনা মতো ঠিকঠাক হওয়ার জন্যে একটি ভিডিও বানাতে অনেকবার শট নিতে হয়।"
গ্রামের আবহে একটি করে রেসিপি
রান্নার উপকরণ জোগাতে ছুটতে হয় না বাজারে। গাছে ঝুলছে লাউ, কুমড়া, শাক-লতাপাতা। পুকুরে আছে কয়েক প্রজাতির মাছ। তাই হুটহাট ইচ্ছে অনুযায়ী রান্না করে পেটপূজোর জন্যে ভাবতে হয় না। ভিডিওতে দেখা যায়, রান্নার জোগাড় করতে খাল থেকে পুঁটিমাছ ধরে আনা হয়েছে। মাছ বটিতে কেটে, তেলে ভেজে- টমেটোর সাথে রান্নার জন্যে বসানো হয়েছে মাটির চুলার ওপরে।
অন্য ভিডিওতে দেখা যায়, তাজা কৈ মাছের সাথে বেগুনের তরকারি রান্না করা হবে। রান্নার জন্যে বেগুন আনা হয়েছে বাড়ির পাশে লাগানো সবজি ক্ষেত থেকে। সবজি গাছ থেকে পেড়ে আনা তাজা সবজি ও খাল থেকে ধরে আনা মাছ পানিতে ধুয়ে রান্না করা হচ্ছে। রান্নার এইরকম খুঁটিনাটি সব কিছুই তুলে ধরা হয় ভিডিওগুলোর মাধ্যমে। সাধারণ এই রান্নাগুলোর স্বাদ কমবেশি সকলের জানা। তবু যেন সাধারণেই রয়েছে অসাধারণত্ব। তাইতো প্রতিটি রান্নার ভিডিও-তে কয়েক হাজার মানুষের রিয়েক্ট ও লাখো ভিউ হয়। অনেকে আবার কমেন্ট করে নিজেদের অভিব্যক্তি জানান। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা নিয়মিত রান্নার ভিডিও দেখেন, কিন্তু রান্নায় ব্যবহার করা সবজি ও মাছের নাম আগে কোনোদিন শুনেননি। না জানার কারণটাও স্পষ্ট, কারণ তারা ভিন্ন দেশ ও ভাষাভাষীর লোক। রান্নার সহজ প্রক্রিয়া ও মনোরম গ্রামীণ পরিবেশ উপভোগ করতেই তারা নিয়মিত ভিডিওগুলো দেখেন। শুধু রান্না উপভোগ করেন তাই নয়। অনেকেই স্বাদ পরখ করতে ভিডিও দেখে নিত্যকার এইসব ঘরোয়া রান্নার আইটেম-নিজেদের বাসায় রান্নার চেষ্টা করেন। আর কমেন্টে এভাবেই নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানান দেন একেকজন।
'বাংলাদেশী ভিলেজ ফুড' পেজের এডমিন ও ক্যামেরার পেছনে নেপথ্যে যিনি থাকেন- সালাহউদ্দিন ভূঁইয়া রুবেল জানান, "আমাদের পেজের ভিডিও যারা নিয়মিত দেখেন, এদের মধ্যে ৪৮% লোক অন্য দেশে বসবাসরত। তাদের মধ্যে অন্যদেশে বসবাস করা বাঙালিরাও আছেন। পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে সংখ্যাটা বেশি। আরও কিছু ফলোয়ারস আছেন- যারা সৌদি, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে থাকেন। বাঙালি ছাড়াও এসব দেশের নাগরিক যাদের ভাষা ভিন্ন- তারাও আমাদের ভিডিও দেখেন। তাই বাংলা ভাষায় কথা বললে হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবে না। আবার সেক্ষেত্রে প্রকৃতির যে নিজস্ব শব্দ আছে তা ভালোভাবে উপলব্ধি করা যাবে না।"
