বানরগুলোর কথা ভাবছে না কেউ
সিলেট নগরীর গোয়াইটুলা এলাকার হযরত চাষনী পীর (র.)-এর মাজারে এমনিতে প্রতিদিন দর্শনার্থী-পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। টিলার ওপরের এই মাজারের গাগাছালিতে দুই শতাধিক বানরের বাস। স্থানীয়দের কাছে এটি 'বানরের টিলা' নামে পরিচিত।
এখানে ভক্তরা আসেন মাজার দর্শনে। বানর দেখতেও আসেন অনেক পর্যটক। কলা-বিস্কুট-বনসহ বানরদের জন্য বিভিন্ন খাবার নিয়ে আসেন তারা।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে গত কয়েকদিন ধরে দেখা দিয়েছে বিপত্তি। ভাইরাসের বিস্তার রুখতে সারাদেশে অঘষোষিত লকডাউন চলছে। সব বন্ধ। চাষনী পীরের মাজারেও নেই দর্শনার্থী। ফলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে অনেকটা অভুক্ত অবস্থায় রয়েছে এখানকার বানরগুলো।
এক জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকানোর উদ্যোগে বিপাকে পড়েছে এখানকার অসংখ্য জীব; মানুষও। বিশেষত নিম্নবিত্ত-দিনমজুর মানুষেরা। তাদের পাশে তবু দাঁড়িয়েছেন সামর্থবানেরা। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সারা দেশেই অসহায় মানুষদের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। ব্যক্তি উদ্যোগেও সহায়তা করছেন অনেকে। কিন্তু এই বানরগুলোর পাশে কেউ নেই। তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসেননি কেউ।
খাবার না পেয়ে গত কয়দিন ধরে হিংস্র হয়ে উঠেছে 'বানর টিলার' বানরেরা। আক্রান্ত করছে আশপাশের বাসিন্দাদের। ঘরে ঢুকে ছিনিয়ে নিচ্ছে খাবার-কাপড়চোপড়। আক্রমণ করছে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা লোকজনের ওপর।
এমনিতেই টিলা ও গাছপালা কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণে খাদ্য ও আবাস সঙ্কটে পড়েছিল এখানকার বানরেরা। এতে নানা উপদ্রবের শিকার হচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গত কয়েকদিনে সেটি আরও বেড়েছে।
জানা যায়, চাষনী টিলার পাশেই দলদলি চা বাগান। এই বাগানেই ছিল বানরগুলোর আদি নিবাস। আশির দশকে চা বাগানের একাংশের বন কেটে গড়ে তোলা হয় আবাসন। ১৯৮৪ সালের শুরুর দিকে সেখানকার বানরগুলো এসে মাজার এলাকায় বসত গড়ে। সেই থেকে ওরা এখানেই রয়েছে।
তবে গত কয়েক বছর ধরে ওই টিলার আশপাশের বন ও টিলা ধ্বংস করে গড়ে উঠেছে আরও আবাসন। ফলে আরও সঙ্কটে পড়ে বানরগুলো। তবে গত এক সপ্তাহের মতো সঙ্কটজনক অবস্থা আগে কখনো তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বৃহস্পতিবার সকালে ভ্যানে করে সবজি নিয়ে গোয়াইটুলা দিয়ে যাচ্ছিলেন সবজি বিক্রেতা শওকত আলী। মাজারের সামনে যাওয়ার পরই তার ভ্যানে হামলে পড়ে একদল বানর। ছিনিয়ে নিয়ে যায় শসা-টমেটোসহ সবজিগুলো।
এমন ঘটনা গত কয়েকদিন ধরে প্রায়ই ঘটছে বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দা আজমল হোসেন। তিনি বলেন, এই রাস্তা দিয়ে কেউ খাবার নিয়ে যেতে পারছে না। এমনকি বাচ্চারা বাড়ির ছাদে উঠলেও বানর এসে কামড়ে দিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার চাষনী পীরের মাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, টিলার পাদদেশেই গড়ে ওঠেছে বেশ কয়েকটি বাসা। এসব বাসার ছাদ, কার্ণিশ আর দেয়ালে ঝুলছে বানর। এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফালাফি করছে। লোকজন দেখলেই দলবেঁধে ছুটে আসছে।
মাজারের প্রধান ফটকের সামনে মিম স্টোর নামের একটি খাদ্যসামগ্রীর দোকান। ওই দোকানের সত্ত্বাধিকারী সেলিম আহমদ বলেন, এই টিলায় আগে অনেক কাঠবাদামের গাছ ছিল। সেগুলো এখন নেই। গাছগাছালিও কমে গেছে। ফলে বানরের খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
তিনি বলেন, মাজারে আসা লোকজনের দেওয়া খাবারই ওদের একমাত্র ভরসা। গত কয়েকদিন ধরে মাজারে লোকজনের আসা বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছে বানরগুলো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কীম বলেন, এই টিলা তো বানরেরই আবাসস্থল ছিল। মানুষজন ওইদিকে গিয়ে বানরের আবাস ও খাদ্যসংগ্রহের গাছগুলো ধ্বংস করেছে। ফলে এরা খাবার ও আবাস সঙ্কটে পড়েছে। এ অবস্থায় পর্যটকদের দেওয়া খাবারই এদের একমাত্র ভরসা ছিল। এখন পর্যটক না থাকায় এরা চরম বিপাকে পড়েছে। প্রায় অভুক্ত অবস্থায় রয়েছে।
তিনি বলেন, দুঃসময়ে যেভাবে অনেক মানুষ খাবার নিয়ে অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, সেভাবে আমাদের এই বানরগুলোর পাশেও দাঁড়ানো উচিত। জগতের সকল প্রাণীর কথা ভাবতে হবে, সকল প্রাণীকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে হবে- করোনাভাইরাসকালীন সঙ্কট থেকে আমাদের এই শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।
সড়কের পাশের বেওয়ারিশ কুকুর ও মাজারের বানরদের খাবার প্রদানে সিলেটের পরিবেশকর্মীরা উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
তবে বানরগুলোর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় খাবারের ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছেন মাজারটির অন্যতম খাদেম মোহাম্মদ মুহিত হাসান।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এসএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণাগারগুলোতে থাকা বন্যপ্রাণীদের মধ্যে আমরা নিয়মিত খাবার বিতরণ করি। তবে উন্মুক্ত অবস্থায় থাকা প্রাণীদের খাবার বিতরণের কোনো পরিকল্পনা এখনো আমাদের নেই।