"আমি চেয়েছি বাংলাদেশের গ্রামের খাবারকে তুলে ধরতে তাই পেজের নামের সাথে 'বাংলাদেশী' কথাটি যুক্ত করেছি। রুরাল ফুড বা ভিলেজ ফুড দিলে হয়তো অন্যদেশের ভিউয়ারস আরও বাড়তো। বাংলাদেশী নামের সাথে পেজের লোগোতে বাংলাদেশের পতাকার রঙ রেখেছি। অন্যান্য রান্নার চেয়ে ভর্তার ভিডিওগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভিউ ও শেয়ার পড়েছে। যেগুলোর কোনোটি মিলিয়ন ছাড়িয়েছে।"
সমস্যা ঠেলে সফলতা
"শুরুতে ভিডিও নিয়ে আগ্রহ থেকে পেজ খোলা হলেও- অনেক কিছুই জানা ছিল না। ২ মাসে আপলোড করা ভিডিওর মোট সময় ৬ লাখ মিনিট হলে ফেসবুক থেকে মনেটাইজিং পাওয়া যায়। আর সে সময় আমার পেজের ফলোয়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার ছুঁইছুঁই। ঠিক তখন ফেসবুকের পলিসি ইস্যু তে পড়তে হয়েছিল। কেন এমন হচ্ছিলো বুঝতে পারছিলাম না। রান্নার ভিডিও, গ্রামের পুকুর থেকে মাছ ধরা, গাছ থেকে ফল পাড়ার ভিডিও ছাড়া অন্য কোন প্রকার ভিডিও ছিল না। সমস্যার কারণ বুঝতে না পেরে পেজ থেকে আপলোড করা ৩০টি ভিডিও থেকে ১৪টিই ডিলিট করে দেই। ভিডিও ডিলিট করার পর প্রায় ৭/৮ মাস আমাদের এই পেজ ডাউন ছিলো। এররকম পরিস্থিতিতে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এছাড়াও নানারকম প্রযুক্তিগত সমস্যায় মাঝেমধ্যে পড়তে হয়েছিল", প্রতিবন্ধকতার কথা বলতে গিয়ে জানান রুবেল।
কিন্তু সবকিছুর পরেও স্বস্তি ও আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে ধীরে ধীরে তার পেজের ফলোয়ার বাড়তে থাকে। এর পেছনে উৎসাহ, পরামর্শ ও অবদান ছিলো দু'জন ব্যক্তির। তাদের একজন হচ্ছেন 'রিম্পি অরুণ ব্লগ' পেজের জাহাঙ্গীর হোসেন অরুণ। অন্যজন হচ্ছেন 'ইজি রেসিপি' চ্যানেলের কর্ণধার ইরফানুল বারি।
শুট করার পর প্রতিটি ভিডিও এডিট করতে পেজের এডমিন রুবেলের প্রায় ৭/৮ ঘণ্টা সময় লাগে। ভিডিওর দৈর্ঘ্য বড় হলে সেক্ষেত্রে পরিশ্রম ও সময়টা আরও বেশি। মাত্র ১.৫ বছরের যাত্রায় পেজটিতে ১০০টির বেশি ভিডিও আপলোড করা হয়েছে। ফলোয়ার ও ভিউয়ের সংখ্যা বাড়ায় এটি থেকে ভালো অঙ্কের অর্থ উপার্জন আসতে শুরু করে। তাই শখ থেকে ভিডিও ধারণের কাজ শুরু হলেও- এটিকে এখন প্রফেশন ও অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখছেন দুই বন্ধু। 'বাংলাদেশী ভিলেজ ফুড' পেজ ছাড়াও রুবেলের আরও ৪/৫টি পেজের কার্যক্রম চলছে। শখের যাত্রা তার জন্যে অনেকটা সুখের মতোই ধরা দিয়েছে। তাই এটি নিয়ে এখন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার কথা ভাবছেন তারা।